‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটি স্টিফেন হকিং এবং ক্যালটেকের পদার্থবিদ লিওনার্দ ম্লডিনাও-এর লেখা বহুল আলোচিত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। বইটি ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বাংলা ভাষায় এ বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো।
আমাদের মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য বোধগম্য, কারণ এটা বিজ্ঞানের সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ এর বৈশিষ্ট্যকে একটা ছকে ফেলা যায়। এই সূত্রসমূহ বা ছক কী রকমের? গাণিতিক ভাষায় প্রকাশকৃত প্রথম বলটি হচ্ছে মহাকর্ষ। ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে বলা হয়েছে যে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করে এবং এই মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বস্তুটির ভরের সমানুপাতিক।
এই তত্ত্ব তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কারণ এই প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট ছকের রূপরেখা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হলো, যাকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হল। পঞ্চাশ বছর আগে গ্যালিলিও প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির যে একটি সূত্র আছে তা উদ্ভাবনের জন্য দোষি সাব্যস্ত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন।
উদাহরণ স্বরূপ, বাইবেলের একটি গল্পে আছে, যশুয়া সূর্য ও চাঁদকে তাদের কক্ষপথে পরিক্রমণ বন্ধ করার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, যাতে কানানের এ্যামোরাইটদের সাথে দিবালোকের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করতে পারেন। যশুয়ার পুস্তক অনুযায়ী, সূর্য একদিনের জন্য স্থির ছিল। আজকের দিনে আমরা জানি যে, এর অর্থ পৃথিবী তার কক্ষপথে পরিভ্রমণ বন্ধ করে স্থির ছিল। যদি পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করতো, নিউটনের সূত্র অনুযায়ী আমাদেরকে এক কঠিন মূল্য শোধ করতে হত- কারণ যা কিছু পৃথিবীর সাথে বাঁধা নেই, তা গতিজড়তার ফলে পৃথিবীর মূল গতিতে (নিরক্ষরেখা বরাবর ঘণ্টায় ১১০০ মাইল বেগে) চলতে থাকতো।
এই সূত্র দেরিতে সূর্যাস্তের সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে এই ধারণা কিন্তু নিউটনের বিচলিত করেনি। কারণ আমরা জানি, নিউটন বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর মহাবিশ্বের কার্যকলাপের ভেতর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখেন এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগ করেও থাকেন।
এর পরের ধাপ হলো, মহাবিশ্বের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের তত্ত্বের আবিষ্কার। এ দুটি বল মহাকর্ষ বলের মতোই আচরণ করে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল দুটি একই রকম বৈদ্যুতিক বা চুম্বকীয় চার্জ একটি অপরটিকে বিকর্ষণ করে।
আবার বিপরীতধর্মী চার্জ বা বিপরীত মেরুর চুম্বক একটি অপটিকে আকর্ষণ করে। বিদ্যুৎ বা চৌম্বক বল মহাকর্ষ বলের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমরা এটা অনুভব করি না কারণ, একটি বড় বস্তু প্রায় সমপরিমাণ ঋণাত্বক ও ধনাত্বক চার্জ দ্বারা গঠিত। এর অর্থ হলো, বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় বল দুটি বড় বস্তুর মধ্যে একটি অপরটিকে প্রায় বিনাশ করে। এটা কিন্তু মহাকর্ষ বলের বিপরীত ধর্ম- যা কেবল আকর্ষক বল এবং যোগ হয়।
বিদ্যুৎ এবং চুম্বকবিদ্যার আমাদের বর্তমান জ্ঞান অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ গত প্রায় একশত বছরের ভেতর আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সময়কালে বিভিন্ন দেশের পদার্থবিদগণ বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকীয় বল নিয়ে প্রচুর গবেষণা করছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার হলো এই যে, বৈদ্যুতিক চার্জ চুম্বকের উপর বল সৃষ্টি করে এবং একটি চলমান চুম্বক বৈদ্যুতিক চার্জের উপর প্রভাব রাখে। ওলন্দাজ পদার্থবিদ হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড এটা প্রথম আবিষ্কার করেন।
১৮২০ সালে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার প্রাক্কালে তিনি দেখলেন যে একটি ব্যাটারি থেকে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক কারেন্ট কাছাকাছি একটি কম্পাসের কাঁটাকে সরাচ্ছে। তিনি এটার নাম দিলেন ‘তড়িৎচুম্বকীয়’ বল। এর কয়েক বছর ইংরেজ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে যুগোপযোগী করে বললেন যে, যদি বিদ্যুৎশক্তি চুম্বকবলের সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে চৌম্বক বলেরও বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা উচিত। তিনি এটা ১৮৩১ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখালেন। চৌদ্দ বছর পর তড়িৎচুম্বকীয় বল ও আলোর ভেতর সম্পর্ক ফ্যারাডে আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখালেন তীব্র চুম্বকবল পোলারিত আলোর বৈশিষ্ট্যে প্রভাব ফেলে।
ফ্যারাডের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই কম ছিল। লন্ডনের কাছে দরিদ্র কর্মচারির পরিবারে তার জন্ম এবং মাত্র তের বছর বয়সে উদ্দেশ্যহীন স্কুলত্যাগী এক বালক, যিনি একটি বই বাঁধাইকারী দোকানে বাঁধাইয়ের কাজ শুরু করেন। সেখানে কয়েকবছর কাজের মধ্যে তার রক্ষণাবেক্ষণের বইগুলি থেকে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হন।
অবসর সময়ে তিনি সাধারণ মানের সহজ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিখ্যাত রসায়নবিদ স্যার হামফ্রে ডেভীর পরীক্ষাগারে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। জীবনের বাকি ৪৫ বছর তিনি সেখানে নিযুক্ত ছিলেন। ডেভীর মৃত্যুর পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। ফ্যারাডে গণিতশাস্ত্রে দূর্বল ছিলেন। এটা শেখার সুযোগ তিনি পাননি, অতএব তড়িৎ চুম্বকীয় ধর্মের যে নমুনা তিনি ল্যাবরেটরিতে দেখেছেন, সেটার তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা তার জন্য কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও, তিনি তা করেছিলেন।
ফ্যারাডের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল বলের ক্ষেত্র সম্পর্কিত ধারণা। আজকের দিনে বই এবং সিনেমার কল্যাণে ভয়ংকর চোখবিশিষ্ট ভিনগ্রহের প্রাণী এবং তাদের নভোযান সম্পর্কে আমরা সবাই পরিচিত, সে হিসাবে ফ্যারাডের রয়ালিটি পাওয়া উচিত।
সেই শতাব্দিতে নিউটন এবং ফ্যারাডের মধ্যবর্তী সময়ে পদার্থবিদ্যার বড় মাপের অবাক করা আবিষ্কার হলো দুটি বস্তুর শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে কোনো বলের প্রভাবে বস্তু দুটিকে প্রভাবিত করা। ফ্যারাডে এরকম ধারণাকে, যৌক্তিক মনে করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো বস্তুকে সরাতে হলে কোনো কিছুকে ঐ বস্তুর সংস্পর্শে আসতে হবে। তিনি কল্পনা করলেন যে, বৈদ্যুতিক চার্জ এবং চুম্বকের ভেতর শূন্যস্থান অদৃশ্য দ্বারা পূর্ণ, যা ধাক্কা ও টান দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করে।
ফ্যারাডে এই টিউবগুলিকে বলের ক্ষেত্র বলে অভিহিত করলেন। এই বলের ক্ষেত্র প্রমাণের উৎকৃষ্ট প্রমাণ হল একটি দন্ড চুম্বকের উপর একটি কাঁচের প্লেট রেখে তার উপর লোহার গুড়া ছড়িয়ে দেয়া। কিছুটা নড়াচড়া করে লোহার গুড়াগুলো অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে বৃত্তের চাপের মতো দন্ড চুম্বকের এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে একটি সুদৃশ্য প্যাটার্ন তৈরি করে। এই প্যাটার্ন হল অদৃশ্য চুম্বকবল, যা শূন্যস্থান ভেদ করে সৃষ্টি হয়েছে। আজকের দিনে আমরা জানি যে সমস্ত বলই ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। অতএব এটা আধুনিক বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ধারণা এবং একই সাথে বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনীর মূল ভিত্তি।
বইয়ের তথ্য: জীবনের চূড়ান্ত জিজ্ঞাসার নতুন সমাধান: দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন – স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লডিনাও। অনুবাদ করেছেন নূর মোহাম্মদ কামু এবং ড. গোলাম মোরশেদ খান। প্রকাশিত হয়েছে সন্দেশ প্রকাশনী থেকে
বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক