ঢাকা: ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে ‘শরৎ‘ এলেই বেড়ানোর জন্য মনটা উতলা হয়। বার বার মনে পড়ে : ‘আজিকে তোমার মধুর মূরতি/হেরিনু শারদ প্রভাতে/হে মাতঃবঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ/ঝরিছে অমল শোভাতে/পারে না বহিতে নদী জলভার/মাঠে মাঠে ধান ধরে নাক.../ডাকিছে দোয়েল, গাহিছে কোয়েল/তোমার কানন শোভাতে/মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী/শরত্কালের প্রভাতে।
তাই এবারের শরত্কালে ছুটলাম উত্তরের জনপদ রৌমারীর দিকে। প্রথমে বাস ধরে এলাম কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারীতে। চিলমারীর ওপারে রৌমারী।
আগেই জানতাম, নৌকায় যাতায়াতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে অনেক দূরে রৌমারী। কুড়িগ্রামেরই এক উপজেলা এই রৌমারী।
অবশ্য সড়কপথে বাসে ঢাকা থেকে শেরপুর হয়ে রৌমারীতে আজকাল যাওয়া যায়। মনে হলো, বার দুয়েক গিয়েছি—তাও তো রৌমারী অজানা জায়গা।
আগের রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত বাসে, সকালে চিলমারী। বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে এলাম তিস্তা তীরে। দেখি লোকজন নৌকায় বসে আছে। আমাকে দেখে মাঝি ভাই বললেন, রৌমারী যাবেন তো উঠুন।
নৌকায় গিয়ে বসলাম। মিনিট পনেরো পর নৌকা ছেড়ে দিলেন মাঝি ভাই। ইঞ্জিনের বাঁটটা ধরে নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। বিশাল নৌকায় আমরা মোট পনেরোজন উঠলাম। এদের মধ্যে তিনজন নেমে যাবেন রাজীবপুরে।
নৌকাতে বসে পরিচিত হলাম কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রের সঙ্গে। পরিচয় জানতে চাইলে ছেলেটি বলল—নাম আমার রতন। রৌমারীতে থাকি, বাবা কৃষক। রৌমারী কলেজে এবার ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারে আছি।
একটু হেসে বলল, শরৎ দেখব বলে রৌমারী যাচ্ছি। রতন বলল, শরতের যত রূপ, তা মিলবে রোমারীতে। ওখানে গিয়ে আপনারও বলতে ইচ্ছে হবে— ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালীমালা/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। ’
একটু পর রতন বলল, রৌমারীতে গিয়ে না হয় আমার সঙ্গেই বেড়াবেন। সীমান্ত এলাকা দাঁতভাঙ্গাতেও নিয়ে যাব।
বললাম— রতন, তা কবিতা-টবিতা লেখো নাকি। হাসল সে।
বড্ড ভালো লাগে গান। ওই যে আব্বাসউদ্দীনের গান। ওই যে—‘ও কি গাড়িয়াল ভাই/হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে। মাঝি ভাই, এই গানটা গাও না!’ এ কথা শুনে মাঝি বলল, মুড নাই; অন্য একটা গান শুনাই।
মাঝি এবার গান ধরল—‘দীক্ষা শিক্ষা না হইতে আগে করছো বিয়া/তুমি বিনে খতে গোলাম হইলে/গাইডের টাকা দিয়ারে... মাঝি বাইয়া যাওরে... বিদাশে-বিপাকে যারও ব্যাটা মারা যায়/পাড়া-পড়শী না জানিতে জানে তারও মায় ওরে...’।
গানটা শেষ করে মাঝি ভাই বললেন, ছোটবেলায় প্রায় ৫০ বছর আগে কুড়িগ্রাম শহরে গিয়ে ‘জোয়ার এলো’ নামে একটা ছবি দেখেছিলাম। ওই ছবির একটা গান শুনুন, গানটা গেয়েছিলেন আবদুল আলিম। গানটা কিন্তু উর্দু...। গান শুরু করলেন—‘তেরে ইস নদীয়ানে মুঝকো কেয়া কেয়া রঙ্গ দেখায়ে। কিতনে রঙ্গ রঙ্গিলে মাঝি গুজরে পাল উড়ায়ে...। ’
হঠাৎ দেখি তীরে কাশবন। কাশবনের পানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। রতন বলল, দেখুন দেখুন অজস্র কাশফুল। আরেকজন যাত্রী বললেন, শরতের শেষেই দুর্গাপূজা। খুব জমজমাটভাবে উদযাপন হয় দুর্গাপূজা।
ঢোল বাজে, বাদ্য বাজে... কতই না আনন্দ জমে ওঠে তখন। এ কথা শুনে রতন বলল, আমাদের ওখানের মন্দিরে এক ‘কৃষ্ণ’ আছে; ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। ভালো কীর্তন গায়। ওর কণ্ঠে গান শুনে আপনি মুগ্ধ হবেন।
একটু হেসে বললাম, এই শরতে কোনো এক রাধার সঙ্গে কী পরিচয় করাবে না? রতন বলল, ‘কেন নয়! তবে যে রাধা থাকে বৃন্দাবনে। না হয় বৃন্দাবনে নিয়ে যাব!’ দেখি নদীর এক কূলে কাশবন, দূরে, বহু দূরে দেখা যায় পাহাড়।
দেখে মনে হলো এ যে কালো মেঘ। রতন বলল, ওই পাহাড় পড়েছে ভারতের আসাম-মেঘালয় রাজ্যে। দেখুন আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কীইনা অপরূপ শরত্কাল!
এক সময় নৌকা এসে ভিড়ল চররাজীবপুর ঘাটে। এই রাজীবপুর কুড়িগ্রাম জেলারই এক উপজেলা। ওখান থেকে দু’জন যাত্রী উঠলেন। নৌকা ছেড়ে দিয়ে মাঝি গান ধরল : ‘হারালো যে মধুরলগ্ন/কাঁদে আমার মন/হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মায়ায় ঝরে ফুলদল/অজানা কোন বাঁশির সুরে/কাঁদে বনতল/ঝিকিমিকি তারায় তারায়/জাগে বাসনা...। ’

অনেক প্রতীক্ষার পর এলাম রৌমারী ঘাটে। ওখানে নেমে পায়ে হেঁটে চললাম রিকশাস্ট্যান্ডে। রতন বলল, যাবেন কোথায়? উঠবেন কোথায়? বললাম, জাপলিন নামে একজন ঘনিষ্ঠ ছোট ভাই আছে, ওর ওখানে।
রতন বলল— সে কী রাজনীতি করে? নূরুল ইসলাম পাপু মিয়ার ছেলে? হ্যাঁ বলতেই রতন—সে তো আমার চাচাতো ভাই। চলুন চলুন, বাড়িতে চলুন...। রিকশায় উঠে ছোট শহর রৌমারী দেখে দেখে এলাম জাপলিনদের বাড়ির দরজায়।
এর আগেও দু’বার এসেছিলাম, তখন তো নূরুল ইসলাম পাপু মিয়া বেঁচে ছিলেন। আজ তিনি নেই...। ইস্ পৃথিবীটা কী ক্ষণিকের!! রিকশা থেকে নেমে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এলাম জাপলিনদের বাড়ির দরজায়।
‘ও’ আমাকে দেখে তো অবাক। থাকার ব্যবস্থা করল বৈঠকখানায়। জাপলিন বলল, রতন, তুই ওই বিছানায় থাকবি, উনি ওটাতে থাকবেন।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে খানিক বিশ্রাম নিলাম। সূর্য পশ্চিমে হেলিয়ে পড়তেই রতন বলল, চলুন শরৎ দেখবেন। শৌলমারির দিকে যাবেন। এই যে রতন, এদিকে নামের শেষে মারি কেন? একটু হেসে—রৌমারীতে প্রচুর রুই মাছ ধরা পড়ত বলে এই এলাকার নাম হয়েছে রৌমারী।
রৌমারীর আশপাশের এলাকা, যেমন—বোয়ালমারীতে আস্ত বোয়াল মাছ, শৌলমারিতে শৌল মাছ, বাউশমারিতে বাউশ মাছ, বালিয়ামারিতে বালিয়া মাছ পাওয়া যেত বলেই এসব এলাকার নামকরণ মাছের নামানুসারে।
একটু এগিয়ে দেখি চারদিকে পানি। এদিকে বিলাঞ্চল, ওদিকেও বিলাঞ্চল। রতন বলল, ওই যে বটগাছটা দেখছেন ওখানে গিয়ে বসি। দিনের বেলা প্রেমিক-প্রেমিকারা ওখানে বসে কত যে স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধার।
বললাম, এই রতন তুমি প্রেম-ট্রেম কর না? ‘আরে দাদা কী যে বলেন, বয়স সবে মাত্র সতেরো চলছে। এ বয়সে কেউ কী আর প্রেম করে? তবে আমাদের রৌমারীতে বাল্যবিবাহ অথহরহ ঘটছে। ’
বটতলায় খানিক সময় কাটিয়ে এবার চললাম রাস্তার দিকে। দেখি লোকজনের ভিড়। সাপের খেলা দেখাচ্ছে বেদেনীরা। ওদের কণ্ঠে চিরাচরিত সেই গান—‘কি সাপে দংশিল লখাইরে/তাই আমারে বলো রে বিধি কি হইল/হাতে লাঠি মাথায় ছাতি/সোনার খড়ম পায়/ধীরে ধীরে বিশাই কামার/বাসর বাঁধতে যায়...বখখিলারে খা কিরপানারে খা...। ’
বড় বড় সাপ দেখে তো অবাক। খানিক সময় কাটিয়ে রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে চললাম দু’জনে। যেদিকে তাকাই দেখি—যা কিছু আছে তা যেন এক দ্বীপের মতো। দূরে কত নাম না জানা গাছ। আরও দূরে ছোট্ট এক কুটির। আরেকদিকে দেখি কাশবন। রতন বলল, ‘চলুন ঐ যে কাশবনে কাশফুল ফুটেছে। শরতের প্রতিচ্ছবিইতো ‘কাশবন’ আর সাদা মেঘের ভেলা।
সাদা মেঘের ভেলা সে তো আকাশে, তাতো স্পর্শ করা যায় না! তবে কাশফুল স্পর্শ করা যায়। বারে বারে কাশফুল স্পর্শ করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
এবার রতন বলল, ওই যে কুটির দেখছেন ওখানে চলুন। কিছু সময় পার করি। একটি সুপারি গাছের সাঁকো পেরিয়ে এলাম এক কুটিরে। রতনকে ওখানের সবাই চেনে। আমাদের দেখে ওই বাড়ির গৃহিণী বলল, পায়েস খাবেন বসুন। পিঁড়িতে বসলাম দু’জনে। একটু পরে এলো পায়েস।
গৃহিণী বললেন, রতন তোর বন্ধু কৃষ্ণ একটু পরেই আসবে...। কথাটা শেষ না হতেই দেখি সতেরো বছর বয়সী এক ছেলে এসে উপস্থিত। রতন বলল, উনি আমার দাদা। কৃষ্ণ, দাদা- কিন্তু শরতের রূপ দেখবে বলে রৌমারীতে এসেছে।
কৃষ্ণ গান ধরলো : ‘সজল নয়ন করি প্রিয়া পথ হেরি হেরি... তারে এক তিলে না হেরিলে শত যুগ মনে হয় বিধি বড় দারুণ... পাখি যদি হও প্রিয়া পাশে উড়ে যাও...’ ।
গানের কথাগুলো শুনে মনে হলো, শরৎ দেখা যে আমার সফল হলো। ততক্ষণে রাত আটটা বেজে গেছে। শরতের রাতে রৌমারীর গাঁয়ের পথ ধরে চললাম, সঙ্গে কৃষ্ণও আছে। দেখি, দূরে দূরে কারা যেন আলো জ্বেলে আছে।
ওদিকে আকাশে মেঘের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। মেঘে ঢেকে আছে চাঁদটা...। তাই চারদিক অন্ধকার মনে হলো। ঘোর অন্ধকারে আমরা পথ চলছি। ওরা দু’জনে বলল, দ্রুত চলুন। বৃষ্টি আসবে ধেয়ে। বললাম, শরতের রাত দেখে দেখে আঁখি না ফেরে।
ওদিকে কৃষ্ণ বেশ উচ্চস্বরে গান ধরলো : ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে/আয় রিমঝিম বরষায় গগনে/... ফুল ফলে ভরিতে চায় সোনার কামনা/এ জীবন মাটির মতন...। ’
জাপলিনের বাড়ির দুয়ারে পৌঁছতেই শুরু হলো মুষল ধারায় বৃষ্টি। রতন বলল, কৃষ্ণ খেয়ে-দেয়ে ঘুমা। সকালে আসব...। শরতের সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না।
খুব ভোরে উঠে দেখি চারদিকে জল থৈ থৈ করছে। কৃষ্ণ বলল, দাদা আমাকে এখনই যেতে হবে—দুয়ারে বসে বসে দেখে নিন শরতের রূপ। সন্ধ্যার ক্ষণে না হয় আসব। অবশেষে গানের ভাষায় কৃষ্ণ শুনিয়ে গেল : ‘বরষা-মুখর রাতে ফাগুন সমীরণে/এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান/ভুলতে সে কি পার, ভুলিয়েছ মোর প্রাণ...। ’
রৌমারী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য: রাত যাপন করার জন্য রৌমারীতে উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলো ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি দফতরের গেস্ট হাউস রয়েছে। এখানে দেখবেন বিলাঞ্চল আর ফসলের ক্ষেত।
এক সময় রৌমারী ব্রহ্মপুত্র নদীগর্ভে ছিল। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে এখানে চর জেগে ওঠে। আর এভাবেই রৌমারীর পত্তন ঘটে। এখানের সীমান্তে দাঁড়িয়ে ওপারের পাহাড় চূড়ায় দেখা মেলে এক মন্দির।
একদা নৌপথে রৌমারীর দাঁতভাঙা ও শৌলমারির সঙ্গে আসামের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। আজ আর তা নেই। কয়েক বছর আগে চিলমারি হয়ে নদীপথে রৌমারী যাওয়ার একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল।
সময়ে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি রৌমারীর বাস যায় শেরপুর হয়ে। সময় লাগে আট ঘণ্টা। রৌমারী ভ্রমণে হাজার তিনেক টাকা নিয়ে গেলেই চলবে।
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে রৌমারীগামী বাস যেমন—সিয়াম ও রিফাত। বিস্তারিত তথ্য জানতে লেখককে ফোন করুন—০১৭১৫২৩১৬৭৫ নম্বরে।
বাংলাদেশ সময় : ১১১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৩
এসএস/ এসআরএস