স্মার্ট কার্ডের সুখ্যাতি আর ব্যবহার এখন দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এটিএম বা মোবাইল ফোনের সিম কার্ডকেই ‘স্মার্ট কার্ড’ বলে।
এ অসাধারণ উদ্ভাবনের পেছনে অনেকেরই অবদান আছে। প্রথম ১৯৬৮ সালে জার্মান দুই বিজ্ঞানী অটোমেটেড চিপ কার্ড উদ্ভাবন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। তখন বলা হচ্ছিল এটি বিশ্বের অন্যতম আবিষ্কারের একটি। এটি হলো ইতিহাস।
কে জানতো তখনও অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়ের। রোল্যান্ড মরিনো নামে ফ্রান্সের এক প্রকৌশলী নিয়ে আসলেন মেমোরি কার্ডের আইডিয়া। অর্থাৎ জার্মান বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন রোল্যান্ড।
রোল্যান্ড মেরিনোর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১১ জুন ইজিপটে। তরুণ বয়সেই রোল্যান্ডের পরিবার ফ্রান্সে চলে আসেন। সেখানে স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু পড়াশুনায় একদম আগ্রহ নেই। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো আর আড্ডা দেওয়াই ছিল তার নেশা।
এ বিষয়ে রোল্যান্ড বলেন, আমি যা শিখেছি নিজেই শিখেছি। কেউ আমাকে শিখিয়ে দেয়নি। আমি তো মনে করি এ বিশ্বে নিজে নিজে শেখার মত যথেষ্ট বিষয় আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সব শিখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
রোল্যান্ড একাধারে উদ্ভাবক, গবেষক, লেখক এবং কৌতুকার। মজার বিষয় হচ্ছে পড়াশুনা ছেড়ে রোল্যান্ড জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্রান্সের একটি সংবাদনির্ভর ম্যাগাজিনের রিপোর্টার ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ১৯৭০-১৯৭২ সাল পর্যন্ত রোল্যান্ড ফ্রান্সের ক্যামিস্ট্রি ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন।
বহুবিধ প্রতিভার অধিকারি রোল্যান্ড হুট করেই সাংবাদিকতা ছেড়ে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটি ‘ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রোপার্টি’ নিয়ে কাজ করত। তিনি ডিকশনারির জন্য তৈরি সফটওয়্যারকে বাজারজাত করে সফলতা দেখিয়েছিলেন।
নিজের উদ্ভাবন ‘স্মার্ট চিপ’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রোল্যান্ড বলেন, খুবই অলস ছিলাম আমি। সময় পেলেই ঘুমাতাম। একটি আধো-ঘুমে হুট করেই মাথায় এ ধরনের একটি চিন্তা আসে। সঙ্গে সঙ্গে এটি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
রোল্যান্ড যখন স্মার্ট কার্ড তৈরি করেন তখন এর তথ্য পড়ার জন্য আলাদা একটি ডিভাইসও তৈরি করেন। কিন্তু সে সময় এ কার্ডটির গুরুত্ব কেউ বুঝতে পারেনি। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভাষাগত। এটি ইংরেজি ভাষা সমর্থন করতে পারত না। রোল্যান্ড খুব অল্প সময়ের মধ্যে একে ইংরেজি ভাষা সমর্থিত করে তোলে। কিন্তু তারপরও বড় বড় প্রযুক্তিবোদ্ধারা তার এ আইডিয়াকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে এ উদ্ভাবক তার উদ্ভাবনের গুরুত্ব কাউকে বোঝাতে না পেরে হতাশও হননি। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন প্রকৃত সময়ের।
অপেক্ষার ইতি আসে আট বছর পর। ফ্রান্স টেলিকম প্রথমবার ১৯৮৩ সালে ‘পে ফোন পেমেন্ট কার্ড’ হিসেবে রোল্যান্ডের উদ্ভাবনা কাজে লাগায়। এরপর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এরপর আধুনিক গ্রাহকেরা সব ধরনের তথ্য স্বল্প সময়ে কম্পিউটার ডাটাবেজে জমা হওয়ার সুফল বুঝতে শুরু করেন। এমনকি ব্যবহারকারীরাও এটি ব্যবহার করতে খুশি। এক বছর পরই ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের প্রতিটি ব্যাংক তাদের ‘ডেবিট কার্ড’ পদ্ধতি চালু করে। যেখানে মূল ভূমিকা রাখে ‘স্মার্ট কার্ড’। ফ্রান্সের গন্ডি ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে স্মার্ট কার্ড চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে। এখন পুরো বিশ্বের বাণিজ্যিক লেনদেনই এ ছোট্ট পণ্যের ওপর নির্ভর করে।
এ উদ্ভাবনের রয়্যালটির অর্থ দিয়েই বিশ্ব ধনীদের কাতারে চলে আসেন রোল্যান্ড। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী পাসপোর্ট সিস্টেম, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এটিএম কার্ডে তার এ উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য ফ্রান্সের জাতীয় নায়কে বনে যান রোল্যান্ড।
এ যুগান্তকারী উদ্ভাবনের জন্য ফ্রান্স সরকার রোল্যান্ডকে ২০০৯ সালে লিজেন্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অসাধারণ এ উদ্ভাবক ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল প্যারিসে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
অনুবাদ: শেরিফ সায়ার
বাংলাদেশ সময় ১৯৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর