ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অন্যরকম মিলনমেলার গল্প

জায়েদ জুলফিকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:১৩, আগস্ট ১৭, ২০১৩
অন্যরকম মিলনমেলার গল্প

আক্রমণ চালাও! শেষ করে দাও! ঠিক এভাবেই আক্রমণটা শুরু হয়। গত প্রায় ৩৪/৩৫ বছর ধরে নির্দিষ্ট দিনে ঢাকার কাফরুল থানাধীন শীমুলতলা এলাকার ঘরে ঘরে চলে এমন আক্রমণ।



না, টিপু সুলতানের কোন রাজ্য দখলের আক্রমন এটি নয়। এটি ঈদ-উল ফিতরের দিন খাবার আর আড্ডার আক্রমণ। শীমুলতলা এলাকার একটি পুরনো রীতি হলো- ঈদ-উল ফিতরে এলাকার লোকজন ঈদের নামাজের পর কোলাকূলি সেরে দল বেঁধে বাসায় বাসায় গিয়ে কুশল বিনিময় আর হালকা আপ্যায়নে শরীক হন।

ঈদের জামাত শেষে কোলাকূলির পর এলাকার মুরুব্বীদের দল ঈমাম সাহেবসহ শুরু করেন এই আক্রমণ। এক এক করে এলাকার এক প্রান্ত থেকে শুরু করে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যেকের বাসায় যান। সব বাসাতেই গৃহিনীরা খাবারের টেবিল সাজিয়ে প্রস্তুত থাকেন এমন আক্রমণের জন্য। সবাই যার যার পছন্দ মতো আইটেম একটু একটু করে খান। প্রত্যেকের বাসাতেই মহিলাদের চেষ্টা থাকে একটা স্পেশাল আইটেম টেবিলে রাখা।

মুরুব্বিদের এই আক্রমণ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় দ্বিতীয় দলের আক্রমণ। এ দলটি এলাকার দ্বিতীয় ও তার পরবর্তি জেনারেশনের সম্মিলিত দল। এই দলটিতে যোগ দেয় চার পাঁচ বছর থেকে শুরু করে চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশোর্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের শিশু ও ছেলেরা। শিশুদের মধ্যে ছেলে মেয়ে সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

আগে একটি দলের সাথে আরেকটি দলের বয়সের পার্থক্য থাকায় এদের আক্রমণে ভিন্নতা থাকে। এরা বাঁশি হাঁকিয়ে, হই-হুল্লোড় করে অধিকতর আনন্দ উল্লাসের ভিতর দিয়ে আক্রমণ করে। আক্রমণের সুবিধার্থে কেউ কেউ একটি কাঁটা চামচ ও একটি টেবিল চামচ হাতে রাখেন। আক্রমণ করতে করতে কখনো কখনো আবার হেঁড়ে গলায় গানও ধরেন - ডিস্কো ফকির আইসাছে, দুয়ারে দাড়াইয়াছে, দিবেন্নিগো আম্মাজান, যাকাত ফিতরা কি আছে।

কিংবা, এই যে দুনিয়া, কিসেরো লাগিয়া, এতো যত্নে গইড়া আছেন শাঁই। কারো কারো মুখে থাকে নানান ধরনের বাঁশি। আক্রমণ করার সময় বাজতে থাকে পুর...র...র...র...ত, পুর...র...র...র...ত, প্যাঁ.......পুঁ........। বাসায় বাসায় গিয়ে সবার সাথে দেখা হয় আড্ডা হয়। সালাম করে আক্রমণ চালান খাবার টেবিলে। বাসার গৃহিনীরাও যথেষ্ট উৎফুল্ল মনেই প্রস্তুত থাকেন এদের এই আক্রমণের জন্য।

কোন কোন বাসার একেকটা স্পেশাল আইটেম আছে, যেটা সব সময়ই ওই বাসায় পাওয়া যায়। আর বছর ঘুরে প্রতিবারই ঐ আইটেমটা চেখে দেখতে কারোই যেন ভুল হয়না। যেমন নিজামদের বাসায় রিনি’র হাতের পায়েশ আর ফ্রুট কাষ্টার্ড, বুলেটদের বাসায় লিমা আর মুনিয়া’র হাতের শাশলিক ও কাবাব, শিপুদের বাসায় নিপু আর তার মায়ের হাতের আচার, রেজাদের বাসায় বোরহানি, দই বড়া, ফ্রুট সালাদ, রায়হানদের বাসায় সবজি বড়া, বাবুদের বাসায় মোরব্বা, মিট বল, রানাদের বাসায় ডিমের জর্দা, শ্যামলদের বাসায় সুইট এণ্ড সাওয়ার মিট বল, বিন্দির পোলাও ইত্যাদি।

এছাড়াও সব বাসা ঘুরে পোলাও, খিচুড়ী, মুরগীর মোসাল্লাম, রেজালা, চটপটি, হালিম, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, বিফ কারি, তালের বড়া, ইলিশ ফ্রাই, পুডিং, পাস্তা, নানান পদের শেমাই, সমোচা, অন্থন, প্রন, রোস্ট, কোরমা, ফির্নি ইত্যাদি দেশী-বিদেশী সব আইটেম কারো নজর এড়ায় না, নিমিষেই সাবাড়।

সবশেষে যাদের বাসায় যাওয়া হয়, তাদের কাছে সবার বাড়তি কিছু চাওয়া থাকে, আর সেটা হচ্ছে ঠান্ডা পানীয় কিংবা আইসক্রিম। অনেকের বাসায় প্রতিবারই নতুন রেসিপির একটা আইটেম থাকে। এবারের ঈদেও তেমনি হোয়াইট সালাদ, গাজরের জর্দা, বিন্দির পোলাও, ও ম্যাংগো পুডিং পাওয়া গেল যথাক্রমে নিজাম, মোস্তাফিজ, শ্যামল ও শিপুদের বাসায়।

স্পেশাল আইটেম রান্নার সিক্রেট কেউ কেউ আবার প্রকাশ করতে চান না স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য। কথা বলছিলাম রিনি ভাবীর সাথে। ‘আপনার কাষ্টার্ড কেন এত মজা হয়’ - এমন প্রশ্নের জবাবে হেসে বল্লেন ‘আমি আলাদা একটা কিছু দেই যার কারনে এটা দেখতেও যেমন সুন্দর হয় তেমনি স্বাদও বাড়ে’। জানতে চাইলাম – ‘আলাদা কি দেন’? বল্লেন – ‘সেটা বলা যাবে না’।

মোস্তাফিজদের বাসায় ঝর্না’র হাতের গাজরের জর্দা, মুখে দিয়েই শিপু বল্লেন অসাম। ‘আমার ছেলেদের জন্য লুকিয়েও রাখা যায় না, খুঁজে বের করে সব সাবাড় করে দেয়’ –  বললেন ঝর্না।

কখনো কখনো কোন কোন টেবিলে নতুন কোন রাঁধুনীর রান্না পাওয়া যায়। এবারের আক্রমণের সময় শীমুলদের বাসার বড় ভাবী বলছিলেন - কাষ্টার্ডটা খেয়ে দেখ। তোমাদের ভাজতি রান্না করেছে। সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ কাস্টার্ডের উপর; সত্যি স্পেশাল ছিল। ঈদ আয়োজনের এই সুযোগে অনেক নবীন রাঁধুনীর হাতটাও ঝালাই হয়ে যায়।

বাঙ্গালি গৃহিনীরা যে কত রকমের ফিন্নি রান্না করতে পারে তা বোঝা যায় এই ঈদ এলে। প্রত্যেকটা ফিন্নি এতোই সুস্বাদু হয় যে ডায়াবেটিক রোগীও চেখে দেখতে ভুল করে না। স্থুল স্বাস্থের অধিকারী হাবিব কিংবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত স্বপন অন্তত এই দিনটাতে ডাক্তারের সমস্ত পরামর্শ একপাশে রেখে বীরদর্পে আক্রমণ চালিয়ে যান।

প্রথম দিকে যারা এই আক্রমণের রীতি শুরু করেছিলেন তাদের কেউই আজ বেঁচে নেই। তাদের দলটির আক্রমণ এখন চলছে গুটি কয়েক মুরুব্বীর মাধ্যমে। তাদেরই একজন আব্দুল হামিদ খান, বয়স ৭০, বলছিলেন শুরুর দিকের কথা। সময়টা ১৯৭৭/৭৮ সাল। নামাজ পড়ে সবাই এক হতেন মোজাম্মেল হকের বাসায়। তার উদ্যোগেই মুলতঃ এটা শুরু হয়েছিল। সেখানে সবাই শেমাই পায়েশ খেয়ে এক এক করে আশপাশের অন্যদের বাসায় যেতেন। তখন বসতিও অনেক কম ছিল। পরবর্তি বছরগুলোতে আরো অনেকেই যোগ দেন এবং এর বিস্তৃতি ক্রমশঃ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যায়।

কেউ কেউ বিভিন্ন কারণে এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেও ঈদ-উল ফিতরের এই দিনটিতে ঠিকই সময় মতো চলে আসেন শীমুলতলা। তাদেরই একজন ফজলুল হক জুয়েল বলছিলেন – ‘মনের টানেই ছেলেকে সাথে নিয়ে চলে আসি। যত কাজই থাকুক, ঈদের দিন দুপুর পর্যন্ত এই আক্রমনের জন্য ফ্রি থাকি’।

আব্দুল হামিদ খান, মন্সুর হাবীব খান, মিসেস রওশন-আরা বেগম, মিসেস রেহানা তাহের, মিসেস রোকেয়া বেগম জানালেন তাদের আনন্দের কথা। এই দিনটার জন্যই সবাই অপেক্ষা করে থাকেন; ঈদের এই দিনে সবার সাথে দেখা হয়, কথা হয়, পুরনো স্মৃতিতে বিচরন হয় এটাই তাদের খুব ভালো লাগে। আরো বল্লেন, নাতি-নাতনিরা দেখবে-শিখবে আমাদের এই সংস্কৃতি, তারাও একই ভাবে এটাকে ধারন করবে। তা না হলে তো পাশাপাশি থেকেও এই প্রজন্ম কেউ কাউকে চিনবে না।

পঞ্চাশোর্ধ নিজাম উদ্দিন আহমেদ, জুলফিকার হায়দার জুয়েল, শামসুল ইসলাম জানালেন – বছরের এই দিনটির জন্য ছেলে, বুড়ো সবাই আমরা অপেক্ষা করি। ঢাকা শহরে  দেখা যায় পাশাপাশি বাসায় থেকেও একজন আরেকজনকে চিনে না, কারো সাথে হয়তো বছরেও একবার কথা হয়না; অথচ এই এলাকাতে এই সমস্যাটা নেই। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। সারা বছর যতটুকুই কথা হোক বা না হোক এই ঈদের দিন আমরা সবাই সবার বাসায় যাই। মুরুব্বীদের পা ছুঁয়ে সালাম করি। কখনো ঈদের দিন বৃষ্টি থাকলেও আমাদের এই আক্রমন থেমে থাকে না। আমাদের অনেক বন্ধুরাও আশপাশের এলাকা থেকে আমাদের সাথে আক্রমনে যোগ দেয়। এই সংস্কৃতি এখন শুধু আমরাই লালন করছি না, আমাদের আশপাশের এলাকার অনেকেই শুরু করেছে। আমরা ঈদের নামাজ পড়ে কোলাকুলি করে সবাই এক জায়গায় জড় হতে থাকি। তারপর সবাই একসাথে শুরু করি আমাদের আক্রমন। অন্যান্য এলাকায় দেখা যায় এক জেনারেশনের সাথে আরেক জেনারেশনের কোন পরিচয়ই নেই। একই এলাকায় থাকে অথচ কে কার ছেলে, কে কার মেয়ে, কে কার নাতি কেউ কাউকে চিনে না; ছোটরা বড়দের চিনে না, বড়রাও ছোটদের চিনে না। আমরা প্রত্যেক ঘরে ঘরে যখন যাই, অপরিচিত কেউ থাকলে কিংবা দীর্ঘদিন স্বাক্ষাত হয় না এমন কেউ থাকলে দেখা-স্বাক্ষাত হয়ে যায় ফলে এই সময়টাতে না চেনার সমস্যাটা আর থাকে না আর পুরনো চেনা জানাটাও ঝালাই হয়ে যায়।

যান্ত্রিক জীবনের ব্যাস্ততার কারণে পাশাপাশি থাকা সত্বেও সারা বছর অনেকের সাথেই কথা হয় না, দেখা হয় না, বাসায় যাওয়া হয় না। বিশেষ করে এলাকার খালাম্মা, ভাবী, আর আপাদের সাথে তো বলতে গেলে বছরের এই একটি দিন ছাড়া কুশল বিনিময় হয়ই না। এলাকার ছেলেপেলেরা এই আয়োজনকে নাম দিয়েছে আক্রমণ। এর মাধ্যমে শীমুলতলাবাসীদের মধ্যে দুরত্ব কমে, আন্তরিকতা আর একতা বাড়ে, আর বাড়ে হৃদ্যতা। তাই এলাকার সবাই চান, এই রীতি বজায় থাকুক সব সময়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

xayed777@gmail.com
ছবিঃ লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।