সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) আবদুল মান্নান বীর বিক্রম থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। পোস্টিং ছিল রংপুরে।
মেজর জিয়ার সহযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তিনি জিয়াকে দেখেছেন কাছে থেকে। অনেক ইতিহাসেরও সাক্ষী তিনি। যুদ্ধ বিষয় বিশ্লেষণ করার সুযোগ এবং ইতিহাসের অনুষঙ্গ অনেক কিছ্ইু পাওয়া যেতে পারে আবদুল মান্নান বীর বিক্রমের যুদ্ধস্মৃতি থেকে।
তিনি বলেন, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহিরা ষোলশহরের রাস্তা ব্লক করে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ১৬ বেলুচ রেজিমেন্টের অস্ত্র বোঝাই গাড়িগুলো যাতে ঢুকতে না পারে। সেজন্য তারা স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দু দিকে দুটি রেলের বগি রেখে দিয়েছিলেন। বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলের বগিগুলো কেটে তারপর অস্ত্রবোঝাই গাড়িগুলো পার করে নেয়। কিন্তু তাদের রক্ত টগবগ করার পরও নির্দেশ না পাওয়ার কারণে সেখানে বেলুচ সৈন্যদের প্রতিহত করার উদ্দেশে গুলি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাঙালি টুআইসি তাদের নির্দেশ দেবেন এমনটাই চাইছিলেন তারা। কিন্তু বাঙালি টুআইসি জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের গুলি করার জন্য তাদের কোনো নির্দেশই দিলেন না।
এতে করে সৈন্যদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা দ্বিধায় পড়ে যান। সে সময় তাদের কানে আসে আওয়ামী লীগের নেতা হান্নান সাহেবের কথা। আবদুল মান্নান গেলেন হান্নান সাহেবের কাছে। গিয়ে দিকনির্দেশনা চাইলেন। বললেন, বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা অস্ত্র নিয়ে চলে গেছে চোখের সামনে দিয়ে। শুধু একটি নির্দেশ পেলেই বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যদের একজনও সেখান থেকে ফেরত যেতে পারত না। কিন্তু তাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তখন হান্নান সাহেব বললেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। এবং এর পর থেকে জিয়াউর রহমান মাধ্যমেই সবকিছু তারা জানতে পারবেন।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে আবদুল মান্নান হেডকোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে অভ্যন্তরীণ বদলি হয়ে যান। তখনই তার সি কোম্পানিকে নির্দেশ দেওয়া হয় বন্দর যাওয়ার জন্য। সি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন বদিউল আলম। আবদুল মান্নান তাদের বলেছিলেন লক্ষণ খুব ভালো মনে হয় না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর নিয়ম মেনে চলতে চাইলেন। তখনো মনে করলেন উপ-অধিনায়ক যেহেতু বাঙালি, তাই নিশ্চয়ই তিনি কিছু একটা করবেন। কিন্তু উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান তখনো নির্লিপ্ত রইলেন। ফলে সি কোম্পানির সদস্যদের বন্দরে যেতে হলো। সেখানে যেতেই তারা গুলির মুখে পড়েন, যা ছিল তাদের কল্পনারও বাইরে। আসলে তাদের সেখানে নেওয়া হয়েছে গুলি করে হত্যা করার জন্যই। তারা সেখানে পৌঁছার আগেই গানবোটে অবস্থান করছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। যেই মুহূর্তে তারা সাগরপাড়ে পৌঁছান তখনই ব্রাশ ফায়ার করা হয় তাদের লক্ষ্য করে। কেউ বাঁচতে পারলেন না সেখানে। পুরো কোম্পানি শেষ হয়ে যায়। একমাত্র বদিউল আলম বন্দরে পৌঁছার আগে স্থান ত্যাগ করেছিলেন প্রাকৃতিক ডাকের কথা বলে। আর তিনি অদূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখলেন। সি কোম্পানিটি ছিল রংপুর থাকাকালে আবদুল মান্নানের অধীনে। এখানে আসার পরও দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার। ফলে শহীদ হওয়া সদস্যদের অনেককেই তিনি ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন। কিন্তু তাদের নাম মনে করতে পারছেন না এতদিন পর। দুজনের নাম মনে আছে। একজন আবু তাহের আরেকজন আবদুর রউফ।
সি কোম্পানির সব সদস্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডাক পড়ল বি কোম্পানির। বলা হলো বন্দরে যেতে হবে। রাত একটার সময় বদিউল আলম জিয়াউর রহমানকে মনে করিয়ে দিলেন এর আগে সি কোম্পানির সকল সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সুতরাং বি কোম্পানিকে পাঠানো ঠিক হবে না। কিন্তু আবদুর রশিদ জানজুয়া আবার নির্দেশ প্রদান করে। এবার জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে বাঙালি সৈনিকরা ঘটনার প্রতিকার চান। জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেন আর পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তিনি যান আবদুর রশিদ জানজুয়ার কাছে। জানজুয়া তাকে দেখে ক্ষেপে যায়। তাদের মধ্যে বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান তাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হন। সঙ্গে সঙ্গে মান্নানকে বলেন হাওয়ালদার আবদুল আজিজের মাধ্যমে যেন সব অবাঙালি অফিসারদের ডেকে আনা হয়। সঙ্গে যেন স্টেনগান থাকে। আবদুল মান্নান আবদুল আজিজকে সেই নির্দেশের কথা বলেন। তিনিও অবাঙালি অফিসারদের ডেকে আনেন। জানজুয়া মৃত্যু অবধারিত জেনে জিয়াউর রহমানকে বলেছিল, তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যেন দেখা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান তখন তাকে বলেছিলেন, তুমি যদি আমার সি কোম্পানির সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিতে পারো, তাহলে তোমাকেও তোমার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার সুযোগ দেবো। তুমি কি পারবে?
জানজুয়া বুঝতে পারেন তার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। তার মাথা নিচু হয়ে যায়। নতমাথাতেই জিয়াউর রহমানের ছোরা পিস্তলের একটি গুলি বিদ্ধ হয়। এটা মান্নানের স্থান ত্যাগ করার আগের ঘটনা। ঐ ঘটনা সামরিক বিধান অনুযায়ী ন্যায় কি অন্যায় সেটা বিবেচ্য নয়। এটা ছিল ঐ সময়ের জন্য অপরিহার্য। তখন বাঙালি সব সৈন্যই একাত্ম হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানি যত অফিসার ছিল তাদের সবাই সেখানে নিহত হয়। ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট গেলেন। কিন্তু সেদিন তিনি বেতারে কোনো ঘোষণা দেননি। আবার ফিরে আসেন। ঐ রাতটা কাটান গাড়িতেই। জিয়াউর রহমান ২৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এটা আবদুল মান্নান পরবর্তীকালে লোকমুখে শুনেছেন। তবে ২৬ তারিখে জিয়াউর রহমান কোনো ঘোষণা পাঠ করেননি এই তথ্য তিনি জোর দিয়েই বলেন। তার আগে হান্নান সাহেব তাকে অনুরোধ করার পর তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন এটা আপনাদেরই বলা উচিত।
এরপর আবদুল মান্নান কুমিরা স্টেশনে ডিফেন্সে পজিশন নেন। ২৭ তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে আসছিল। সেখানে বাধা পাওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী অস্বাভাবিক শক্তিতে আঘাত হানে। বাঙালির অস্ত্রসামগ্রী ছিল খুবই কম। ফলে বাঙালি সৈন্যরা পিছিয়ে যেতে থাকে। রোহন নামের একজন বাঙালি সেখানে শহীদ হন। তারপর যেতে হয় শুভপুর ব্রিজের কাছে। তাজুল ইসলাম, আবদুর রশিদ এমনি অনেক ছিলেন সঙ্গে। ব্রিজ আক্রমণ করার সময় ইপিআরের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। খাজা সাহেব সম্ভবত নাম। তিনি মর্টার ফায়ার দিচ্ছিলেন। উনার সাপোটির্ং ফায়ার পাওয়ার পর তাদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে পরাস্ত হয়। ঐ যুদ্ধে প্রায় ৩৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও সেখানে হতাহত হননি। পাকিস্তানিরা ছিল বাংকারের ভিতর। মূলত সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকারের কাছে চলে যান। আর গ্রেনেড মেরে মেরে তাদের পরাস্ত করা হয়। তখন ঐ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সাদেক অধিনায়কত্ব করেন। তবে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে আবদুল মান্নান অধিনায়কত্ব করেন। তিনি নিজেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংকারের কাছে গিয়ে গ্রেনেড মেরে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের পরাস্ত করেন।
ওখান থেকে সোজা ভারতে চলে যান। সেখানে কোম্পানি নিয়ে চলে যান হরিণা। প্রায় ৪০ জন ছিলেন তাঁরা। অনেকেই হাতের ঘড়ি এবং আংটি ইত্যাদি বিক্রি করে কিছু পয়সা নিয়ে নিজেরা ভাগাভাগি করে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য এটা ভারতে যাওয়ার আগের ঘটনা। সেখানে একবার একজন পুলিশ কর্মকর্তা গরু জবাই করে খাইয়েছিলেন। আরেকবার কলার ছড়ি দিয়েছিলেন কৃষকরা। সেই কাঁচা কলা খেয়েই যুদ্ধ করেছিলেন তারা।
হরিণায় দেখা হলো জিয়াউর রহমান, অলি আহমেদ, মীর শওকত আলী, মাহফুজুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে। সুবেদার মোতালেব সাহেব এবং আবদুল মান্নান চলে গেলেন গৌহাটি। সেখানে ব্যাটেলিয়ান পুনর্গঠন করেন। ওখান থেকে তিনি নিজ গ্রাম কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই চলে আসেন। এখানে এসে তিনি একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। আলী আজম খাঁর বাড়ির সামনের খেলার মাঠে সেই প্রশিক্ষণ হতো। সেই যুদ্ধে গ্রামের অনেক ছেলেকে ৮-১০ দিন করে প্রশিক্ষণ দিতেন।
ঐ সময় তিনি শালদানদী খাদ্যগুদামের সব খাবার তালা ভেঙ্গে বের করে নেন। সেগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। এরপর আবার তিনি গ্রামে আসেন। ২৫ জন তরুণকে নিয়ে তিনি আবার যান ভারতের বক্সনগরে। সঙ্গে নিয়ে যান একটি এমজি। এটি নেন ৬ মাইল পশ্চিমের এক গ্রাম হিরাপুর থেকে। সিদলাই গ্রামের রউফ মাস্টার সহযোগিতা করেন।
বক্সনগর ক্যাম্পের প্রধান অধ্যক্ষ আব্দুর রউফকে সেই এমজিটি দেন তিনি। তারপর গেলেন হরিণায়। সেখান থেকে তেলঢালায়। ওখানে জেড ফোর্সের সবাই যুক্ত হবে। এমনই কথা হয়। সেখানে ক্যাম্প সেট হয়। এখানে একমাস ট্রেনিং হলো। তারপর তিনি চলে আসেন ডিফেন্সে, হাজিরচরে। করম আলী ছিলেন থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের। গোটা জেড ফোর্স থার্ড বেঙ্গল সেখানে যাবে। শুধু আবদুল মান্নান তার কোম্পানি নিয়ে রয়ে গেলেন হাজিরচরে। এখানে সাপোটির্ং হিসেবে ভারতীয় বাহিনী আর্টিলারি ফায়ারের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু অল্প সৈনিক নিয়ে সেখানে টিকে থাকা কষ্টকর ছিল। হামিদুল্লাহ সাহেবকে জানানো হলো বিষয়টি। তিনি রৌমারী এলাকা থেকে কিছু সৈনিক পাঠালেন। বেঙ্গলের লোকজন ছাড়াও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরাও ছিলো। মেজর আবু তাহেরকে তিনি জানান তিনি ছালিয়ারচর দখল করতে চান। কৌশলগত কারণে ছালিয়ারচর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবু তাহের সাহেব বললেন, এটা খুবই কঠিন কাজ। সুতরাং সাবধানে পা ফেলতে হবে। জয়ী হতে পারলে খুবই ভালো হবে। ছালিয়ারচরে রেকি করে আসার জন্য নায়েক সুবেদার তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে চারজনকে পাঠান। স্থানীয় সহযোগীও ছিল তাদের মধ্যে। এরা রেকি করতে গিয়েই দুজন পাকিস্তানি সৈন্য মেরে আসে। ফলে যুদ্ধটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। আবদুল মান্নান মনে করেন তারপরও তিনি যুদ্ধ করবেন। এবং ঐ রাতেই।
সেই অনুযায়ী রাত ৩টার পর তিনি ছালিয়ারচরের দিকে রওনা হলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি যেতে যেতে কিছুটা অন্ধকার কেটে যায় রাতের। কিন্তু অতর্কিত হামলা মোকাবিলা করতে পাকিস্তানিদেরই অসুবিধা হচ্ছিল। একসময় ওদের কাছ থেকে গুলি আসা কমে যায়। আবদুল মান্নান বুঝতে পারেন তারা পিছু হটতে শুরু করেছে। সাপোর্টিং পার্টিকে তিনি সংকেত পাঠালেন মর্টার ফায়ার বন্ধ করার জন্য। তা নাহলে তাদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে তাঁর দল দ্রুত পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের কাছাকাছি চলে যেতে সক্ষম হয়। সেখানে গিয়ে তিনি স্পিডবোট লক্ষ করে একের পর এক গুলি চালাতে থাকেন। কিন্তু শেষ স্পিডবোটটিও একসময় তাদের গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। তারা একরাতের যুদ্ধেই ছালিয়ারচর দখল করেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর মৃত ও অর্ধমৃত ১১ জনকে পাওয়া গেলো সেখানে। এটা ছিল অক্টোবর মাসের ১ তারিখের ঘটনা। এই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেলো। সেখানে খাওয়াদাওয়ার কিছুটা অসুবিধা হলেও মনের সাহস ছিল।
ছালিয়ারচর দখল করার পর যেন জয়ের নেশায় পেয়ে বসে তাদের। সিদ্ধান্ত নিলেন চিলমারীও দখল করবেন। অস্ত্র লাগবে আরো। আবদুল মান্নান হামিদুল্লাহ সাহেবের কাছে অস্ত্র চাইলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে তখন তাকে সাতটি মেশিনগান সরবরাহ করা হয়। কিন্তু মেশিনগানগুলো কাজ করছিল না। খুবই বাজে লাগছিল তখন।
প্রচণ্ড গুলি আসছিল চিলমারী স্টেশনের দিক থেকে। পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে তখন। সহযোদ্ধা আবদুর রহিমকে বললেন আবদুল মান্নান, পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান পোস্টগুলো উড়িয়ে দিতে না পারলে কোনোভাবেই যুদ্ধে জয় লাভ করা সম্ভব হবে না। রহিম সানন্দে রাজি হলেন।
স্টেশনের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী। স্টেশনের উত্তর দিকে বাংকার। মুক্তিযোদ্ধারা স্টেশনের পশ্চিমে পানিতে। রহিমকে বলা হয়, তিনি পশ্চিম দিক থেকে রেললাইনের পাশ দিয়ে খাল দিয়ে ডুব দিতে দিতে চলে যাবেন একবারের বাংকারের কাছে। সেখানে পৌঁছে বাংকারের ভেতরে গ্রেনেড ছুড়বেন। বাংকারটি ছিল পাকা। তাই এই ঝুঁকি ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। গ্রেনেড নিয়ে বাংকারের কাছে গিয়ে গ্রেনেডটি ছুড়তে যাবেন, এমন সময় আরেকটু উত্তরের আরেকটি লাইট মেশিনগান পোস্টে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে দেখে ফেলে। যে মুহূর্তে রহিম গ্রেনেডটি বাংকারে ছুড়েছেন ঠিক ঐ সময়ই পাকিস্তানি বাহিনীর এলএমজির গুলি তার ওপর চলতে থাকে। রহিম সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। গুলি লাগে পেটে। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যায়।
দিনের আলোয় তাদের চোখের সামনে পড়ে যান আবদুল মান্নানরা। কিন্তু মান্নান অসম সাহসের সঙ্গে সেখানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকেন। দেখতে পান পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একসময় ওদের পক্ষ থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন, চিলমারী তাদের দখলে চলে এসেছে। কিন্তু তারপরও তাদের কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়। অত্যন্ত ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যান ক্যাম্পের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখেন যে পাকিস্তানি সৈন্যরা পানিতে ডুবে বেশ কিছু মারা গেছে। কিছু মরে আছে ডাঙ্গায় আর আহত হয়েও পড়ে আছে কিছু।
ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ধরা পড়লেন। ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তানিদের সহযোগী এই বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে ইতিপূর্বে আবদুল মান্নান চিঠি পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই অলি আহমদ তাতে সায় দেননি। চিঠি নিয়ে গিয়েছিল এক রাজাকার। নাম ছিল রবি। সেই রাজাকারকেও তার আগে একসময় আবদুল মান্নানের সহযোদ্ধারা গ্রেফতার করেছিল। রোষমানির চর ছিল তার বাড়ি। প্রতি রবিবার সে বাড়ি আসত। সেই রবিবারই মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে ফেলে। তারপর আবদুল মান্নান তাকে আহ্বান জানায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। তাকে বলা হয় সে যদি মুক্তিযোদ্ধা হতে চায় তাহলে তার সামনে সুযোগ আছে। আর যদি তা না হয় তাহলে তাকে মরতে হবে। যদি বেইমানি করে তাহলেও তার সব শেষ হবে। সে রাজি হলে তাকে প্রথম এসাইনমেন্ট দেওয়া হয় চিঠি অলি আহমদকে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করার। অলি আহমদকে লেখা সেই চিঠি রবিও সরাসরি নিয়ে যায়নি। সেই চিঠি দেওয়া হয় আব্দুস সালাম নামের আরেক রাজাকারকে। সে দেয় আরেকটি ছোট ছেলেকে। স্থানীয় সেই ছোট ছেলেটি সালাম কিংবা রবিকে আগে থেকে চিনত না। আর ছেলেটির হাত থেকে চিঠি নেয়ার সময় অলি আহমদও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অলি আহমদকে চিঠি মাধ্যমে বলা হয় যে, রৌমারী থানা দখল হয়ে গেছে। চিলমারী থানাও দখল হওয়ার পথে। তাই অলি আহমদ যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়।
পরবর্তীকালে আবদুস সালামের কাছ থেকে জানা যায়, অলি আহমদের হাতে সেই চিঠি পৌছানোর পর সে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিল। এবং কিছু সময় পর চিঠির বাহককে সে খোঁজাখুজি করছিল। এক পর্যায়ে সে চিঠিটি পা দিয়ে মাড়িয়েছিল।
আবদুল মান্নান সেই থেকে প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, যে কোনো উপায়ে হোক এই অলি আহমদকে যেন জীবিত ধরে আনা হয়। সেভাবেই তারা তাকে ধরে নিয়ে আসে। তখন তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ছিল আবদুল মান্নানের অধীনে। চিলমারী এবং রৌমারী থেকে ৩৬৪ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় তারা কে কে যুদ্ধে যোগ দিতে চায়। ২০ জনকে পাওয়া যায় যারা যুদ্ধে যেতে চায়নি। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিরা তখন আবদুল মান্নানের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করে।
সেই যুদ্ধে চান নামের একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। চিলমারী দখল করার পর সেখানে মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ খান এবং মেজর আবু তাহের আসেন। তাদের পরামর্শে আবদুল মান্নান ভারতে রওনা হন। কিন্তু কামালপুর যাওয়ার পর সেখানে যুদ্ধ করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আবদুল মান্নানের রানার এসে খবর দেয়। ঐ এলাকার দুটি মেয়েকে নিয়ে গেছে সৈন্যরা। তারা গ্রামের একটি স্কুলে সৈন্যরা ক্যাম্প করেছে।
গ্রামের মেয়ে ধরে নিয়ে গেছে খবর শোনার পর আবদুল মান্নানের মাথায় রক্ত ওঠে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য রওনা হন। কয়েকজন আবদুল মান্নানকে বলেন শেষ রাতের দিকে যেন আক্রমণ করা হয়। কিন্তু মান্নান বলেন, মেয়ে দুটোর ইজ্জত নষ্ট হওয়ার আগেই পাকিস্তানিদের ঘায়েল করতে হবে। মেয়েদের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। এলোপাতাড়ি গুলি চালান সেই ক্যাম্প তাক করে। এক পর্যায়ে একবারে স্কুলের কাছে চলে যান আবদুল মান্নানের বাহিনী। ততক্ষণে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি ফুরিয়ে যায়। অসহায়ের মতো তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তখন অস্বাভাবিক প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, কোনোমতেই মেয়ে দুটোর গায়ে যেন পাকিস্তানি বাহিনী হাত দিতে না পারে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের বেয়নেট চার্জ করে অপকর্মের বিচার সমাধান করে।
এরপর জেনারেল ওসমানী সাহেবের নির্দেশে আবদু মান্নানের কোম্পানিকে গৌহাটি চলে যেতে হয়। ঈদের আগের দিন তারা চলে যান বড়লেখা চা বাগানে। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করতে গিয়ে নিজেরাই আক্রমণে পড়েন। আক্রমণে পড়েন রেকি করতে গিয়ে। ঐ সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলে। চোখের সামনেই এসে পড়ে তারা। কমলা বাগানের মাঝে গিয়ে তারা আশ্রয় নেন। সেখান থেকে কোনোমতে একটি খালের ভিতর দিয়ে চলে যান হেডকোয়ার্টারে। এসব জানার পর মুক্তিযোদ্ধারা সব অস্থির হয়ে পড়েন ফায়ার ওপেন করার জন্য। কারণ তারাও দেখতে পেয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনী পাহাড়ের কাছাকাছি চলে আসছে। কিন্তু মান্নান বললেন, একটু ধৈর্য ধরো। দেখবে তারা আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে। কারণ তাদের মোটেও ধারণা নেই যে, এত বেশি মুক্তিযোদ্ধা এখানে আছে। ওদের ধারণা যে কজন রেকি করতে গিয়েছিল তারাই বোধ হয় সেখানে আছে। আর তারা বাগানে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নেয়ার চেষ্টা করবে। সুতরাং তাদেরকে নাগালের মধ্যেই পাওয়া যাবে। শুধু অপেক্ষা করলেই হবে।
কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ধানক্ষেতের মধ্যে থাকতেই মুক্তিযোদ্ধারা একাক্রমে গুলি চালাতে থাকে। পঙ্গপালের মতো সেখানে মারা পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। অন্তত ২৮ জন শেষ হয়ে যায় সেখানে। একটি টিলায় তাদের মাটি চাপা দেওয়া হয়।
তার পর আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয় শমসেরনগর বিমানবন্দর দখল করার লক্ষ্যে। সকাল বেলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তারা। জঙ্গলে ভরপুর সেই রাস্তা। শমসেরনগরের কাছে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হন। সেখানেও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সব সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তাদের মারা হয়নি। প্রত্যেককে ভারতীয় বাহিনীর হাতে সমর্পণ করা হয়। কমলগঞ্জের কিছু এলাকায় তখনো পাকিস্তানি বাহিনী ছিল। শমসেরনগর থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর আসা-যাওয়া বাধাগ্রস্ত করতে হলে তাদের এখান থেকে উৎখাত করতে হবে।
সারারাত সেখানে বাংকার তৈরি করা হয়। কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা অনাহারে। সকালে জিয়াউর রহমান আসেন। তখন জিয়াউর রহমানকে বলেন, ছেলেরা ক্ষুধায় অস্থির হয়ে গেছে। তিনি যেন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। কিছু সাতকরা ছিল মান্নান সাহেবের কাছে। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনাহারে রেখে সেগুলো খেতে পারলেন না। দিনের শুরুতে ভারত থেকে কিছু চিড়া আসে। সেগুলো তাড়াতাড়ি ছেলেদের দিয়ে তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
কিছু খাওয়ার পর জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার হলেও মুক্তিযোদ্ধারা পিছপা হলো না। কিছু সময়ের যুদ্ধের পর স্থানীয় থানা দখল করে নেন মান্নানের বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু একটি গুলি লাগে আবদুল মান্নানের গায়ে। আবদুস সালাম (ইতিপূর্বে যে রাজাকার ছিল) আবদুল মান্নানকে ধরে নিয়ে যায় এম্বুলেন্সের কাছে। তাড়াতাড়ি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আগরতলা হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। তারপর নেয়া হয় কলকাতা। সেখান থেকে লক্ষেœৗ। ওখানে ছিলেন বেশ কিছুদিন। ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। চিকিৎসা শেষে অনেক কষ্টে চলে আসেন নিজের বাড়ি। কয়েকদিন থাকার পর শ্রীমঙ্গল যান তিনি। সেখানে জিয়াউর রহমান তাকে পেয়ে খুশি হলেন।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য : বীর বিক্রম এই মুক্তিযোদ্ধা এখন বাস্তুহারা। দৈনিক কালের কণ্ঠে এই বীর যোদ্ধার দীনদশা সম্পর্র্কে লেখা প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভূমি সচিবকে নির্দেশ প্রদান করা হয় তাকে জমির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। যার অনুলিপি জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকেও দেওয়া হয়। কিন্তু বিজয় দিবস ২০১০ পর্যন্ত তিনি কোনো জমি কিংবা ঘর পাননি। ২৬০০ টাকা মাসিক পেনসন লাভকারী আব্দুল মান্নান নিজ গ্রামের একটি বাড়িতে এখন ভাড়া থাকেন। তাঁর বর্তমান আত্মউপলব্ধি- বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তিনি চাকরি হারিয়ে এখন সর্বহারা। বঙ্গবন্ধুর দল মতায় আসার পরও কি তিনি একটা ঠিকানা পাবেন না?]
বাংলাদেশ সময় ২৩০০, ডিসেম্বর ২০, ২০১০