বাঙ্গালি ভ্রমণ পিপাসু। তবে অনেক সময় সুযোগের অভাবে বিদেশ ভ্রমন হয়ে ওঠেনা।
একটার পর একটা, ক্লান্তিহীন, অবিরত সমুদ্রের বুকে তৈরি হওয়া বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটের বালিয়াড়িতে। যতদূর চোখ যায়, ঠিক যেখানে জল আর আকাশ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে ঠিক সেই জায়গাটায় অন্ধকার সরিয়ে প্রথম ভোর হয়।
দিগন্ত পার থেকে গোটা আকাশে খুশির রক্তিম আবির ছড়িয়ে হয় সূর্যোদয়। রাতের গভীর অন্ধকার উত্তীর্ণ হয়ে গোটা চরাচর জুড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ভৈরবী রাগ। সূর্যের প্রথম ছটা বিচ্ছুরিত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সমুদ্র। ঘুম থকে জেগে ওঠে সমুদ্র সুন্দরী ‘দীঘা’।
দীঘা, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সমুদ্র কেন্দ্রীক ভ্রমণ কেন্দ্র। কলকাতা থেকে মাত্র ১৮৭ কিলোমিটার দূরে মেদিনিপুর জেলায় সমুদ্র, বালিয়াড়ি, ঝাউ বন আর আপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলিয়ে অপেক্ষা করছে প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের জন্য।
৭ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতট এক পাশে গভীর সমুদ্র অন্যপাশে ঝাউ গছের অগভীর জঙ্গল। ভেঙ্গে পড়া ঢেউ-এর জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় দীর্ঘ পথ। সকালের সমুদ্র তটে দেখা মিলবে পায়ে পায়ে হেঁটে চলা নানা বর্ণের শামুক ,ঝিনুক এবং ছোট বড় শঙ্খের।
দীঘায় দু’টি সৈকত রয়েছে একটি পুরানো দীঘার সৈকত, অপরটি নতুন দীঘার সৈকত। বাঙালির এই পর্যটন কেন্দ্রের আছে এক লম্বা ইতিহাস। আজকের দীঘা ছিল অতীতের বীরকুল। সময়টা ইংরেজ আমলের।
১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিন্স স্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে জানাচ্ছেন এই বীরকুলের সৌন্দর্যের কথা। তিনি লিখেছিলেন আজকের বাঙালির প্রিয় সেই সময়ের দীঘার অপূর্ব প্রাকৃতিক রূপ কিভাবে তাকে মুগ্ধ করেছে।
এরপর ১৯২৩ সাল ইংরেজ পর্যটক জন ফ্রাঙ্ক স্মি্থ হাজির হলেন সেই বীরপুরে। মুগ্ধ হলেন তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। আর এই মুগ্ধতার আবেশে তিনি বাকি জীবনটা রয়ে গেলেন ঐ সমুদ্রের পাড়ে।
সেই সময় উত্তাল গোটা ভারত। একদিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই আর সেই লড়াইয়ের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র মেদিনিপুর। শহীদ ক্ষুদিরামের আর মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মত্যাগে উজ্জীবীত গোটা বাঙলাসহ ভারত।
এর পরেই বঙ্গভঙ্গ। আবার বাঙলা ভাঙ্গার প্রতিবাদে সোচ্চার পশ্চিমবঙ্গ। পূর্বভাগে সেই মেদিনিপুর। স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায়। তিনি ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করলেন পশ্চিমবঙ্গকে। তাকে বলা হোল পশ্চিমবঙ্গের রূপকার।
পশ্চিমবঙ্গের এই রূপকারের দপ্তরে একদিন হাজির হলেন জন ফ্রাঙ্ক স্মি্থ সাহেব। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন সাজিয়ে তুলতে দীঘাকে। বুঝিয়ে বললেন দিঘা আগামী দিনে কেন গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ভ্রমণের জায়গা হিসেবে স্থান করে নেবে। পরিকল্পনা করা হোল এক পর্যটনকেন্দ্রের গড়ে উঠল আজকের দীঘা।
কি ভাবে যাওয়া
প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশ থেকে বহু পর্যটক দীঘায় বেড়াতে যান। কলকাতা থকে ১৮৭ কিলোমিটার দূরত্বের এই সমুদ্র শহরে যাওয়ার জন্য আছে রেলপথ। কলকাতা থেকে রেলে চেপে পৌছনো যায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার মধ্যে।
চোখ জুড়িয়ে যাবে পথের প্রাকৃতিক শোভায়। সবুজ ধান ক্ষেত, মেঠো পথ, রেল লাইন থেকে দূরের ছোট্টো গ্রাম আর সেই গ্রামকে জড়িয়ে চলেছে সরু নদী। দ্রুত গতিতে রেলের জানলা দিয়ে চোখে পড়বে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ। যা ছবির মত স্থান করে নেবে মস্তিষ্কের মনি কোঠায়। ঠিক যেন এক চলমান ‘ল্যান্ড স্কেপ’।
যাওয়া যায় সড়ক পথেও। আছে সোনালি ত্রিভুজের রাস্তা। ঝড়ের গতিতে ছুটতে ছুটতে মাঝপথে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম। জাতীয় সড়কের ধারে কোন হোটেলে বা পাঞ্জাবি ধাবায় জমিয়ে করা যেতে পারে খাওয়া-দাওয়া। তারপর আবার দীঘার অভিমুখে যাত্রা শুরু।
কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে আছে সরকারি-বেসরকারি বাস এর ব্যবস্থা। বাসে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন দীঘা। মাঝ পথে থাকবে কিছুক্ষণের বিশ্রাম।
রাত্রি বাস
পুরানো দীঘা এবং নতুন দীঘায় আছে অনেক হোটেল। রেল স্টেশনটি নতুন দীঘায়। বাস থামে পুরানো দীঘায়। হোটেল গুলিতে আছে আধুনিক সব ব্যবস্থা। পছন্দমত কোন একটা বেছে নিলেই হোল। তবে আগে থেকে “বুকিং” করে রাখলে সুবিধা হবে।
সমুদ্র স্নান
একদিন পুরানো দীঘায় আরেক দিন নতুন দীঘায় স্নান করে দেখতে পারেন। সমুদ্রের তীরে ছাউনির তলায় বসে ডাব খেতে ভুলবেন না। কোনভাবেই সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার অভিঞ্জতাটি হাতছাড়া করবেন না।
দীঘার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তর নয়নাভিরাম দৃশ্য সকলের মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। সন্ধ্যে বেলায় পুরানো দীঘার সমুদ্র তটের ধারে বসে হরেক রকমের দোকান। ঝিনুকের তৈরি গয়না, ঘর সাজাবার জিনিষ, নানা ধরনে শঙ্খ, শামুক, প্রবাল ইত্যাদি দিয়ে অপূর্ব সুন্দের সব জিনিষ। এছাড়াও আছে মেদেনিপুরের বিখ্যাত মাদুর এবং বাঁশের তৈরি নানা ধরনের শিল্প কর্ম।
সন্ধ্যে বেলায় সমুদ্রের পাড়ে বসলে দেখতে পাবেন সমুদ্রের আর এক রূপ। সমুদ্র তখন উত্তাল। কোটালের সময় হলে তো কথাই নেই। বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে তটের উপর। সকালে পুরানো দীঘার যেসব জায়গা দিয়ে হেঁটেছেন দেখতে পাবেন সেই সব জায়গা জলের তলায়। সমুদ্র পাড়েই ফেরি হয় মুক্তা কিংবা নানা রঙের সমুদ্রের পাথর। সঙ্গে সেই সব পাথর আর মুক্তার গয়না।
খাওয়া দাওয়া
ভোজন রসিক বাঙালি কথাটা দুই বাংলাতেই সমানভাবে প্রযোজ্য। হোটেলে পাবেন আপনার পছন্দ অনুযায়ী সব কিছু। নানা ধরনের মাছ থকে শুরু করে চাইনিজ, ,মোগলাই, থাই কিংবা ইতালিও খাবার দাবার।
সমুদ্রের ধারে আছে মাছ ভাজার দোকান। সেখানে পমফ্রেট, চিংড়ি থেকে শুরু করে রকমারি মাছ ভাজার আয়োজন। একবার চেখে দেখতেই পারেন। তবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটি যদি আপনার জন্য হয়ে থাকে তবে খুব সকালে একবার হাজির হতেই পারেন বাজারে কিংবা সমুদ্রে থেকে ফেরা মৎস্যজীবীদের কাছে।
কিছুটা ঘোরা-ঘুরি
দীঘাতে গেলে অবশ্যই একবার ঢুঁ মারবেন “দ্যা মেরিন অ্যাকরিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে”। সমুদ্রতলার গোটা জগত নিয়ে তৈরি এই মেরিন অ্যাকরিয়াম। শুধু দেখা নয় জানতে পাড়বেন বিভিন্ন গবেষণার তথ্যও।
১৯৮৯ সালে ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই মেরিন অ্যাকরিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার তৈরি করা হয়। যেটা আজ ভারতের সমুদ্র গবেষণার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
কিছুটা দুরেই অমরাবতী লেক। এখানে কিছুটা সময় “বোটিং” করে কাটাতে পারেন। এর পাশেই আছে সর্প উদ্যান।
দীঘা থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে আছে সুবর্ণরেখা নদী । পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা সীমান্তে এই নদীর রূপ মাধুরী আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
দেখে আসতে পারেন ঐতিহাসিক চন্দনেশ্বর মন্দির।
দীঘার আশে-পাশে আছে আরও কয়েকটি সমুদ্র সৈকত। প্রতিটি সৈকতই একে অপরের থেকে আলাদা। এই সৈকত ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র। ঘুরে আসতে পারেন ঐ সমুদ্রে সৈকত গুলিতেও। কাটিয়ে আসতে পারেন কয়েকটা দিন। এর মধ্যে শঙ্করপুর, উদয় পুর, তালশারি, মন্দারমুনি অন্যতম।
কাজের ফাঁকে কিংবা কলকাতা এলে কয়েকদিনের জন্য কাটিয়ে আসতেই পারেন দীঘায়। খুঁজে নিতে পারেন সমুদ্র সৈকত আর ঝাউবনের মাঝে প্রকৃতির কোলে মনের শান্তি।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৩
ভিএস/এসএস/জিসিপি
ফিচার
সমুদ্র সুন্দরী ‘দীঘা’য় কয়েক দিন
| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।