সিলেট: শত শত বছর আগে দিল্লি থেকে সিলেটে আসে জালালি কবুতর। এখন সারাদিন ঝাঁকে ঝাঁকে সিলেটের আকাশে উড়ছে শাহজালালের স্মৃতিধন্য এই কবুতর।
১৩০৩ সালে একজোড়া কবুতর দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলেন হযরত শাহজালাল (র.)। সিলেট ও এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলেরই বংশধর। এগুলোকেই জালালি কবুতর বলে অভিহিত করা হয়।
যত দূরেই যাক না কেন ঘুরে ফিরে আবার শাহজালালের মাজারেই চলে আসে এই জালালি কবুতররা। জালালি কবুতরের ওপর গবেষণা করে এমনটিই খুঁজে পেয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের তরুণ প্রভাষক ডা. নয়ন ভৌমিক। বাংলাদেশে জালালি কবুতর নিয়ে তিনিই একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন।
গবেষণায় তিনি দেখতে পেয়েছেন, জালালি কবুতরের স্ত্রী ও পুরুষ যুগলের মধ্যকার বন্ধন অন্য যেকোন প্রজাতির কবুতরের চেয়ে অনেক দৃঢ়। শুধু তাই নয়, জালালি কবুতর নিজস্ব প্রজাতির সঙ্গী ছাড়া অন্য কোনো কবুতরের সঙ্গে মিলিত হয় না।
ইতিহাস অনুযায়ী, সিলেটে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল (র.) ১৩০১ সালে যখন দিল্লী পৌঁছান তখন তার আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (র.) তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। বিদায়ের সময় নিজামুদ্দিন আউলিয়া শাহজালালের হাতে নীল এবং কালো রংয়ের একজোড়া কবুতর তুলে দেন। হযরত শাহ্জালাল (র.) ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে ১৩০৩ সালে তৎকালীন আসামের অর্ন্তভুক্ত সিলেট (শ্রীহট্ট) জয় করেন। এরপর তিনি এই কবুতর জোড়া আকাশে ছেড়ে দেন। সেই থেকে বংশবিস্তার করে সিলেটের মাজার এলাকায় এখনও জালালি কবুতরের বসবাস।
জানা গেছে, একমাত্র সিলেটে ও ভারতের দিল্লিতে এ ধরনের কবুতর দেখা যায়। সিলেটের ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাচীনকাল থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে জালালি কবুতর। পর্যটকদের কাছেও এই কবুতর বেশ আকর্ষণীয়। সিলেটে আসামের আদলে নির্মিত টিনের বাসাবাড়িতে চালে এখনও ভিড় করে জালালি কবুতরের দল। মাজার এলাকায় দিনভর জালালি কবুতরের ওড়াওড়ি যে কারও মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের তরুণ প্রভাষক ডা. নয়ন ভৌমিক জানান, জালালি কবুতরের মাথা ছোট ও গোলাকার। সামনের দিকে ছোট ঠোঁট রয়েছে। জালালি কবুতরের গায়ের রঙ ধূসর নীল এবং দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। ঠোঁটের রঙ ধূসর কালো। চোখের আইলিডের রঙও ধূসর।
ডা. নয়ন ভৌমিক বলেন, মাত্র ৩০ দিন বয়সের জালালি কবুতরের ওজন প্রায় ২৩৭.২০ গ্রাম। আর প্রাপ্তবয়স্ক কবুতরের ওজন প্রায় ৫০০-৬০০ গ্রাম। পুরুষ কবুতর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৪.১৮ সেমি. এবং স্ত্রী কবুতর ৩২.৩৮ সেমি.। পুরুষ কবুতরের মাথার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩.৭৪ সেমি. এবং স্ত্রী কবুতর ৩.৫৮ সেমি.। জালালি কবুতরের ডিমের ওজন ১৬.১৮ গ্রাম, র্দৈঘ্য প্রায় ৩.৭৫ সেমি. এবং প্রস্থ ২.৮১ সেমি.। জালালি কবুতর ৫ থেকে ১০ বছর বেঁচে থাকে।
তিনি বলেন, পাখি শুমারি হলেও জালালি কবুতরের সংখ্যা কত এরকম শুমারি এখন পর্যন্ত হয়নি। সিলেটে আগে অনেক জায়গায় জালালি কবুতরের অবাধ বিচরণ দেখা গেলেও এখন তা কমে এসেছে। তবে দিন দিন কমে আসছে জালালি কবুতরের সংখ্যাও।
সিলেটের সম্পদ জালালি কবুতরের জীবনচক্র ও শুমারির উদ্যোগের কথা জানিয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার।
প্রাধিকারের সভাপতি রাহুল দাস তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘জালালি কবুতর যেমন মাজারের সৌন্দর্যবর্ধক তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। মানুষের আহারের তালিকায় যেন এই কবুতর না আসতে পারে সেজন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। জালালি কবুতর সংরক্ষণের মাধ্যমে আমাদের প্রাণীর অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৩
এসএ/সম্পাদনা: বেনু সূত্রধর ও রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর