কানাডা (টরেন্টো) থেকে: টরন্টোকে ঢাকা আর নিউ ইয়র্ককে কলকাতা মনে হয়। কারণহীনভাবে এভাবে মেলাতে চেষ্টা করি।
এবার নিউ ইয়র্ক না, সিদ্ধান্ত নিলাম অন্য কোথাও যাবো। আর তখনই আমাদের সাংবাদিক বন্ধু কাউসার খানের ছোটভাই স্বপন বলল, চলেন ওহাইও থেকে ঘুরে আসি। সময়ের হিসেব-নিকেশ করে রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গে আরো যাচ্ছেন- আর্কিটেক্ট মনিবুর রহমান।
সকাল সাড়ে ১১টায় আমাদের কুচকুচে কালো জিপটা উইঞ্জরের দিকে যাত্রা শুরু করলো। স্বপন-মুনির দু’জনেই ড্রাইভ করেন। আমি তো পারিনা। তাই পেছনের সিটে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সেখান থেকেই চললো ত্রিমুখী আড্ডা। আর মাঝে মাঝে যাত্রা বিরতির ফাঁকে ফাঁকে ম্যাকডোনাল্ড’স বা স্টর্কবার্কের চা-কফি।
এখন সামারের শেষ। তবু সবুজের সমারোহের শেষ নেই। চারদিকে মন মাতানো সবুঝের ছড়াছড়ি। সবুজ পাহাড়। সবুজ মাঠ। সবুজের ভেতর ঘরবাড়ি। সবুজের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নদী-লেক।
দেখতে দেখতে, আড্ডা দিতে দিতে আমরা যেনো ‘বেনাপোল’এ এসে পড়লাম। ‘বেনাপোল’ মানে উইঞ্জর বর্ডার আর ওপারে ‘বনগাঁও’ মানে- মিশিগান বর্ডার। সীমান্ত দেখলেই মনে পড়ে যায়, জাহাঙ্গীর ফিরোজের কবিতার কথা- কেন এই কাঁটা তার কাঁটা তার খেলা?
বর্ডার পার হওয়ার আগে একটা থাই রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারছি। স্বপন ভাই বললেন, ওপারে আলাদিনের বিরিআনির দোকান আছে। আলাদিনের মিষ্টি থেকে এবার আলাদিনের বিরিআনি! বাহ, ফেরার সময় বিরিআনি খাবো। ইতোমধ্যে দেখলাম, অনেক দূর থেকেই আমেরিকান বর্ডার আমাদের গাড়ি স্ক্যান করে নিয়েছে।
আমাদের কানাডিয়ান পাসপোর্ট। আমেরিকা তো কানাডার সহোদর। তাই ‘দাদাগিরি’ ভাবটা আছে। যতোবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছি, ততোবারই খেয়াল করেছি, আমেরিকান ইমিগ্রেশন আর বর্ডার সার্ভিস প্রত্যেকেই মনে করে ওসামা বিন লাদেন। তাদের ভাবটা যেনো এ রকমই!
২০০৯ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে নায়াগ্রা-বাফেলো সীমান্ত দিয়ে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার সময় ইমিগ্রশনের অফিসার আমার পেশা ‘কবি ও সাংবাদিক’ দেখে মজা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, লিখতে লিখতে হস্তচিহ্ন চলে গেছে, তাই তোমার পায়ের ছাপ নিতে হবে।
পাসপোর্ট দেখে বলল, তোমার ইউএস ভিসা আছে ২০১৯ পর্যন্ত আর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৭-তে। আমি ‘হুম’ বলতে বলতে টিপসইয়ের মতো ফিংগার প্রিন্ট দিলাম। মনে হয়েছিলো যেনো নাকে খত দিচ্ছি। এখন আর ‘নাকে খত’ দিয়ে হয়না।
তারপর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে পাসপোর্টের সঙ্গে চেহারা মেলানো, পাসপোর্ট স্ক্যান, নানান প্রশ্ন- কেন যাচ্ছি ইত্যাদি পর্ব সেরে কলম্বাসের পথ আর পদ অনুসরণ করলাম। মজার ব্যাপার হাইওর রাজধানী হচ্ছে কলম্বাস। আর এই আমেরিকা আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের রয়েছে স্মৃতিচিহ্ন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আমরা রাতে এয়ার ব্যাজ এলাকার রাইট প্যাটার সনের থ্রি পয়েন্ট ফাইফ স্টার হোটেল বে-মাউন্টে উঠলাম। নামে মাত্র থ্রি পয়েন্ট ফাইফ। আসলে টু-স্টার। আমরা আমাদের ব্যাগ-ল্যাগেজ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম রাতের শহর দেখার জন্য। যেকোনো রাতের অচেনা শহরই মায়াবি মায়াবি মনে হয়। আমাদের হোটেলের অদূরে মনোরম গলফ খেলার মাঠের পাশেই স্বপন ভাইয়ের মিনি ‘রাজপ্রসাদ’। যার পেছনে হরিণ চরে বেড়ায় মনের আনন্দে।
স্বপন ভাই ফ্লোরিডা থেকে ‘মাইগ্রেড’ করে হাইওয়ের ডেইটনে এসেছেন। অনেক দিন এই শহরে থেকেছেন, ব্যবসা করেছেন। তাই ডেইটনের নাড়ী নক্ষত্র তার জানা। তিনি এখন টরন্টোতে ব্যবসা করলেও দুই ছেলে নাবিল আর নাশিকের টানে মাঝে মধ্যেই আসেন।
হাইওয়ের ডেইটন খুব ছিমছাম, সুন্দর সিটি। ভিড় নেই। মার্কেটগুলো ভিন্নভাবে সাজানো। এক শপিং সেন্টার থেকে অন্যটা বেশ দূরে দূরে। হেঁটে যাওয়া কষ্টকর। কারণ, এখানে যারা বসবাস করেন, তাদের সবারই গাড়ি আছে।
তাই, শহরেও পাবলিক বাস খুব কম। এখানে ইন্ডিয়ানদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। মার্কেট, রেস্টরেন্ট ছাড়াও তারা বিশাল এক বেসরকারি ‘রাজশায়ন হসপিটাল’ স্থাপন করেছে। যা চোখে পড়ার মতো। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়লো একটা বইয়ের দোকান। নাম- Half Price Book. এই দোকানে সব বইয়ের মূল্যই অর্ধেক। ভালো লাগলো।
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ওহাইও। ওহাইওতে উড়োজাহাজের আবিষ্কারক (১৯০৩, ১৭ ডিসেম্বর) দুই ভাইয়ের রাইট ব্রাদার্স এবং প্রথম চন্দ্রবিজয়ী (১৯৬৯, ২৬ জুলাই) নীল আর্মস্টংয়ের জন্মস্থান। ওহাইওর রাজধানী কলম্বাসে রয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারক জাহাজ শান্তা মারিয়া’র মূল জাহাজের রেপ্লিকা। আর এখানকার স্টিভেন স্পিলবার্গ এমন এক চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি বর্তমানের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিচরণ করে বেড়ান ভবিষ্যতের বিস্ময় ভুবনে।
কথিত হলেও সত্য, এই প্রভিন্সে যে দলের প্রার্থী জেতেন, সেই দল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার চাবি হাতে পায়। ওহাইও জেতা নিয়ে খানিকটা আবেগ ও ইতিহাসও আছে। সাধারণভাবে বলা হয়, ওহাইও যে দিকে যায়, দেশ যায় সে দিকেই।
মইনুল রাজু লিখেছেন, ‘আমেরিকায় ওহাইওকে বলা হয়ে থাকে bellwether স্টেট। এটি একই সঙ্গে swing (দুলন্ত/ঝুলে থাকা) স্টেটও। শব্দ দু’টি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। swing শব্দটি ওহাইওর নির্বাচন পূর্ববর্তী আর bellwether শব্দটি নির্বাচন পরবর্তী অবস্থার জন্য দেওয়া নাম। অতএব, রূপকথার্থে ওহাইওর দেখানো পথে অন্যরা হেঁটে যায়, বিধায় এটি bellwether স্টেট।
ইংরেরি weather শব্দটার সাথে পরিচয় থাকলেও অনেকটা একই উচ্চারণের wether এর সঙ্গে তেমনটা নেই। তার উপর সেটার অর্থ যদি হয় একটি খাসি করা মেষ বা ভেড়া (A castrated ram). তাহলেতো কথাই নেই। ...এই নেতৃস্থানীয় ভেড়াটির (wether) গলায় ক্ষেত্রবিশেষে একটি ঘণ্টা (bell) ঝুলিয়ে দেওয়ার কারণে, ইংরেজিতে এর নাম হয়ে যায় bellwether। বিড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধার মতোই রূপকার্থে ভেড়ার গলায় ঘণ্টা বাঁধা কাজ। ’
ওহাইওতে চার-চারটি শহর আছে- ডেইটন, সিনসিনাটি, ক্লিভল্যান্ড এবং কলম্বাস। ওহাইওরা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। যেমন ১৮৬৫ সালে সর্বপ্রথম অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করার কৃতিত্ব সিনসিনাটি শহরের।
অন্যদিকে, আমেরিকায় সর্বপ্রথম ট্রাফিক লাইট স্থাপন নিয়ে গর্ব করে ক্লিভল্যান্ডবাসী। এদিকে ডেইটন-নিবাসীরাতো অরবিল রাইট আর উইলভার রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের কৃতিত্বে গর্বিত। আর আমেরিকা আবিষ্কারক কলম্বাস নামকরণে কলম্বাসবাসীরাও অহংকারী।
এদিকে ডেইটনের এয়ার বেইজও আমেরিকার অন্যতম এয়ার বেইজ। ফলে বিমান বাহিনীর পোশাক পরা তরুণ চোখে পড়ার মতো। সেই সঙ্গে তরুণ শিক্ষার্থী। ডেইটনে অনেকগুলো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে রাইট ব্রাদার্স অন্যতম। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রায় ষাট হাজারের কাছাকাছি স্টুডেন্ট এখানে পড়েন। কিন্তু, বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বড় ক্যাম্পাস হলেও পরিকল্পিত আর চমৎকার করে সাজানো। তবে ঘুরে ঘুরে মজা পেলাম ইয়ালো প্রিংয়ের এন্টিইয়াগ ইউনিভার্সিটি দেখে। অনেকটা শান্তি নিকেতনের আদলে গড়া। এই ভার্সিটির বৈশিষ্ট্য হলো শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলা-নাট্যকলায় সমৃদ্ধ। আর ইয়ালো প্রিং এলাকাটা জার্মানদের প্রাধান্য।
নাশিকের জন্মদিনে ইউশ করা, ঘুরে বেড়ানো, টুকটাক শপিং, সিনেমা দেখা আর আড্ডায় আড্ডায় কেটে গেলো তিন দিন। মজার ব্যাপার, ৯/১১ সময় বুশকে ফ্লোরিডা থেকে তুলে এনে ডেইটনের বিখ্যাত এয়ার ফোর্স বেইজের ‘গর্তে’ লুকিয়ে রেখেছিলো। অনেক কিছু দেখালাম, কিন্তু সেই ‘ইঁদুরের গর্ত’টা দেখা হলোনা!
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: কবি ও সাংবাদিক, saifullahdulal@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৩
এএ/এমজেডআর