ঢাকা: এবার ঈদেও দেখা হবে না একমাত্র সন্তানের সঙ্গে। হয়তো তারপরের ঈদেও না।
আগারগাঁও করম আলীর বস্তির পঞ্চাশোর্ধ বিধবা জাহিদা বেগমের স্বামীকে নিয়ে শ্মশানেও ঠাঁই হয়নি। আর এখন সন্তানের জন্য এ বস্তিতে অপেক্ষা করেই কেটে গেছে প্রায় এক যুগ।
রামপুরা এলাকায় মাটি কেটে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করতে হয় জাহেদাকে। কিন্তু এবার রোজার মাসে কাজও নেই তেমন। ছেলেকে জেলখানায় দেখতে যাওয়ার টাকাও রোজগার হবে না তার।
অপেক্ষা, কষ্ট আর ভাবনার কথাগুলো বলে যেন খানিকটা কষ্টমুক্ত হতে চান বিধবা জাহেদা বেগম।
বস্তির রাস্তায় বসে জাহেদা সন্তানের অপেক্ষায় ভাবেন, স্বামীকে নিয়ে শ্মশানেও ঠাঁই হয়নি। বিএনপি বস্তি এলাকার শ্মশানের জমিটা বিক্রি হয়ে গেছে। হাজী সাহেব হিন্দুদের কাছ থেকে কিনে অট্টালিকা বানিয়েছেন। ছোট্ট একটি কোণায় জায়গাও দিতে চেয়েছিলেন, তা হয়নি। আর এখন সরকারি জমির দখল করা বস্তিতেও ভাড়া দিয়ে থাকা, তাও পেরে উঠা যাচ্ছে না।
কাজের পর ক্লান্তি শেষে বিশ্রামে অথবা কাজ না পেয়ে দিনমান না খেয়েই শেফালী দর্জির ভাঙা ঘরে সময় কাটে তার। ভোর রাতে কারোর দেওয়া কিছু খাবারের অংশ বিশেষ আর পানি খেয়েই রোজাও রাখতে হচ্ছে।
জাহেদার এখন চাওয়া, ছেলে জেলহাজত থেকে ফিরে আসলে বৃদ্ধ বয়সে আর এ অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হবে না তাকে।
খানিকটা থেমে বাংলানিউজকে জানান, আগারগাঁও বিএনপি বস্তিতে ২০০৪ সালে পুলিশের ফর্মা (সোর্স) রিপন মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে গুরুতর আহত হয়ে মারা যায়। হত্যার অভিযোগে তার মৃত সন্তান জাকিরের নামে মামলা করে পুলিশ।
এরপর ঘটনার সাত বছর আগে ১৯৮৭ সালে মারা যায় বড় ছেলে জাকির খান। মরে যাওয়া সেই বড় ছেলে জাকিরের পরিবর্তে জীবিত একমাত্র ছেলে আলমগীর খাকে না চিনেই জেলে পাঠানো হয়।
জাহেদা বলেন, ২৭ দাগে হান্না হেরোইন, ডাইল বেচতো। ওরা সবাই তুলাতলা (আগারগাঁও বিজ্ঞান যাদুঘরের সামনের রাস্তায়) আড্ডা দিত। পুলিশের ফর্মা রিপন প্রতিদিন ওদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিতো। এ আড্ডায় কুমিল্লার মোস্তাফা ছাড়াও আনোয়ার ও জসিম নামের একজনও ছিল।
র্যাব হান্নাকে ক্রস ফায়ার দিয়েছে। জসিম বিদেশে চলে গেছে। আর তাকে না পেয়ে নুরু হাজীর নাতি জসিমকে জেলে দেয় পুলিশ।
আবারও চোখ মুছতে মুছতে বলেন, পুলিশের ফর্মা রিপনকে ড্রামের মধ্যে পুরে মারধোর করে মাদক ব্যবসায়ীরা। হাসপাতালে ভর্তির পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে। কিন্তু বাসায় দুধ খাওয়ার পর অসুস্থ হলে আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারাও যায়।
এ ঘটনায় পুলিশ পরদিন মামলা সাজায় ইচ্ছামতো যার-তার নাম দিয়ে। আমার মরে যাওয়া ছেলেটার পরিবর্তে ছোট ছেলে আলমগীর খানকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারপিট করে।
মামলা করার আগে পুলিশ আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকাও চেয়েছিল, দিতে পানিনি। পুলিশের মারধোর সহ্য করতে না পেরে তাদের কথায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলেছে ‘আমিও লাঠি দিয়ে একটা বাড়ি দিয়েছিলাম’।
এরপর কেটে গেছে চৌদ্দ বছর। সাক্ষীর অভাবে বিচারও হচ্ছে না। আমার ছেলে ছাড়াও পাচ্ছে না।
জাহেদা আবারও তার কষ্টের কথা বলতে শুরু করেন। ‘জাকির মরে গেছে সাত বছর আগে, আমার এ ছেলের নাম আলমগীর’ এ অনুরোধ করেও লাভ হয়নি।
তিনি অভিযোগ করে জানান, পুলিশের দাবি করা তিন হাজার টাকা দিতে না পারায় মরা ছেলে আর জীবিত ছেলে দুজনের নামেই মামলা ঠুকে দেয় পুলিশ।
মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মামলার নথি থেকে জানা গেছে, রিপনের শাশুড়ী রাবেয়া বেগম বাদি হয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এজাহার দায়ের করেন।
১৮ জুলাই দিনের বেলায় তাকে পিটিয়ে গুরুতর আঘাত করা হয়। তাকে লোকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরিয়ে আনার পর আবার অসুস্থ হলে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ২০ জুলাই দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
রিপনকে হত্যার সাত বছর আগে মারা যাওয়া জাহেদার ছেলে জাকির খানের নামের সঙ্গে আলমগীর নাম জড়িয়ে দিয়ে এজাহারে লেখা হয় ‘জাকির এলাইচ আলমগীর। ’
জাহেদা নিজের ছেলেকে ঘটনার নাবালক দাবি করে বলেছেন, আমি ১২ বছর বয়সে তার বিয়ে দিয়েছিলাম বিএনপি বস্তির এক মেয়ের সঙ্গে। আসামী না পাওয়ার কারণে সাবালক দেখিয়ে মামলা করার সুযোগ নিয়েছে পুলিশ।
বাংলাদেশ সময় ০৬০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৩
এসএমএ/সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান