ঢাকা: ‘লক্ষ্মৌ’ দেখার শখ জাগে বিশ কি একুশ বছর বয়সে। তখন লক্ষ্মৌ নিয়ে কত কথাই যে শুনেছি।
বহু বছর ধরে এই লক্ষ্মৌ উত্তর প্রদেশের রাজধানী। কথায় বলে, ‘বেনারস কি সুবাহ অওর লক্ষ্মৌ কি সাম’ অর্থাৎ ‘বেনারসির ভোর আর লক্ষ্মৌয়ের সন্ধ্যা’। আগ্রায় গিয়ে ভাবলাম, এখান থেকে লক্ষ্মৌ গেলেই তো ভালো হয়।
রাত সাড়ে ৯ টার ট্রেন এলো ২ ঘণ্টা পরে অর্থাৎ সাড়ে ১১টায়। এরআগে আগ্রা রেলস্টেশনে একটা কাণ্ড ঘটল। এক মাতাল যুবক ফুলের মালা নিয়ে এসে বন্ধু রানাকে পড়িয়ে দিল।
সকাল ৮টায় এসে পৌঁছলাম লক্ষ্মৌতে। চারবাগ রেলস্টেশন থেকে বেড়িয়ে রিকশায় উঠে চললাম হোটেলের দিকে।
আসফউদ্দৌলা পার্কের কাছে সেন্ট্রাল হোটেলে উঠলাম। দুপুর থেকেই রিকশায় উঠে চললাম লক্ষ্মৌ শহরের নবাবী কীর্তি দেখতে।
লক্ষ্মৌ মিউজিয়ামে ঢুকে দেখলাম গুপ্ত ও মোগল যুগের মুদ্রা ও পাণ্ডুলিপির কত সংগ্রহ। ছবিরও অমূল্য সংগ্রহ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। নবাবদের দুর্গের পাশে এসেই দেখি ইমামবাড়া।
ওখানে পরিচয় হয় লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে। নাম তার জাভেদ মাহমুদ। দু-চার কথায় বেশ বন্ধুতা গড়ে উঠল আমাদের মধ্যে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আমাদের সঙ্গে ঘুরতে আগ্রহী হলো।
জাভেদ মাহমুদ বলল, এই বড় ইমামবাড়া ১৭৮৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের আশ্রয় দিতে নবাব আসফউদ্দৌলা তৈরি করান। ওই যে দেখছেন গম্বুজ ও খিলান ধরনের স্থাপত্য ভবন- সেটি ইসলাম ধর্মের তিন ইমাম হজরত আলী, হজরত হাসান ও হজরত হুসেনের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত।
এর ভেতরে রয়েছে বিশাল হলঘর। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই ‘ভুলভুলাইয়া’। চলুন ওখানে। আগেই শুনেছিলাম, গাইড ছাড়া ভুলভুলাইয়ায় ঢুকলে বের হওয়া অসম্ভব। গাইডের সঙ্গে এবার পা বাড়ালাম ভুলভুলাইয়ার দিকে।
দেখি আঁকাবাঁকা পথ। সিঁড়ির পথ অন্ধকার। গাইড বললেন, দেশলাই জ্বালালে বা ফিসফিস করে কথা বললে তা শোনা যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
ঘুরে ঘুরে দেখার সময় মনে হলো, পারব তো বেরিয়ে আসতে, না-কি হারিয়ে যাবো! ওখান থেকে বেরিয়ে আসতেই ভয়টা কেটে গেল। ভুলভুলাইয়ার বাঁয়ে রয়েছে মসজিদ। ডানদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম অতল জলের কুয়া।
ওখান থেকে ছোট ইমামবাড়ার দিকে যেতে প্রথমেই চোখে পড়ল ‘রুমি দরজা’। জাভেদ আমার হাতটা স্পর্শ করে বলল, এই রুমি দরজার তোরণ লক্ষ্য করে একদা ইংরেজরা একঘণ্টা ধরে ৯ পাউন্ড ওজনের গোলা ছুঁড়ে মহড়া দেয়, ফলে ধ্বংস হয় তোরণ। তবে রুমি দরজাটি আগের মতোই রয়ে গেছে।
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি ক্লক টাওয়ার। ১৮৮৭ সালে নবাব নাসিরউদ্দিন হায়দার ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয় করেন এর নির্মাণে। ক্লক টাওয়ারের উত্তরে হুসেনাবাদ জলাশয় লাগোয়া পিকচার গ্যালারিতে ঢুকেই দেখি অযোধ্যার নবাবদের প্রতিকৃতি।
একটু পশ্চিমে এগিয়ে গেলাম, এবার দেখতে পেলাম ছোট ইমামবাড়া। এখানে গিয়ে জানলাম, এটি মহম্মদ আলী শাহ নির্মিত তারই স্মৃতিসৌধ। ভেতরে রয়েছে জলাশয়, তাজের অনুকরণে কন্যা আসুজা জিনাত ও জামাতার সমাধিসৌধ। ওখানে দেয়ালজুড়ে কোরআনের পবিত্র আয়াত উৎকীর্ণ দেখে শুধু তাকিয়ে রইলাম। তবুও সে দেখা শেষ হয় না।
অটোতে উঠে এবার চললাম ছাত্তার মঞ্জিল প্যালেসের দিকে। জাভেদ মাহমুদ বলল, এক সময় ছাত্তার মঞ্জিল নবাবদের বাসস্থান ছিল। একটু উত্তরে এগিয়ে গিয়ে দেখি গোমতী নদী। এই নদীর তীরে শহীদস্মারক মার্টায়ার মেমোরিয়াল।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে নিহত শহীদদের স্মরণে একশ’ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় এটি। এর পশ্চিমে গোলাপ বাগিচায় ঘেরা দি রেসিডেন্সির কাছে এলাম এবার। ওখানে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবিও তুলে নিলাম।
দি রেসিডেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন গাইড। তাকে দশ রুপি দেয়ার বিনিময়ে জানা যাবে এর অতীত ইতিহাস। গাইড জানালেন, এটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ভবন। ১৮০০ সালে নবাব শাহাদাত আলী খান এটি নির্মাণ করান তার দরবারে ব্রিটিশ দূতের বসবাসের জন্য।
আর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় স্বল্প সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য এই ভবনে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ করেছিল সিপাহিদের। তখন গোলাগুলিতে ধংস হয় ভবন ও সংলগ্ন স্থাপত্যকর্ম।
ওই যে দেখুন ইংরেজদের সমাধিগুলো...। দেখে মনে হলো, মানুষের জীবনটা কী! কোথায় গেল সেই ব্রিটিশ শাসনামলের দিনগুলো! ইংরেজরা কত স্মৃতি রেখে গেল এই লক্ষ্মৌতে।
একে একে দেখে নিলাম লক্ষ্মৌয়ের শাহ নাজাফ সৌধ, কাইজার বাগ, সিকান্দার বাগের যে দিকে তাকাই, মনে হয় সবই যেন নবাবী নবাবী ভাব। জাভেদ মাহমুদ বলল, আমাদের লক্ষ্মৌ ছেয়ে আছে শুধুই নবাবী কীর্তিতে।
নবাব সাহাদাত আলীর সমাধির ওখানে এসে দেখি সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ভাবলাম, কোথায় সেই নবাবরা! তাদের কীর্তি আছে, অথচ তারা নেই। জাভেদ মাহমুদ একটু অনুশোচনার সুরে বলল, সবার জীবনে একদিন মৃত্যু আসবে... একে একে সবাই যে চলে যাব!
কথাটা শুনে রানা গানের সুরে জানাল : ‘কী পাইনি তারই হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি! আজ হদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি। ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে...। ’
ওখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে জাভেদকে বললাম, লক্ষ্মৌয়ের কী কী বিখ্যাত আছে- যা কেনা যায়! ও বলল, সারাবিশ্বে জরির নানা কারুকার্যখচিত চিকন শাড়ি ও পাঞ্জাবির সমাদর আছে।
চলুন লক্ষেষ্টৗয়ের চকবাজারে, ওখানে সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি পাবেন। এক দোকানে ঢুকতেই দোকানি ‘আস সালামু আলাইকুম’ বলে বসতে দিয়ে ‘কী কী দেখবেন’। তার সহকর্মী ভদ্রমহিলা একটু হেসে বাংলা থেকে এসেছেন, ওখান থেকে তো অনেকেই আসেন।
পাজামা-পাঞ্জাবি চাচ্ছি- বলতেই উনি নানান রংয়ের পাজামা-পাঞ্জাবি দেখালেন। যেটা দেখি, সেটাই পছন্দ হয়ে যাচ্ছে। জাভেদ নেড়েচেড়ে বলল, এই পাঞ্জাবিটা নিন, বেশ মানাবে...।
পাশেই বসা লক্ষ্মৌয়ের এক ভদ্রমহিলা বললেন, নিন এটাই নিন...। পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে বাইরে আসতেই জাভেদ বলল, আতর দেখবেন না...। লক্ষ্মৌয়ের আতরের সুবাস- সেও আমোদিত করে তোলে আমাদের। ওর কথায় মুগ্ধ না হয়ে কী আর পারা যায়। দেখলাম, প্রতিটি দোকানের মালামাল ঝলমল করছে বিদ্যুতের আলোতে।
জাভেদ বলল, আমাদের এখানে কোনো লোড শেডিং নেই। ওই যে দেখুন নবাবী আমলের নানা মালামাল সাজিয়ে রেখেছে দোকানে দোকানে। শুধু কী তা-ই, ভোজনবিলাসী নবাবদের মুখরোচক নানা আহার লক্ষ্মৌয়ের কৃষ্টি হয়ে আজও মেলে হোটেল-রেস্তোরাঁয়। বিরিয়ানি, পোলাও বা রুমালি রুটির সঙ্গে মোরগ-মোসল্লাম আর কাগজি-কাবাবের স্বাদ নিতে পারেন হজরতগঞ্জে গিয়ে...।
এ কথা শুনে জাভেদকে সঙ্গে নিয়ে রানা ও আমি এবার চললাম হজরতগঞ্জের রয়্যাল ক্যাফেতে। চিকেন বিরিয়ানি খেতে খেতে জাভেদকে বললাম, বাহ, দারুণ মজাদার তো বিরিয়ানি।
একটু হেসে বলে, নবাবী বিরিয়ানি, তা তো মজাদার হবেই। এদিকে রাত দশটা বেজে গেছে। কী আর করা, জাভেদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললাম, কাল সকাল সকাল হোটেলে চলে এসো... তোমার সঙ্গে গল্প করব। একটু হেসে কাছে এসে বলল, অবশ্যই আসব।
আপনাকে কাল কণ্ঠশিল্পী ও নায়ক তালাত মাহমুদের বাড়ি দেখাব। তালাতের গাওয়া ‘দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে/একই তরু শাখা পড়ে ছিল বাঁধা লীলাভরে/অজানা সে কোন ঝড়ে ভেঙে নিলো বাসাটিরে/বিধাতার অভিশাপ নিয়তির হলো জয়/ছিঁড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয়/ছিল যেথা আলো হাসি ফুলদল মধু বাঁশি/আজ সেথা কিছু নাহি বায়ু কেঁদে যায় নীড়ে...’ গানটি নিশ্চয়ই শুনেছেন।
ওকে বললাম, বাহ, তুমি তো অকপটে গানের সব কথা বলে গেলে। একটু হেসে, দেশ ভাঙার সময় আপনারা হারালেন কত না মুসলিম কীর্তির শহর, যেমন জুনাগড়, আহমদাবাদ, শ্রীনগর, মুর্শিদাবাদ, পাটনা, বিহার শরিফ, আজমীর শরীফ, মালদা, দিল্লি, আগ্রা আর লক্ষ্মৌ নগরীসহ কত না কিছু..।
গোমতী নদীর ধারে লক্ষ্মৌয়ের কথা নিয়ে বার বার ভেবেছি হোটেলে বসে। নবাব আসফউদ্দৌলাই এই নগরীকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন শিক্ষা, সংস্কৃতি আর স্থাপত্যশিল্পের মেলবন্ধনে।
তাকে এখনও লোকজন স্মরণ করেন। শহরের বাছাই কিছু দ্রষ্টব্য দেখায় বাস কন্ডাকটেড ট্যুরে। সারাদিনের ট্যুরে জনপ্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা (ভারতীয় রুপি)। অবশ্য আমরা এই নগরী দেখেছিলাম অটো আর রিকশায় চড়ে।
সেজন্য খরচটা আমাদের একটু বেশি লেগেছিল। কলকাতার হাওড়া থেকে লক্ষ্মৌ যায় উপাসনা এক্সপ্রেস, দুন এক্সপ্রেস, কুম্ভ এক্সপ্রেস, অমৃতসর এক্সপ্রেস, হিমগিরি এক্সপ্রেস, জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস ইত্যাদি।
লক্ষ্মৌ থেকে বারানসি ২৮৬ কিলোমিটার, দিল্লি ৪৯৭ কিলোমিটার, এলাহাবাদ ২০৪ কিলোমিটার। এসব গন্তব্যে বাস ও ট্রেন যাচ্ছে লক্ষ্মৌ থেকে। ট্রেনে রিজারভেশন পাইনি বলে বাস ধরে লক্ষ্মৌ থেকে চললাম বারানসির দিকে।
তখনই মনে পড়ল, অতীতের নবাবী শহর লক্ষ্মৌ এখন নব সাজে সেজে উঠেছে! এই শহরে রয়েছে কত আবাসিক হোটেল।
হোটেল রাহি গোমতি, হোটেল যশ, হোটেল আশা, হোটেল অমরপ্রেম, হোটেল দীপ অবোধ, হোটেল অপসরা, হোটেল এক্সপ্রেস এগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়!
আজকাল এসব হোটেলে রুম ভাড়া (দু’জন থাকা যায়) ৯০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। লক্ষ্মৌতে এসে পাওয়া যায় আদর, আতিথেয়তা- যা আর কোথাও এমন মেলে না।
বাংলাদেশ সময় : ১৪১৪ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর