রাজধানী ঢাকায় শিশুদের স্কুলের কোনো অভাব নেই। এ শহরের সব গলিতেই কমপক্ষে একটি স্কুল তো চোখে পড়বেই।
শুধু তাই নয়, চাকরিজীবী মা-বাবাদের জন্য সন্তানের স্কুলে ভর্তি নিয়েও আছে নানান অভিযোগ। আবার আমাদের দেশে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলেও সেগুলোতে নেই উন্নতমানের কোনো ব্যবস্থা। এমন সব সমস্যা পড়েই লীনা ফেরদৌস নিজেই একটি স্কুল শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন ২০১২ সালে।
অনেকটা একক উদ্যোগে তিনি রাজধানীর উত্তরায় গড়ে তুলেছেন ‘কিডস্ লিডস্’ প্রতিষ্ঠান। একে তিনি বলতে চান প্রি-স্কুল। স্কুলে যাওয়ার আগে অন্তত এক বছর প্রি-স্কুলিং হলে শিশুদের মনের অন্যরকম বিকাশ ঘটে।
লীনা ফেরদৌসের ভিন্নরকম এ উদ্যোগ নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন বাংলানিউজে। নিজের স্বপ্ন ও কিডস লিডসের শিক্ষা পদ্ধতিও তুলে ধরেছেন আলোচনায়।
এমন উদ্যোগের পেছনের গল্প কি?
উত্তরায় আমার মেয়ে মেঘলীনা মাধুর্যের জন্য অনেক ডে-কেয়ার সেন্টার খুঁজেছি। আমি চাকরি করি। সারাদিন অফিস করে মেয়ের দেখাশোনা করা খুবই কঠিন। এ জন্যই ডে-কেয়ার সেন্টার খুঁজে বেরিয়েছি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি ভালো কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার খুঁজে পাইনি। দু একটা যাও আছে তা আবার মানের দিক থেকে খুব একটা ভালো না। আমি চাই মেঘলীনা এমন একটি পরিবেশে থাকবে, যেখান থেকে সে পড়াশোনা এবং সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ হবে।
প্রতিটি শিশুর সুন্দর শৈশবের অধিকার আছে। আমারও সুন্দর একটি শৈশব আছে। আমার মেয়েকেও স্মৃতিতে মনে রাখার মতো শৈশব দিতে চাই। চেয়েছি আমার মেয়ে খেলবে, রঙ তুলি দিয়ে ছবি আঁকবে, গান গাইবে, নাচবে।
কিন্তু এমন কোনো সেন্টার আমি খুঁজে পাইনি যেখানে আমার মেয়ের সুস্থ মানসিক বিকাশ হবে। এ জন্যই ২০১২ সালে আমি কিডস্ লিডস্ শুরু করি। একে বলা যেতে পারে আগে নিজে সমস্যায় পড়েছি। তারপর সবার জন্য সে সমস্যার সমাধান বের করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ উদ্যোগে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?
এটি আমার একার উদ্যোগ হলেও একটি উপদেষ্টা পর্ষদ আছে। তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। এদের সবাই কোনো না কোনো স্কুলের শিক্ষক। তাদের তত্ত্বাবধানে এবং সিলেবাসেই কিডস লিডস পরিচালিত হয়।
‘কিডস্ লিডস্’ নামের অর্থ কি?
নামটা অনেক ভেবেই দেওয়া। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু কাল দেশে ও জাতিরও ভবিষ্যৎ। দেশটা তাদেরই গড়তে হবে। এগিয়ে নিতে হবে। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব প্রতিভা গড়ে তুলতে হবে। এসব চিন্তা করেই কিডস্ লিডস্ কাজ করছে।
কিডস অর্থ শিশু। লিডস শব্দটি নেওয়া হচ্ছে লিডার থেকে। অর্থাৎ নেতা। আমরা দেশ ও সমাজ গড়ার কারিগরদের মনোবিকাশের কাজ করছি।
এ পথচলায় বিড়ম্বনা এবং সফলতা দিকগুলো কেমন?
আমাদের দেশে প্রি-স্কুল বিষয়টি একদমই অজানা। অনেকেই এ স্কুলিং সম্পর্কে একেবারেই জানেন না। আমাদের দেশে তো সরাসরি স্কুলেই বাচ্চাদের ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। এ জন্য মানসিকভাবে তারা কিছুটা ভয়েও থাকে।
কিন্তু প্রি-স্কুল থাকলে এ ভয়টি দূর করা সম্ভব। প্রি-স্কুল হচ্ছে স্কুল শুরু করার আগে শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য বিশেষ স্কুল। যেখানে বাচ্চারা খেলতে খেলতেই অনেক কিছু শিখতে পারবে। ভবিষ্যৎ স্কুল আবহের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
তো, কিডস লিডস শুরু করার পর আমার প্রথম সমস্যা ছিল ‘প্রি-স্কুল’ ধারণা কারও ছিল না। পিতা-মাতাকে এ বিষয়ে বোঝাতে হয়েছে। এটা সচেতনতা তৈরি করতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
এখানে যেমন শিশুরা পানি নিয়ে খেলে। মাটি নিয়ে খেলে। অনেকেই মনে করেন পানি বা মাটি দিয়ে খেললে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এমন খেলাধুলা শিশুদের প্রতিভা বিকাশে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। এ বিষয়গুলোও কিন্তু বাবা-মাকে বোঝাতে হয়েছে। যাতে তারা চিন্তিত না হয়ে পড়েন।
তবে প্রকৃত সফলতা এখনও আসেনি। কষ্ট করছি। নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছি। এখনও কিডস্ লিডস্ তেমনভাবে মানুষ বুঝতে পারছে না। তবে আস্তে আস্তে অবশ্যই প্রি-স্কুলের প্রয়োজনীয়তা সবাই বুঝতে পারবে।
শিশুরা এখানে কি শিখবে?
এখানে শিশুরা যা ইচ্ছা তাই করে। খেলতে ইচ্ছা করলে খেলবে। গান গাইতে ইচ্ছা করলে গান গাইবে। গল্প বলতে চাইলে বলবে। তারা ফুলের বাগান তৈরি করে। সেটার পরিচর্যা করে। মাটি দিয়ে খেলে। তারা মনের রঙে সব কিছুই সাজাতে পারে। এসব কিছুর মধ্যেই তারা অনেক কিছু শিখতে পারে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা?
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে কিডস্ লিডসকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষকে প্রি-স্কুল বিষয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। তারপর একে প্রাইমারি অবধি নিয়ে যাওয়া। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ে আসা যেখানে বইয়ের ভারে শিশুরা যেন চাপা না পড়ে। তাদের কাছে পড়া যেন খেলার মতোই সহজ আর মজার হয়ে ওঠে। তাদের স্বপ্নের জগৎ যেন তারাই গড়ে তুলতে পারে। তাদের রঙের তুলিতেই যেন তাদের ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান/জিসিপি