ঢাকা: ভারতের সিমলা শহরে তিন রাত কাটানোর পরে ভাবলাম, এবার তাহলে কোথায় যাওয়া যায়? বন্ধু শাকিব চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, তিব্বতের কাছাকাছি কোনো এক শহরে যাওয়ার।
সিমলা ম্যালে বসে খাচ্ছি, ওখানেই পরিচয় হলো ত্রিলোক নামে এক যুবকের সঙ্গে।
ত্রিলোকের সঙ্গে বেশ ভাব জমালাম। ম্যালে বসে কফি পান করলাম তিনজনে মিলে। শুধুই পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে এক আনন্দের পরশ খুঁজে পেলাম। ত্রিলোক বলল, চলুন দূরে কোথাও বেড়াতে যাই। শাকিব চৌধুরী জিজ্ঞেস করল, তিব্বত এখান থেকে কত দূরে?
ত্রিলোক বলল, কল্পা নামে একটি শহর আছে। ওখান থেকে তিব্বত খুব কাছে। কল্পায় যা-যা চাইবেন ওখানে গেলে তা-ই মিলে যাবে...। শাকিব জানতে চাইল, ওখানে গিয়ে কি নাচ-গান দেখা যাবে? কথাটা শুনে ত্রিলোক একটু হেসে বলে—কল্পায় কী না আছে!
রূপসীদের মাদলের তালে তালে বৃদ্ধরাও নাচে। ওখানে গেলে সবাই নাচে। ত্রিলোকের মুখেই শুনলাম, কল্পাকেই বলা হয় কিন্নরিদের দেশ। কিন্নর ভারত সীমান্তের শেষ ভূখণ্ড।
হিমাচল প্রদেশের অন্যতম জেলা কল্পা। ওপারে তিব্বত। পরের দিন বাসযোগে আমি, শাকিব চৌধুরী এবং ত্রিলোক রওনা হলাম কল্পার উদ্দেশ্যে। কুফরি, নারকাও, রামপুর, জিওরি অনেক বাস স্টপেজ হয়ে বিকেলের দিকে পৌঁছলাম কল্পায়। আসার পথে দেখলাম, প্রশস্ত পথ।
ত্রিলোকই বলল, সীমান্ত রক্ষার কারণে এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে প্রশস্ত পথ। সারহান কিন্নরের প্রধান ফটক। এই সারহানই স্বর্গের দেশ। এখান থেকেই কিন্নর জেলার শুরু। তাছাড়া আছে হিমাচল প্রদেশ পর্যটনের মোটেল শ্রীখণ্ড। ওখানে ঘরের জানালা খুললেই সারা হিমাচল হাজির।
হাজির দূরের কৈলাস পর্বত। ত্রিলোকের মুখে আরও শুনলাম, সমগ্র হিমাচলই যেন মহাদেবের আবাসভূমি।
কল্পায় পৌঁছার আগেই ‘সারহান’ জায়গাটি দেখেনিলাম। কল্পায় এসে উঠলাম আকটাং গেস্ট হাউসে।
এক রুমে দু’টি বেড, দু’টি বেড এক করে তিনজনে রাত পার করলাম। পরদিন সন্ধ্যার পরে এলাম কিন্নরিদের পাড়ায়। নাচে-গানে মাতোয়ারা ওখানের সবাই। ঢোল বাজছে, এক তরুণী গান গাইছে—কিন্নরি ভাষায় আর কিন্নরি তরুণীরা নেচেই চলছে।
যারা ওখানে বসে আছে, দেখলাম সবাই শরাব গিলছে। নাচনেওয়ালি মেয়েদের হাতে টাকাও তুলে দিচ্ছে ওরা। একটু পরে দেখলাম অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে নেচে নেচে গাইতে শুরু করল—মেরা নাম চিন চিন চু...।
অবাক না হয়ে কি পারা যায়? অপরূপ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে মনে মনে ভাবলাম, বাহ! এতো রূপসী, এতো সুন্দরী! চট করে মনে হলো হেমা মালিনীর কথা।
এদিকে শাকিব চৌধুরী কানে কানে বলল—এ যে আরেক ঐশ্বর্য রায়। এরই মধ্যে আমাদের কাছেও শরাব এসে গেল। ত্রিলোক আমার হাতে গ্লাসটি দিয়ে বলল, নিন, খেয়ে নিন, মনে ভাল হবে। কথাটা শুনে কেমন জানি রোমাঞ্চিত হলাম।
ত্রিলোক জানালো, কিন্নরিদের ঘরে ঘরে আঙুর আর আপেল জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় শরাব। এই শরাব অর্থাৎ সুরা নিয়মিত পান করলে এর রসে শরীর থাকে তরতাজা, যৌবন হয় দীর্ঘস্থায়ী...। বৃদ্ধদেরও নাচতে দেখলাম।
কিন্নরি রূপসীরা নেচেই যাচ্ছে। মাদলের আওয়াজে গোটা এলাকা যেন মাতোয়ারা হয়ে আছে। কিছুতেই ওখান থেকে ফিরে আসতে মন চাইছিল না। ত্রিলোক বলল, এই কল্পা হলো কল্পনার দেশ। কল্পার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অনাবিল সৌন্দর্যের সম্ভার।
তুষার এবং সবুজের এমন নিবিড় সম্পর্ক ভারতের অন্যত্র বড়ই দুর্লভ। এখানে সবুজের মগ্নতায় যতটা মিশে আছে আরণ্যক গাছপালা, ততটাই আছে ফলদায়ী গাছের সমাবেশ। যত খুশি ফল খাওয়ায় কোনো আপত্তি নেই। নিয়ে আসা যাবে না।
কল্পাবাসী হলো কিন্নরি, এরা সদা হাস্যময়ী। সমাজব্যবস্থায় এরা মাতৃতান্ত্রিক। নাচ-গানের হুল্লোড় চলছে। এদিকে মিহি সুরের বাঁশি আর মাদলের তালে অরণ্য যেন কাঁপছে।
এখানে পাহাড় থেকে পাহাড়ে সুর ছড়ায়। নাচ-গানের সময়ই ভালো লাগা, তারপর একসময় কেউবা জীবনসাথীতে পরিণত হয়। কিন্নরি মহিলাদের একাধিক স্বামী থাকার সামাজিক স্বীকৃতিও আছে। এদের কথ্য ভাষা ‘কিন্নরি’।
কিন্তু স্কুলে হিন্দির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ভাঙা হিন্দি এখানকার অনেকেই বলতে পারে। ত্রিলোকই জানাল, প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয় এদের প্রিয় উত্সব ‘ফুলেখ’। ভারতীয় যে কোনো উত্সবের মতোই এই উত্সবে নজর কাড়ে চটকদার বেশভূষা। এরা সাজতে ভালোবাসে। গৃহস্থালি মহিলাদের পরিচর্যায় ঘরদোর থাকে ছিমছাম।
হোটেলে ফিরে এসে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল বেলা পৌনে ১১টায়। তখনও দেখি সূর্য ওঠেনি। জানালার ওখানে দাঁড়াতেই দেখি, হোটেল বয় রাকেশ। বলল, বাবু আজকে কল্পা শহরটি ঘুরে দেখবেন না।
ওর নাম রাকেশ—বাড়ি নবদ্বীপে। বাঙালি ছেলে রাকেশের বয়স ষোলো। ওর মুখে শুনলাম, এই কল্পাকে বলা হয় হিমাচলের শস্যভাণ্ডার। আঙুর, আপেলের বাগান মাইলের পর মাইল এলাকা নিয়ে।
এখানে উত্পন্ন হয় হিমাচলের বিখ্যাত সোনালি আপেল। এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে হিমালয়ের বরফঢাকা নানা শিখর। এখানে পাহাড়ের কোলে সারা দিন সারা রাত বসপার নদীর গান বেজে চলে অবিরামভাবে।
রাকেশের কথাগুলো শুনে ওকে ভীষণ ভালো লেগে গেল। বললাম, পরে এসো, তোমার সঙ্গে গল্প করব। ত্রিলোক বলল, ওর সঙ্গে কী গল্প করবেন? আমার কাছেই শুনুন, স্বর্গের খুব কাছের শহর এই কল্পা।
দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভায় যারা একদা নাচের আসর মাতোয়ারা রাখত, তারাই হলো কিন্নরি। এই কল্পাকে নিয়ে কত কাহিনী, কত লোককথা। এর তো শেষ নেই...। আমরা যেবার কল্পায় গিয়েছিলাম, সেবার এই কল্পা ছিল কিন্নরের জেলা সদর। পরে শুনেছি, কল্পা থেকে জেলার সদর দফতর স্থানান্তরিত হয় রেকংপিওতে।
কল্পা থেকে ফিরে এলাম সিমলায়। শাকিব চৌধুরী আর আমাকে এক হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে চলে গেল বাসায়। বলে গেল, সন্ধ্যায় আসছি। ২২১৩ মিটার উচ্চতায় সিমলা শহর। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা।
এখানে শহরের মধ্যস্থলে রয়েছে ম্যাল। দেখলাম, এই সিমলায় ব্রিটিশ আমলের নানা ভবনের ছড়াছড়ি। এখানে একটি চার্চও দেখলাম, এর নির্মাণকাল ১৮৫৭ সালে। চৌরা-ময়দানের মিউজিয়ামে দেখলাম, অজস্র পাহাড়ি শিল্পকর্ম, চিত্র ও মূর্তির সংগ্রহ।
পরদিন সকালে ত্রিলোকের সঙ্গে এলাম সিমলার সর্বোচ্চ বিন্দু জাখু পাহাড়ে। এর শীর্ষে উঠে আমরা তিনজনে তুষারাচ্ছাদিত হিমালয়ের বুকে সূর্যোদয়ের আশ্চর্য বর্ণচ্ছটা উপভোগ করলাম।
নিচের শহর থেকে এই চূড়ার উচ্চতা ২৪২ মিটার তো হবেই। সিমলার কাছেই আরও দু’টি মনোরম পাহাড় চূড়া হলো সামার হিল ও প্রম্পোট হিল। এ দু’টিও কাছ থেকে দেখে নিলাম। কালীবাড়ি দেখার পরে এলাম ইংরেজ ভাইসরয়ের সেই বাসস্থান দেখতে। এবার ত্রিলোক বলল, চলুন এককালের চিত্রনায়ক মতিলালের বাড়ি দেখবেন।
এটি দেখে মনে হলো, জৌলুস হারাতে বসেছে এই বাড়িটি। তবুও আনন্দ এই যে, শাদি, পরদেশি, তকদির, এক থি লাড়কি ছবির খ্যাতনামা নায়ক মতিলালের বাড়িটি তো দেখলাম। ত্রিলোক জানালো, চিত্রনায়ক মতিলাল মারা যান ১৯৬৫ সালের ৪ ডিসেম্বর।
কীভাবে যাবেন শিমলা ও কল্পায়-
কলকাতার হাওড়া থেকে উপাসনা এক্সপ্রেসে দেরাদুনে গিয়ে এর পর বাস ধরে সিমলায় যেতে পারেন। উপাসনা এক্সপ্রেস ছাড়ে বেলা ১টায়। এটি পরদিন সন্ধ্যা ৭টায় দেরাদুনে গিয়ে পৌঁছে। দেরাদুন থেকে সড়কপথে বাস সিমলায় পৌঁছাতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। সিমলা থেকে বাস ধরে কল্পায় যেতে সময় লাগে ৯ ঘণ্টা। সিমলায় থাকার জন্য বিভিন্ন মানের ও দামের হোটেল রয়েছে। যেমন—মহামায়া, রিজেন্সি, হোটেল অ্যাম্বার, হোটেল ডালজিল, হোটেল পানভিউ, হোটেল ভিক্টরি বিবিধ।
কল্পায় রয়েছে হোটেল শিবালিক। এখানে দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল কিন্নর কৈলাসে দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া দৈনিক এক হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার টাকা।
বাংলাদেশ সময় : ১১৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর, কো-অর্ডিনেশন