ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ঈদের আনন্দ: এখন এবং তখন

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৫৩, আগস্ট ৫, ২০১৩
ঈদের আনন্দ: এখন এবং তখন

ঈদের আনন্দে মেতে উঠছে দেশ। বছরে দুই ঈদের আনন্দকে ঘিরে চলে নানা আয়োজন।

এতো আয়োজনের ভেতরও অনেকেই নিজের শৈশবের ফেলা আসা স্মৃতির কথা মনে মনে ভাবেন।

সে সময়গুলোর স্মৃতি নিয়েই বলেছেন বাংলানিউজের পাঠক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। তাদের ঈদ আনন্দের এখন এবং তখনকার গল্প তুলে ধরা হলো।

কাজী রত্মা, মিডিয়া কর্মী
চাঁদ দেখা থেকে শুরু হয় ঈদ। চোখ ছোট ছোট করে দূরের চাঁদকে দেখা আর না দেখতে পারলে তারাকে চাঁদ বলে চালিয়ে দেয়ার মধ্যেই ঈদের আনন্দ ছিল। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি বিটিভিতে বাজানো মাত্রই ঈদের আনন্দের শুরু।

ছেলেবেলার ঈদ কম বেশি সবারই এক রকম। নতুন একটা জামা, এক জোড়া জুতা, কখনও ম্যাচিং করে ব্যাগ আর কানের দুল, মাথার ক্লিপ ইত্যাদি কেনা আর লুকিয়ে রাখা সব কিছু প্রায় কমবেশি একই রকম।

গত কয়েকদিন আগে ভাবছিলাম, ছোটবেলায় ঈদ কার্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আমাদের জীবনে। নিজের হাতে বানিয়ে বন্ধুদের কখনও আম্মু বা আব্বুকে দেয়া এক ধরনের অভ্যাস ছিল।

রাস্তার ধারে বসে যেসব ছেলেরা ঈদকার্ড বিক্রি করত আর জোরে জোরে গান বাজাতো, তখন মনে হত, আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে আমিও ওদের মত দোকান দিতাম।

কিন্তু তখন তা দেবার সামর্থ ছিল না, আর এখন সামর্থ থাকলেও ওই ইচ্ছাটা মরে গেছে। ইচ্ছার তালিকায় ছিল ফুলের দোকানও...

ঈদের দিনের সালামীর টাকা দিয়ে বাঁশি আর ফুল কেনা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়। ঈদের দিন স্কুলের পড়া থেকে ছুটি ছিল। বন্ধুরা সবাই মিলে এক রিকশায় চারজন করে চেনা রাস্তায় অচেনা ভেবে ঘুরে বেড়ানো এগুলোই ছিল আমার ঈদ।

আগে অন্তত ঈদের তিনদিন আগে বাবা যদি জামা না কিনে দিত তাহলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকাটা যেন ঈদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিত। আর এখন? সম্পূর্ণ বিপরীত।

ঈদের জামার জন্য এখন আর গাল ফোলানো হয় না। নিজের জন্য কেনার ইচ্ছাও হয় না। শুধুমাত্র পরিবারের কারও জন্য যদি কিনতে হয় তা হলেই মার্কেটে যাওযা।  

সেই মহা এক্সসাইটম্যান্ট নিয়ে ঈদের দিন ঘুরে বেড়ানো হয় না । ঈদ মানে এখন ছুটি। এ যেন শুধুই আমার ঘুমের দিন। যে কয়দিন ছুটি, শুধু ঘুম আর বিজ্ঞাপনের মাঝে একটু আধটু টিভি অনুষ্ঠান দেখা। এভাবেই কেটে যায় ঈদ আমার বড় বেলার।

Armanআরমান উল হক, মিউজিশিয়ান
ছোটবেলায় রোযার মাসে স্কুল বন্ধ দিলেই আমাদের ঈদ আনন্দ শুরু। নতুন জামা-কাপড়, জুতা কিনতাম। তবে কাউকে দেখাতাম না। মনে হতো কাউকে দেখলেই পুরান হয়ে যাবে। ঠিক করতাম ঈদের দিন কোন কাপড় কখন পড়বো সেটাও ঠিক করে রাখা হতো।

বিশেষ করে আগের রাতের কথা তো ভুলতেই পারি না। সারারাত বাসার সবাই মিলে গল্প করতাম। আড্ডা দিতাম। আর ঈদের দিন বাবা আর ভাইয়ের হাত ধরে দাদার সাথে নামায পড়তে যেতাম। সেখানে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হতো।

বড় কেউ আসলেই দৌড়ে যেতাম সালামীর জন্য। কচকচে টাকার নোট। মনে হতো খরচ করবো না জমিয়ে রাখবো।

ছোটবেলায় নিজে একা কেনার সাহস পেতাম না কখনও। ঈদের রাতে সবাই একসাথে বসে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতাম। ঘুমানোর আগে সারাদিন যা সালামি পেলাম তা গুণে বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতাম। ভাবতাম সকালে উঠলে হয়তো টাকাগুলো দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর আমার এই বিশ্বাস আমার বাবা-মা পুরণ করে দিত। এখন সেসব কথা মনে পড়লে একটা আনন্দের হাসি চলে আসে মুখে।
 
বড় হয়ে আসলে ঈদের দিন তাও ব্যাস্ততাই কেটে যায় কাজের মধ্যে। রোযার মাসটা খুব ভালো লাগে। চাকরির দিকে মানুষের ভিড়ে ইফতারি কেনা এবং অনেক সময় বন্ধুদের সাথে একসাথে ইফতারি করাটাও ঈদের দিনের মতো আনন্দ।

এখন আসলে খেয়ালও থাকেনা নিজের জন্য পাঞ্জাবি কেনা হলো কিনা। বাবা মা-ই বরং কিনে দেয় আমাকে। ঈদের দিন সকালে বাবা, ভাইয়া এবং দাদার সাথে নামায পড়েই স্টুডিও চলে যেতে হয়। কাজের জন্য।

এবার ঈদে একটু বেশিই চাপ বেশি কিছু টেলিফিল্মের মিউজিক করে দিচ্ছি। নিজেরও খারাপ লাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় যদি ছোটবেলায় ফিরে যেতে পারতাম! তাহলে হয়ত পরিবারের সাথেই সময়গুলো আনন্দে কেটে যেত। সন্ধ্যার দিকে একটু পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কাটানো হয় আর রাতে হয়তো ঢাকার বাইরে চলে যাই ঘুরতে। আর ঈদের সালামি!! বড় হওয়ার পর সালামি চাইতে চাইতে ক্লান্ত হয়ে যাই। কিন্তু তেমন একটা পাই না। আর এখন নিজেরই ছোটদের সালামি দিতে হয়। এটার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে।

tasfiতাশফী মাহমুদ, সংগঠক ও আলোকচিত্রী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
প্রতি বছর ঈদ আসে, সবার ব্যস্ত আর যাপিত জীবনে আনন্দের ছোঁয়া দিয়ে চলে যায়। তবে সময়ের স্রোতে ঈদ আনন্দ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এখনকার ঈদ হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণভাবে ফেসবুক আর অনলাইন কেন্দ্রীক। তবে ঈদের সেই ভাঁজভাঙ্গা নতুন জামা,  ঈদের দিনের সকালের সেমাই-ফি্ন্নি-চটপটি আর বড়দের কাছ থেকে পাওয়া ঈদ সালামির আবেদন কিন্তু এতটুকু কমে যাইনি এখনো।

আগের দিনের ঈদ মানেই জনপ্রিয় শিল্পীদের ঈদ উপলক্ষ্যে বের হওয়া নতুন গানের ক্যাসেট, একমাত্র টিভি বিনোদন ঈদের  রাতের মহাকাংখিত ‘আনন্দমেলা’।

চাদঁ রাতে আতশবাজির খেলা, কাউকে না দেখিয়ে ঈদের নতুন কাপড়কে  ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান মায়ের আলমারিতে’  স্বযত্নে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। কালেকালে এখন সেইসব পুরানো রীতিতে এসেছে পরিবর্তন।

দেশি-বিদেশি শিল্পীদের গান শুনতে আর নতুন ক্যাসেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। পাইরেসির বদৌলতে ইন্টারনেটের এক ক্লিকেই মনপছন্দ গান আর অ্যালবাম নামিয়ে নেওয়া যাচ্ছে যখন তখন। বিটিভির আনন্দ মেলাকে অনেক আগেই বিস্মৃতির অতলে ফেলে দিয়েছে দুই ডজনেরও বেশি দেশি বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেলের নজরকাড়া আর মনোমুগ্ধকর বিচিত্র অনুষ্ঠানমালা।

আর এখন কেউ ঈদের পোষাক লুকিয়ে  রাখে না, পোষাক কেনার জন্য শপিং মলে যাওয়া থেকে শুরু করে কিনে বাসাতে আসা পর্যন্ত খুটিনাটি সব তথ্য এমনকি নতুন পোষাকের ছবি পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে দিয়ে দিচ্ছে ফেসবুকে। বাসার ফিন্নি সেমাইয়ের সীমানা পেরিয়ে সবার মুখের স্বাদে দখল বসিয়েছে নামী-দামী ব্রান্ডের ভিনদেশি খাদ্য।

তবে এরকম চোখে পড়ার মত পরিবর্তনের পাশাপাশি এসেছে ঈদের আনন্দ সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার নতুন পন্থা। ফেসবুকের মাধ্যমে ইভেন্ট করে ঈদ আনন্দ বঞ্ছিতদের মাঝে ঈদের খুশী ছড়িয়ে দিতে আজকের প্রজন্ম এগিয়ে আসছে, ব্যক্তি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এসকল ক্ষুদ্র উদ্যোগ দিন দিন বৃহৎ পরিসরে ব্যাপকতা বৃদ্ধি করছে।

সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে, হবেই –এটা সময়ের চিরন্তন নীতি। সকল শুভ পরিবর্তন টিকে থাকুক আমাদের ঈদ আনন্দে আর ব্যক্তি বা অনলাইনকেন্দ্রিক না হয়ে সারা বছরময় জুড়ে যাতে ঈদের আনন্দ বিরাজ করুক সবার মাঝে, সেটাই এবারের ঈদের চাওয়া হোক।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।