ঈদ অর্থ আনন্দ। তবে তা নিছক ব্যক্তিগত আনন্দ নাকি সবার সম্মিলিত সামাজিক আনন্দ- তা আজ ভেবে দেখার মতো বিষয়।
এমনই বদলে যাওয়ার ছোঁয়া লেগেছে আরব দেশগুলোর ঈদ উৎসবেও। তবে এ বদলে যাওয়ার মধ্যেও যে বিষয়টি প্রশংসনীয়- তা হচ্ছে, গোত্র কিংবা সামাজিক রীতিনীতি এড়িয়ে যাওয়ার মতো দুঃসাহস এখনও তাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। পরিবার কিংবা একই গোত্রের সন্তান- চাই সে যেখানেই থাকুক- ঈদকে কেন্দ্র করে তারা সবাই একসঙ্গে জড়ো হবেন। ঈদের আনন্দের এখান থেকেই সূচনা।
ঈদ উপলক্ষে খুব বেশি জাঁকজমক বা কেনাকাটার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ধনী দেশগুলোর অভিজাত নাগরিকেরা ভ্রমণে যাওয়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ঈদের দু-চারদিন পর তারা সপরিবারে এখানে ওখানে আনন্দভ্রমণে ব্যস্ত থাকেন। বর্হিদেশে ঘুরতে যাওয়ার বেলায় আরবদের বর্তমান পছন্দের তালিকায় রয়েছে- থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, ভিয়েনা এবং এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপ।
বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা মালদ্বীপের চেয়ে বেশি নাকি কম- সে বিতর্কে না গিয়ে অন্তত বলা যায়, মালদ্বীপের পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা এবং সাগরের স্বচ্ছ টলটলে পানি উপভোগের যেসব প্রচারব্যবস্থা ইন্টারনেটে রয়েছে কিংবা যে কোনোভাবে আরবসমাজে মালদ্বীপের সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়েছে- সেসব কৌশল অবলম্বনের বেলায় আমাদের অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, এ আলোচনা আপাতত কাম্য নয়।
তবে মূল বিষয়গুলোতে অতীত এবং বর্তমানে আরব ও এ দেশীয় ঈদ উৎসবে খুব বেশি তফাত নেই বললেই চলে। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে প্রখ্যাত ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ডিক্সন কুয়েতে থাকাকালীন সেখানে ঈদ আনন্দের যে দৃশ্য দেখেছন- তা লিখে রেখেছিলেন।
তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, আরবীয় অঞ্চলে ঈদ আনন্দ উৎসবের সূচনা হতো মহিলাদের হাত ধরে। হাতে পায়ে মেহেদী রাঙানো এবং রং-বেরঙের কাপড় সেলাইয়ে ব্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ঈদের আগমনি সুর বেজে উঠতো শহুরে কিংবা বেদুইন পাড়াগুলোতে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ, নানা রকমের ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন এবং গান-বাজনার আসর দিয়েই মূলত আরব ঈদ আনন্দ সাজানো হয়ে থাকে। তার সেকালের বর্ণনায় সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে আনন্দভ্রমণের কথা পাওয়া না গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটিও আরবদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যোগ হয়েছে।
স্যাটেলাইট প্রযুক্তিবিহীন সেকালে পুরুষদের ঈদ উৎসবের অন্যতম আয়োজন ছিল ঘোড়াদৌড়, উটের দৌড়, তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। তবে বিশেষ আয়োজন হিসেবে গান-বাজনা এবং যুবকদের সম্মিলিত নাচ উল্লেখযোগ্য এবং সবার কাছে উপভোগ্য ছিল। নাচের সময় তারা বিশেষ কায়দায় নিজেদের পা ও কোমর দুলিয়ে হাতে ধরা তলোয়ারের খেলা দেখাতো। এ নাচানাচি এবং তলোয়ারের খেলা আজও আরব দুনিয়ার যে কোনো উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
মহিলাদের অন্দরমহলে বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাকস বা নাচের আসর। খুব সূক্ষ্ণ গান এবং বাজনার তালে তালে বংশের সুন্দরী তরুণীরা নাচতো এবং অন্য মহিলারা সমবেত হয়ে সেসব দেখতো। শহর এবং বেদুইন অঞ্চলে উৎসবের আয়োজনে তারতম্য হতো তাঁবু এবং অন্যান্য সামগ্রীর চাকচিক্যের ভিত্তিতে।
ডিক্সন তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, শহরের চেয়ে মরু গ্রামাঞ্চলের অবিবাহিত তরুণীরা এসব কোমরদোলানো নাচ বা রাকস দেখানোতে বিশেষ আগ্রহী ও পারদর্শী ছিল। গোল হয়ে বসে থাকা বয়স্ক ও বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে একসাথে তিনজন তরুণী এ নাচ দেখাতো। গ্রামাঞ্চলে এ উৎসব প্রায়ই সাতদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতো এবং এরপর তা গুটিয়ে ফেলা হতো। ডিক্সন খুব বিস্ময়ের সাথে উল্লেখ করেছেন, ওইসব তরুণীদের অভিভাবকরা তাদেরকে যেন অন্য কোনো পরপুরুষ কিংবা সাবালক যুবক না দেখে ফেলে- সে ব্যাপারে খুবই কঠোর থাকতেন। পর্দাঘেরা আয়োজনে সমবেত তরুণী ও নারীরা নিজেদের বোরকা খুলে রং-বেরঙের জামা-কাপড়ে সেজেগুজে হাজির হতেন। প্রাচ্যবিদ ইংরেজ ঐতিহাসিক ডিক্সন তার বর্ণনায় আরও নানা প্রসঙ্গ এনেছেন- যা এখানে আলোচ্য নয়।
সর্বশেষ আমার দেখা দৃশ্যের কথা বলছি। গত ঈদুল আযহার দিন আমি কাতারে ছিলাম। দুপুরের দিকে এক বড়ভাইয়ের সাথে কাতারের নামকরা একজন গোত্রপতির মজলিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বৃদ্ধ মানুষটির বসার আসন এবং তার ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়- তিনি খুবই সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ। একটি বড় হলঘর। উপরে-নীচে চারপাশে তাঁবু টানানো হয়েছে। আধুনিক তাঁবু। ভেতরে এসি এবং সোফার জমজমাট আয়োজন। প্রায় পঞ্চাশ জন হলঘরটির চারপাশ ঘিরে পাতানো সোফায় বসে আছেন। এদের মধ্যে এই বৃদ্ধ গোত্রপতির ছেলে, নাতিসহ অন্যান্য স্বজনরাও রয়েছে। ঐ মজলিসে উপস্থিত হওয়া মাত্র সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেল আমাদের দু’জনকে ঘুরে ঘুরে পুরো তাঁবুর ভেতরে উপবিষ্ট সবার সাথে সালাম-মুসাফাহা করতে হলো। শুধু আমরা নই, আমাদের পরে যে ক’জন এসেছে- নিয়মমাফিক সবাই উঠে দাঁড়িয়ে যায় এবং আগত অতিথি সবার সাথে ঘুরে ঘুরে কুশল বিনিময় করে।
তবে বৃদ্ধ গোত্রপতি শায়খ তার আসনে বসে থাকেন এবং অতিথিরা তার কপালে সম্মানসূচক চুমো দেন।
মজলিসে উপস্থিত সবাই পারস্পরিক কথা-বার্তায় ব্যস্ত। যুবক-তরুণরা তাদের হাতে ধরা ব্ল্যাকবেরি কিংবা আইফোনে মগ্ন। কিছুক্ষণ পর পর অ-আরব খাদেমরা এসে চায়ের ট্রে হাতে ঘুরে ঘুরে সবার সামনে উপস্থিত হচ্ছে এবং চা-পিয়াসীরা তাদের চায়ের কাপ নিয়ে নিচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পরপর একটি বড় পাতে সুঘ্রাণছড়ানো ধুমায়িত সুগন্ধিকাঠ নিয়ে আরেকজন এসে হাজির এবং রেওয়াজমতো সেও সবার সামনে গিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ করে দাঁড়াচ্ছে। উপস্থিত সবাই নিজেদের মাথায় ঝোলানো রুমাল সরিয়ে ধোঁয়া গ্রহণ করছে এবং দু হাত দিয়ে নির্দিষ্ট ইশারায় ধোঁয়া নিজের শরীরে মেশাচ্ছে। কোনো আরব মজলিসে ঈদের প্রহরে এটিই ছিল আমার প্রথম উপস্থিতি। কাজেই আমি খুব গভীরভাবে তাদের প্রত্যেকের ভাবভঙ্গি দেখে দেখে সময় পার করছিলাম।
স্বজনদের সমাবেশ এবং প্রবীণদেরকে সম্মানের ঐতিহ্য বজায় রাখার সেই মুগ্ধকর দৃশ্য আমাকে আপ্লুত করেছিল এবং একইসাথে মজলিসে উপস্থিত তরুণদের মোবাইলমগ্নতা দেখে ভাবছিলাম- এরা বুড়ো হতে হতে কি এসব কৃষ্টি-কালচার হারিয়ে যাবে?
যে কোনো সচেতন মানুষের মতো আমারও কামনা ও প্রার্থনা- তা যেন কখনো না হারিয়ে যায়। শুধু আরব কেন, ঈদ উৎসবে প্রতিটি দেশ ও সমাজ ইসলামের আলোয় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি যত্নবান হোক- এটাও আমার বাসনা।
তামীম রায়হান: শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর