দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে ফিরে: তখন মাঝদুপুর। সূর্য মাথার ওপরে খাঁড়া; কটকটে রোদ।
উত্তাল নয়, শান্ত পদ্মা। সেখানেই শৈশবের বাঁধভাঙা ঢেউ তোলে শিশুরা।
শরীরকে পাখি বানিয়ে উড়ে যেতে চায় আকাশে। শূন্যেই পুরো এক চক্কর ঘোরে সেই তামাটে রংয়ের শরীরগুলো। নদীর বুকে পড়া ছায়া ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। লিকলিকে দেহগুলো যেন কেউ ছেড়ে দেয় পানিতে সরল রৈখিকভাবে। পানি ছিটকে পড়ে বন্ধুর গায়ে। জাপটে ধরে পানিতে আরো ডুবাতে চায় একে অপরকে।
দুরন্ত শৈশব যেন বাঁধা যায় না! কার কথা শোনে সেই দুরন্তরা! প্রকৃতির কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছে তারা।
দৌলতদিয়া ঘাটে এনায়েতপুরী ফেরির ওপর থেকে সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমির ছবি তুলছিলেন। ক্যামেরা দেখে বাঁধনহারাদের ভেংচি বেড়ে যায়। ফেরিঘাটে বাঁধা মোটা লোহার তারকে সুইমিং পুলের রিং বানিয়ে ঝুলতে থাকে তিন শিশু।
এ দুরন্তপনায় কোনো পিছুটান নেই। নেই বড়দের শাসনের ভয়। যার গায়ে কাপড় নেই, সেই শৈশবকে আটকানো যে কষ্টসাধ্য, তা যে কেউ দেখেই বোঝে!
এ সময় স্কুল থেকে ফিরে, জোর করে বসে হোমওয়ার্কের ঝামেলা নেই; আর প্রাইভেট টিউটরের অত্যাচারে নির্যাতিত হওয়ার অর্থও নেই এ শৈশবের। কিন্তু, ক্যামেরায় বেশ বেগ পেতে হলো জীবন আমিরকে।
তিনজনের মধ্যে দু’জনের শরীরই উদোম। আরেকজনের পরনে যে গামছা, তা ডিগবাজি দিলে উন্মুক্ত হয়ে আসে। শৈশব এতে বাঁধা মানে না।
জীবন আমিরের ছবির জন্য তো আর শিশুদের উল্লাস থেমে থাকবে না! এ ছবি কোথায় ছাপা হবে, আদৌ হবে কিনা, ছবি কেমন হলো, এসব নিয়ে আগ্রহ থাকে বড়দের, আরো বেশি থাকে রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীদের। কিন্তু, সে বিষয়ে আগ্রহ নেই এই তিন শিশুর!
ফেরির ওপর দাঁড়িয়ে অনেক যাত্রীই দূর থেকে দেখছেন তিন শিশুর দুরন্তপনা। নিজেদের শৈশব হাতড়ে বেড়ান নদী পার হওয়া অনেকেই।
বিকেলে যখন রাজধানীতে ফিরে আসি, দেখা মেলে ইট, কংক্রিটের ফ্ল্যাটে বন্দি শৈশব। তাকে আড়ালে হাতছানি দিয়ে ডাকছে প্রকৃতির আলিঙ্গন। এ শিশুরা টকটকে ফর্সা, নাদুস-নুদুস। বড় হচ্ছে, বাবা-মায়ের আলিঙ্গনে। তবে তারা পাচ্ছে না সোনালি রোদের চিকমিক করা আলো, কালো-সাদা মেঘের ছায়া, রঙধনুর সাত রঙে ভিজে ওঠা অথবা নদীর অথৈ পানি!
দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলোর বারান্দা আর জানালায় যে শৈশব উঁকি দেয়, তাকে খুঁজে ফেরে উন্মুক্ত খেলার মাঠ, গাছের মগডাল-ছায়া, ফুল আর পাখির বাসার ছানারা।
কম্পিউটারের মনিটরে, মোটরসাইকেল, গাড়ি আর দুর্ধর্ষ সব যুদ্ধ হয়ে গেলেও, এ শৈশবের আকাশে ঘুড়ি ওড়ে না, ঘুরতে ঘুরতে হাতে উঠে যায় না লাটিম; দলবেঁধে কাদা পানিতে নামা নয়, বর্ষায় রেইনকোর্ট আর বইবোঝাই ব্যাগে লুকিয়ে থাকে শহরের শৈশব। দেওয়ালে দেওয়ালে আছড়ে পড়ে এ শৈশবের কান্না!
বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর