ঢাকা: ব্রহ্মপুত্র নদ আছে বাংলাদেশে। আবার ভারতের আসাম রাজ্যেও রয়েছে।
অতীতের দরং এখন শোণিতপুর। শোণিতপুর জেলার সদর এই তেজপুরে। কিংবদন্তি রয়েছে শিবের অবতার ভৈরব নাথের উপাসক অসুররাজ বানের রাজত্ব ছিল অতীতে।
অসুররাজ বানের রূপসী কন্যা উষা স্বপ্নে দেখেন দয়িতকে। সখি চিত্রলেখা রূপ দেয় চিত্রেÑ খুঁজেও মেলে স্বপ্নে দেখা রাজকুমার দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধকে।
বিয়ে হয় গান্ধর্ব মতে উষা ও অনিরুদ্ধর। বান জানতে পেরে কারাগারে পাঠায় অনিরুদ্ধকে। দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণ (হরি) আসেন নাতি উদ্ধারে। এ দিকে শিবও আসেন ভক্ত বানের আহ্বানে।
এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। হরি আর হরের যুদ্ধে রক্ত ঝরে সারা শহরে। সেই থেকে নাম হয় শোণিত বা তেজপুর অর্থাৎ রক্তের শহর।
বাসা বাঁধে উষা ও অনিরুদ্ধ শহর থেকে ৫ কিঃমিঃ দূরে বামুনী পাহাড়ে। ৭টি মন্দির ছিল সেকালে-শিব ও বিষ্ণু উপাস্য দেবতার নামে। তেমনই পাহাড় চূড়ায় উষা হরণের নানান আখ্যান রয়েছে।
ব্রহ্মপুত্রের স্নানঘাটে সিদ্ধিদাতা গণেশের মন্দির। পাথর কুঁদে তৈরি গণেশ মূর্তিটি দেখার মতো। ঘাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের দৃশ্যও মনোরম। বিপরীতে উষা ও অনিরুদ্ধ পরিবেশ উদ্যান অর্থাৎ মনোহর বাগিচা, মূর্তি হয়েছে উষা ও অনিরুদ্ধের। এর সামনে আর এক টিলা অর্থাৎ অগ্নিগড়। ১৭৫ ধাপ অতিক্রম করে এখানে আসতে হয়। পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদ।
সাঁঝের সূর্যাস্তে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাকাশে অস্তগামী সূর্যের রঙের বর্ণালি আর এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। মূর্তি রয়েছে উষা ও সখি’র। এখানে ট্যুরিস্ট লজের সামনে আছে একটি পার্ক। কেউ বা এই পার্ক দেখে বলেন, এ যেন স্বর্গের নন্দনকানন।
তেজপুর শহরের অপর প্রান্তে মহাভৈরব শিবমন্দিরটিও যথেষ্ট আদৃত ভক্তদের কাছে। তেজপুরের ৫১ কিঃমিঃ পশ্চিমে বিশ্বনাথ মন্দিরটির ভগ্নস্তূপ আজও ট্যুরিস্টদের অতীত রোমন্থন করায়। লেক, পার্ক আর গাছগাছালিতে ছাওয়া সুন্দর সাজানো শহর তেজপুরের প্রকৃতিও সুন্দর।
শীত ও গ্রীষ্ম কারোই আধিক্য নেই, জলবায়ুও স্বাস্থ্যপ্রদ তেজপুরের। জলবায়ুর গুণে তেজপুরেও চায়ের কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় ৬০টি চা-বাগান রয়েছে এই জেলায়।
এককালে ব্রিটিশদের প্রিয় ছিল তেজপুর শহর। রেসকোর্স, পোলো গ্রাউন্ড ব্রিটিশেরই গড়া। ১৯৪২ সালে স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলে ব্রিটিশের বুলেটে শহীদ হন ১৪ বছরের কনক লতা তেজপুরের অদূরে গহপুরে।
তেজপুরের আশপাশের জায়গাও কম সুন্দর নয়। তেজপুর থেকে ৬০ কিঃমিঃ দূরে পাহাড় আর সবুজে ছাওয়া আরণ্যক ভালুকপঙ। হিমালয়ের পাদদেশে শোণিতপুর জেলায় আর এক বন্য জন্তু সংগ্রহালয় ১৭৫ বর্গকিমি ব্যাপ্ত মোনাই ও রূপাই-এর ওপর দিয়ে পথ গিয়েছে আসাম ও অরুণাচল রাজ্যের সীমান্তজোড়া শহর ভালুকপঙে।
সেখানে নীল খরস্রোতা দামাল নদী জিয়াভরলি বয়ে চলেছে। তেজপুর থেকে বাসে তেজপুর-গৌহাটি সড়কে ৪৫ কিমি পশ্চিমে ওরাং চারিআলি পৌঁছে চারিআলি থেকে ১৮ কিমি দক্ষিণে ওরাং বন্য জন্তু সংগ্রহালয়।
শাল, সেগুন, শিমুল, ইউক্যালিপটাসে ছাওয়া এই বনাঞ্চলে বসবাস করে এক শৃঙ্গি গন্ডার, হাতি, লেপার্ড, শম্বর, হরিণ ছাড়াও নানা প্রজাতির পাখি। শীতে দূর-দূরান্ত থেকে চেনা-অচেনা পাখিরা এসে নীড় বাঁধে অরণ্যজুড়ে বৃক্ষশাখে।
দুধসাদা পেলিক্যানেরা আসে সুদূর আমেরিকা থেকে। ওরাং-এর ফরেস্ট বাংলোতে রাতে অবস্থান করা যায়। রাতে অবস্থান করা মানেই এর রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাওয়া। তেজপুর ঘুরে দেখা আর ওরাং অরণ্যে কয়েক দিন বেড়ানো জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হতে পারে। যেজন্য আজও ভুলতে পারিনি তেজপুরকে।
কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্ক
আসাম রাজ্যে জাতীয় উদ্যান এবং অভয়ারণ্যের অভাব নেই। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অরণ্যটি হলো কাজিরাঙা। প্রতিবছর শীত মওসুমে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক কাজিরাঙায় এসে হাজির হন হাতির পিঠে চেপে প্রধানত এক শৃঙ্গবিশিষ্ট ভারতীয় গন্ডার দেখতে।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান বর্ষার কারণে বন্ধ থাকে ১ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। বর্ষাকালে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী কাজিরাঙার বনভূমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ বন্য প্রাণী ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক অতিক্রম করে মিকির পাহাড়-সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় চলে যায়।
বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটকদের কথা ভেবে, পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে মাঝে মাঝে ১ নভেম্বরের আগেই পর্যটকদের জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এই বিষয়ে কাজিরাঙার ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যাবে ( ০৩৭৭৬-২৬২৪২৩)।
যাই হোক, শীতের মওসুমেই কাজিরাঙা বেড়ানো সুবিধাজনক। গৌহাটি থেকে সড়কপথে ২১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাজিরাঙায় গাড়ি ভাড়া করে অথবা বাসেও যাওয়া যায়। গৌহাটির পল্টনবাজার থেকে জোরহাট, শিবসাগর, ডিব্রুগড় বা তিনসুকিয়া যাওয়ার সুপারফাস্ট বাসগুলো কাজিরাঙার ওপর দিয়ে যায়।
বাস থেকে নামতে হবে কোহরা মোড়ে। এখান থেকে কাজিরাঙার বনবাংলো এবং ট্যুরিস্ট লজগুলোর দূরত্ব ১ কিলোমিটারের কম। সঙ্গে লটবহর থাকলে মারুতি জিপসি পাওয়া যাবে স্বল্প ভাড়ায়।
কাজিরাঙায় পৌঁছে প্রথম সুযোগেই এলিফ্যান্ট বুকিং সেন্টারে গিয়ে পরদিনের হাতির পিঠে চেপে বনভ্রমণের জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। এই অফিসটি খোলা সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা, দুপুর ২টা থেকে ৩টা এবং সন্ধের পর ৭টা থেকে ৮টা। সন্ধে ৭টা থেকে পর্যটকদের নামের তালিকা অনুযায়ী টাকা জমা নিয়ে এলিফ্যান্ট রাইডের সিট বুক করা হয়।
হাতির পিঠে বনভ্রমণের খরচ : জঙ্গলে প্রবেশ ফি মাথাপিছু ২০ টাকা, হাতির পিঠে চড়ার খরচ একজনের ২৮০ টাকা, স্টিল ক্যামেরা ৫০ টাকা।
এলিফ্যান্ট রাইডের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় মারুতি জিপসি চালকদের মধ্যে কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে যে পরদিন শেষ রাতে ট্যুরিস্ট লজ থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাবে এলিফ্যান্ট রাইডিং পয়েন্টে। এর জন্য গাড়িভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। রাইড শেষে এই গাড়িতেই ফিরে আসা যাবে।
সকালের দিকে দুটি ট্রিপে এলিফ্যান্ট রাইড হয়। প্রথমটি ভোর ৫টা থেকে ৬টা এবং দ্বিতীয়টি ৬টা থেকে ৭টা। হাতির পিঠে চেপে ভোরবেলায় কাজিরাঙার জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চোখে পড়বে গন্ডার, বুনো মোষ, হগ ডিয়ার, বুনো শুয়োর এবং শম্বর।
এছাড়া দেখা মিলবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। হাতির পিঠে বসে কাজিরাঙার বনে সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।
বলা বাহুল্য, এলিফ্যান্ট রাইডের মাধ্যমে জঙ্গলের অতি সামান্য একটি অংশে ঘোরাঘুরি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কাজিরাঙার বিস্তৃত অরণ্যের ভেতর বেড়াতে হলে জিপ সাফারি ছাড়া অন্য উপায় নেই।
জিপ সাফারিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ইস্টার্ন রেঞ্জ (ভাড়া ১,০০০ টাকা), সেন্ট্রাল রেঞ্জ (ভাড়া ৬৫০ টাকা) আর ওয়েস্টার্ন রেঞ্জ (ভাড়া ৭০০ টাকা)। জিপ সাফারির অন্যান্য খরচ হলো এন্ট্রি ফি মাথাপিছু ২০ টাকা, গাড়ির প্রবেশকর ১৫০ টাকা, স্টিল ক্যামেরা ৫০ টাকা, মুভি ক্যামেরা (অপেশাদার) ৫০০ টাকা।
জিপ সাফারিতে গিয়ে যেসব বন্য প্রাণীর দর্শন পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে তা হলো- বুনো হাতি, গন্ডার, বুনো মোষ, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, গাউর বা ভারতীয় বাইসন, শিয়ার, বুনো শুয়োর, বনবিড়াল, প্রচুর পাখি এবং কয়েক ধরনের সরীসৃপ। কপাল ভালো হলে চিতাবাঘ এবং বাঘের দর্শনও পাওয়া যেতে পারে।
কোথায় থাকবেন : আসাম পর্যটন দপ্তরের অধীনে রয়েছে বনশ্রী লজ, দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৪০০ টাকা। বনানী লজ, দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া (একতলায়) ৬০০ টাকা, (দোতলায়) ৭৫০ টাকা। কুঞ্জবন ডর্মিটরি লজ প্রতি শয্যার ভাড়া ৫০ টাকা। অগ্রিম ঘর বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ ০৩৭৭৬-২৬২৪২৩।
আসাম পর্যটন উন্নয়ন নিগমের অধীনে রয়েছে অরণ্য লজ, দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৭৮৮ টাকা, স্যুইট ভাড়া ২,৩০০ টাকা। প্রশান্তি ট্যুরিস্ট লজ, দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৮৬৩ টাকা।
অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য অফিসার ইন চার্জ অরণ্য ট্যুরিস্ট লজ, কাজিরাঙা ০৩৭৭৬-২৬২৪২৯, কাজিরাঙা ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির ( ০৩৭৭৬-২৬২৪৯৪) অধীনে দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ২৫০-৩৫০ টাকা।
কাজিরাঙা গ্রামোন্নয়ন ভবন ( ০৩৭৭৬-২৯৯৭১০), দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া শুরু হয়েছে ৮০০ টাকা থেকে। ‘জুপুরি ঘর’ ট্যুরিস্ট কমপে¬ক্সে কটেজগুলোর ভাড়া ১,৬০০ টাকা। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ ৯৪৩৩৩-৪৫৮১১।
বাংলাদেশ সময় : ১২৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর, কো-অর্ডিনেশন/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর