ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পানিই যেন আশীর্বাদ

নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৫৩, আগস্ট ১৬, ২০১৩
পানিই যেন আশীর্বাদ

এলংজানী-লাহিড়ী মোহনপুর(সিরাজগঞ্জ) থেকে ফিরে: পানি নেই সিরাজগঞ্জের অনেক এলাকাতেই। এমনকি যমুনা তীরে গিয়েও চোখে পড়েনি পানির ওই রকম কোনো স্রোত বা তীব্রতা।

কিন্তু সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া-শাহজাদপুর-তাড়াশ উপজেলাসহ পাবনার ফরিদপুর-ভাঙ্গুড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শুধুই পানি আর পানি।

আর এ পানি নিয়ে বিল এলাকার মানুষের মনে নেই কোনোই খারাপ লাগা। আছে অন্যরকম ভাললাগা। পানিকেই আশীর্বাদ মনে করেন তারা। পানির মধ্যেও তারা খুঁজে পান জীবিকার নতুন সন্ধান। পানিই তাদের কাছে বিনোদনের সহজ পথ এনে দেয়। ৬ মাস কষ্ট শেষে বাকী ৬ মাস পানির সঙ্গে সখ্যতা তাদের।

ঈদুল ফিতরের পরের দিন(১০ আগস্ট’২০১২) জলকে আপন করে নেওয়া এ এলাকায় যাবার সুবাদে এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। উল্লাপাড়া থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় লাহিড়ী মোহনপুর। এবার আর সড়ক পথ নয়, যেতে হবে নৌপথে। কাছেই রেলপথের ধারে দহকুলা ঘাট। এখানে সারি সারি ইঞ্জিন চালিত নৌকা।

নৌকাগুলো চলে এলংজানী, কোনাবাড়ি, দত্তপাড়া, সাতবিলা, চিনা ধুকুরিয়া, নাদা, চক হরিপুর, হাজিপুর, নতুন গ্রাম, বলতৈল, চক পাড়া, গোনাইগাতী, কাইমকোলা, সরাতৈল, আঙ্গারু নাদাসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে।
বেশিরভাগ নৌকাতে আবার সুন্দর করে ছই তোলা। রয়েছে মাইক। ঘাট ছাড়ার পরপরই শুরু হয় মাইকে গান। ভাড়াও অবিশ্বাস্যরকম কম (৫ কিলোমিটারে দূরত্বের ভাড়া ৫ টাকাই)। প্রত্যাশিত বাড়ির ঘাটেই নামা ও ওঠার সুযোগ।

অপরপাশে রয়েছে আরও ২০ গ্রামে যাওয়ার আরেকটি নৌকা ঘাট। এখানকার নৌকা বামনগ্রাম, বঙ্কিরহাট, খাইরা, দত্ত খাড়ুয়া, বলাইগাতী, আচলগাতী, কৈবতরগাতী, বিলপাশা, আকবহর, উধুনিয়া, দিঘলগাঁও, খাদুলী, পাঙ্গাশী এলাকায় চলাচল করে থাকে।

একেকটি নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে ১০-১৫জন যাত্রী হলেই। এতো কম মানুষ আর কম ভাড়ায় এ খাটুনি কেন জানতে চাইলে কামরুল নামের এক নৌকা মালিক বললেন, ‘এটা আমাদের আনন্দও। আর যারা বাইরে থেকে আসেন তারা এমনিতেই বেশি দেন। যাবার সময় কম হলে ফিরতি পথে ভাল যাত্রীসহ মালপত্র পেয়ে যাই। আর সকাল থেকে মাঝরাত্রী পর্যন্ত আমরা নৌকা চালাই। সব মিলে ভালই আছি। ’

মাইক কেন জানতে চাইলে দুর্গম এলংজানী আটিয়ারপাড়া গ্রামের এ বাসিন্দা বলেন, ‘মাইক বাজলে যারা কোথাও যেতে চান, তারা বুঝে যান নৌকা আসতেছে। বাড়ির পিছনের ঘাটে দাঁড়ায়। আমরাও তাদের তুলে নিয়ে আসি। আর মাইক নৌকা ভ্রমণের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ’

দহকুলা ঘাটটা পেরোতেই বিস্তীর্ণ জলরাশির দেখা মিললো। মিল্কভিটার দুধ সংগ্রহের জন্য বেশি পরিচিত এ এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে বিদেশিজাতের গরু। আর গোবর সহজলভ্য হওয়ায় বায়োগ্যাস প্লান্টও খুব বাড়ছে বলে জানালেন নৌকা যাত্রী বেসরকারি জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক কে এম আব্দুল আলীম।

অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে নৌকা আটিয়ারপাড়া বাজারে থামলো কিছুক্ষণের জন্য। এ বাজারটি যেনো এতদঞ্চলের জনসাধারণের  মিলনস্থল। বাজার ঘেষেই এখানে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়। ছোট্ট এ বাজারটিতে কম দামে নদীর হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে সর মিশ্রিত খাটি দুধের চা যেনো সবারই প্রিয়। একটু দূরে রয়েছে হাফেজিয়া মাদ্রসা ও দাখিল মাদ্রাসা।

স্কুল মাঠে তৈরি হচ্ছে ব্র্যাকের ভাসমান শিক্ষা তরী। ৭টি শিক্ষা তরীর ২টির কাজ শেষ হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের এ শিক্ষা তরী বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা সবার।

দুপুর না হতেই প্রচুর ডিঙি(ছোট) নৌকার দেখা মিললো এলাকাজুড়ে। সবাই যেনো ঘর ছেড়ে পানিতে ঘুরতে বের হয়েছে। এ এক বিরল দৃশ্য। আছে একেকদিন একেক পাশে নৌকা বাইচের আয়োজন। কোনোদিন বড় নৌকা আবার কোনোদিন ছোট নৌকার। স্থানীয়ভাবে আয়োজিত এসব প্রতিযোগিতার পুরস্কার বেশি দামি না হলেও আগ্রহ যেনো অনেক বেশি।

শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘুরতে গিয়ে পাবনা আর সিরাজগঞ্জ সীমান্তের কোছে একটি জায়গায় গিয়ে ২ পাশে অনেক দূরে গ্রামে দেখা মিললেও দক্ষিণাংশের কোনো জনপদ চোখে দেখা যাচ্ছিল না। আর ঢেউও ছিল অনেকটা বড়। এ যেনো আরেকটি কক্সবাজার। পুরো পানির মধ্যে ২/১টি বাড়ি দেখা গেলো। টিনের দোচালা, আর ছন-সলার বেড়ার বাড়িকে চারপাশে ইটের গাঁথুনি দিয়ে রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা।

আবার কম পানিতে ডিঙি নৌকায় বেড়াতে গিয়ে কথা বলছিলাম স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব আব্দুল বারেকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘পানি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। পানিকে কেন্দ্র করে এ ৬ মাস আমরা অনেক ভাল থাকি। এর মধ্যে যে কত কী আছে আমরা তা জানি। ’

শুধু কোটি টাকার মাছই তারা ধরে থাকেন বলে জানান ডিঙি নৌকা চালানো এ মানুষটি।

তিনি জানান, জুন থেকে মোটামুটি পানি আসে। থাকে নভেম্বর পর্যন্ত। এ সময় তাদের প্রধান আবাদ ধান, সরিষা আর মিল্কভিটার দুধ পৌঁছানো খুবই সহজ হয়। আর নৌকা মৌসুমে সব আত্বীয় স্বজন আসে। এখানকার সুস্বাদু মাছ যে সবার প্রিয়। আর হরতালের দিনগুলোতে এসব এলাকায় যেনো অঘোষিত উৎসব।

মিল্কভিটাসহ বেসরকারি কোম্পানিগুলো দুধ সংগ্রহ সাধারণত না করায় দুধের দাম কমে যায়। যাদের গরু নাই তারাও কমদামে দুধ যেমন খেতে পারে একইভাবে গরুওয়ালারা দই বসায়। এ যে আরেক উৎসব।

আটিয়ারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা কাজী সালমা খোন্দকার বলছিলেন, ‘এতো কম খরচে এ এলাকায় কোথাও যাওয়া যায় তা বলাই বাহুল্য। এখানে যেমন প্রায় সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়, একইভাবে দেশি মোরগ, রাজ হাঁস পাওয়া যায়। আর কোথাও যেতে চাইলে শুধু বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই হবে। ৫/১০ মিনিট পরপর নৌকার দেখা মিলবেই। ’

দুর্গম দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যহত হয় কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনটি হয়না। কারণ এখানে নৌকা খুবই সহজলভ্য। আর শিক্ষকরাও স্থানীয়। এছাড়া শিক্ষা কর্মকর্তারা সরেজমিন অন্যসময় তেমন না আসলেও জুন-ডিসেম্বর সময়ে বেশি আসেন। আর মোবাইল ফোনে হরহামেশা শিক্ষকদের সঙ্গে কথাতো বলেনই।

আবার রাজনীতিতেও এসব এলাকার মানুষ যেনো আরও বেশি সচেতন। বাজারটিতে গিয়ে দেখা মিললো ঈদ শুভেচ্ছা দিয়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ফেস্টুন। চায়ের দোকান আর নৌকায়তো রাজনৈতিক আলাপ রয়েছেই।

সেব মিলে এ এলাকার মানুষগুলোকে মনে হয়েছে আন্তরিক। রাজনেতিক মতানৈক্য থাকলেও তা সহিংসতায় তেমনটা গড়ায়না। উৎসব আমেজেই তারা থাকতে যেন ভালবাসে। রাত হলে যেমনটা ওয়াজ ও জিকির মাহফিলের আয়োজন করে থাকে এখানকার মানুষ। তেমনি আবার বৈশাখ, বিজয় দিবসসহ বিশেষ দিনগুলোতে তারা মেতে ওঠেন অন্যরকম আনন্দে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ১৬ আগস্ট, ২০১৩
এনএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।