ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়া

আহমাদুর রহমান অনিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০৫, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৩
লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়া

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দ, মহাবীর অ্যালেকজান্ডার আলেকজান্দ্রিয়াকে তার সদ্য জয় করা রোমান ও বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করলেন। এর পিছনে ছিল তার শিক্ষা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়নের মনোবাসনা।

তার শাসনামলেই আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৮ অব্দে টলেমি- ১, ফেলেরনে’র দিমিত্রিয়াস এর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেন   “লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়া”। লাইব্রেরিটি এথেন্সে অবস্থিত অ্যারিস্টটলের বক্তৃতা কক্ষ (Lyceum) এর আদলে নির্মাণ করা হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার সকল আবিষ্কার ও দলিলের সাক্ষী হয়ে ছিল এই লাইব্রেরি।

প্রথমদিকে লাইব্রেরিটি গ্রীক দেবী  “Muse” (যিনি কাব্য, সংগীত ও সাহিত্যের দেবী ছিলেন) এর মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে তা বিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সে যুগের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ গবেষণা ও নিজেদের তত্ত্ব-চিন্তা প্রকাশ করবার জন্য দলে-দলে এখানে এসে জড়ো হতেন। মূল লাইব্রেরিটি শহরের অভিজাত অংশে অবস্থিত ছিল এবং এর পাশেই একটি সংরক্ষণাগার ছিল। এর বিস্তৃতি এতই ছিল যে, আরেকটি সাহায্যকারী অংশ যেটি  “Daughter Library” হিসেবে পরিছিত ছিল, সেটি শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সেরাপিয়াম নামক অংশে নির্মাণ করা হয়। লাইব্রেরিটি সকল ভাষার, সংস্কৃতির এবং নারী-পুরুষ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। প্রায় ১০০ জন পণ্ডিত সর্বক্ষণের জন্য এখানে অবস্থান করে লেখালেখি, গবেষণা, অনুবাদ, অনুলিপি প্রভৃতি কার্য সম্পাদন করতেন। alexandria

অনেকের মতে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে ৭ লক্ষের মত চামরা বা কাগজে পেচানো প্রাচীন গ্রন্থ, ১ লক্ষেরও ওপর ছাপানো গ্রন্থ কাঠের শেলফে সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে অ্যাসিরিয়া, গ্রীস, পারস্য, মিশর, ভারতবর্ষ প্রভৃতি অঞ্চলের মূল্যবান দলিলও রয়েছে।

প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিলঃ

# একটি সুত্রমতে, টলেমি ৭২ জন র‌্যাবিস (একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য ইহুদি গোত্রের নেতা) কে হিব্রু ধর্মীয় বাণীকে হিব্রু থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার জন্য আহ্বান জানান। এটাকে বলা হত  “Septuagint” যা বাইবেলের একটি ভার্সন হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় বা ৩য় শতকে হেলেনীয় ইহুদী ও পূর্ববর্তী খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক কর্তৃক ব্যবহৃত হত।

# অ্যারিস্টার্কাস ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কোপার্নিকাসের ১৮০০ বছর পূর্বে বলেছিলেন যে, “পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে”।

# এরাটোস্থেন্স, কলম্বাসের ১৭০০ বছর পূর্বে প্রমাণ করেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং তিনি প্রায় নির্ভুলভাবে এর পরিধি হিসাব করেন।

# হিপার্কাস সর্বপ্রথম তারকাদের গতিপথ নির্ণয় করেন এবং সাড়ে ছয় মিনিটের মধ্যে সৌরবছর হিসাব করেন।

# কবি ক্যালিমাকাসকে বলা হয় লাইব্রেরীবিদ্যার জনক, তিনি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর পুস্তক সমূহকে বিষয় ও লেখক অনুসারে সজ্জিত করেন।

# ইউক্লিড রচনা করেন  “Elements” গ্রন্থটি, যেটি এখনও সারা পৃথিবীর স্কুলগুলোতে মূল পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

# হিরোফিলাস সর্বপ্রথম মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রক অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি নতুন ধারার সূচনা করেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরীকে কিন্তু করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ধ্বংসের বেশ কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত আছে, প্রাচীন ও বর্তমান সুত্রানুসারে ৪টি ঘটনাকে এই লাইব্রেরি ধ্বংসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

# প্লুটার্ক, গ্যালিয়াস, মারসেলিনাস, অরোসিয়াস এর তথ্যমতে, জুলিয়াস সিজার যখন ৪৮ খ্রিষ্টপূর্বে টলেমি (Xll) এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তখন আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সময় তার সৈন্যরা দূর্ঘটনাবশত লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ফেলে।

# ধারণা করা হয় এরপরও লাইব্রেরিটির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সম্রাট অরেলিয়ান ২৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পালমিরার রাণী জেনোবিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধাবস্থায় লাইব্রেরীর মূল অংশটি যে এলাকায় অবস্থিত ছিল তা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। কিন্তু সাহায্যকারী অংশ যেটি সেরাপিয়ামে অবস্থিত ছিল, সেটি অক্ষত থাকে।

# ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্রাট থিয়োডোসিয়াস একটি অধ্যাদেশ জারি করে প্যাগান মতবাদকে নিষিদ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক থিয়োফেলাস প্যাগান উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দেন। ফলে প্যাগানদের হাতে নির্মিত সেরাপিয়ামে অবস্থিত লাইব্রেরির অতিরিক্ত অংশটি ধ্বংস করে ফেলা হয়।

# সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে এই লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়, তিনি হলেন খলিফা ওমর। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানরা আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে। সিরীয় খ্রিষ্টান লেখক বার-হিব্রাইউস এর গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, খলিফা ওমরের সেনাপতি তাকে এই লাইব্রেরির পুস্তকসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “যদি পুস্তকসমূহ কুরআন এর মতবাদকে স্বীকার করে তবে এগুলোর প্রয়োজন নেই, আর যদি এগুলো কুরআন বিরোধী হয় তবে তা ধ্বংস করো। ” এর ফলে পুস্তকসমূহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এই লেখকের লেখার ঐতিহাসিক ভিত্তি তেমন জোরাল নয়।

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির ধ্বংস এবং প্রথম নারী গণিতবিদ হাইপেশিয়ার হত্যাকান্ডের পর সূচনা ঘটে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্ধকার যুগের। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক শতক লেগে যায়, ষষ্ঠদশ শতাব্দীর দিকে আইজ্যাক নিউটন সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাদের নিত্য নতুন মতবাদে যেন বিজ্ঞানের পুনর্জন্ম ঘটান। এরপরের ইতিহাসটা বোধহয় সবারই জানা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের একের পর এক আবিষ্কারের পথ ধরে আমরা পৌছে গিয়েছি আজকের এই আধুনিক সভ্যতায়।

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংসের প্রায় ১৫০০ বছর পর ঘটল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৪ সালে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হল একটি কমিটি, যারা সিদ্ধান্ত নিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ করা হবে এবং এজন্য তারা প্রাচীন লাইব্রেরিটির কাছাকাছি একটি স্থান নির্বাচন করেন। খুব শীঘ্রই তাদের এই সিদ্ধান্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান ব্যপকভাবে সাড়া দেয়।

alexandriamএ উদ্যোগের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিলেন মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারাক। ইউনেস্কোও এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে থাকে এবং তারা একটি স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যেখানে প্রায় ১৪০০ নকশার মধ্যে নরওয়ের “Snohetta” নামক আর্কিটেকচারাল ফার্মের নকশাটিকেই নির্বাচিত করা হয়।

১৯৯০ সালে মিশরের আসওয়ানে একটি কনফারেন্সে লাইব্রেরিটি পুনঃনির্মানের জন্য ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রাথমিক ফান্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, যার সিংহভাগই আসে আরব রাষ্ট্রগুলো হতে। এরপর ১৯৯৫ সালে লাইব্রেরীটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং এটি নির্মান করতে সর্বমোট খরচ হয় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আনুষ্ঠানিকভাবে লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করা হয় ১২ই অক্টোবর, ২০০২ সালে। পৃথিবীর বুকে আরেকবার আবির্ভাব ঘটে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর।

বিশাল এই প্রোজেক্টের মধ্যে আছে ৮০ লক্ষ বই রাখার মত শেলফ এর ব্যবস্থা, মূল পাঠকক্ষটি প্রায় ৭০ হাজার বর্গ মিটারের যা ১১টির মত চৌবাচ্চার উপর অবস্থিত । মূল কমপ্লেক্সে একটি বিশাল কনফারেন্স সেন্টার, ৪টি মিউজিয়াম, ৪টি গ্যালারী( অস্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য একটি প্লানেটেরিয়াম, পান্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য ল্যাব আছে।

মূল পাঠকক্ষের উপরে রয়েছে ৩২ মিটার দীর্ঘ কাচ দিয়ে ঘেরা ছাদ, সমুদ্রের দিক হতে দেখলে যাকে sundial (প্রাচীনকালে ব্যবহৃত সময় গণনার যন্ত্র( মত মনে হয়। দেয়াল তৈরি করা হয়েছে ধূসর বর্ণের আসওয়ান গ্রানাইট দিয়ে, যাতে ১২০ রকমের হস্তলিপি খোদাই করা আছে। লাইব্রেরীতে ইন্টারনেট আর্কাইভে পুস্তক, দলিল সমূহের অনুলিপি সংরক্ষিত আছে, প্রয়োজনবোধে সেখান থেকে এসপ্রেসো বুক মেশিনের সাহায্যে বই প্রিন্ট করে নেওয়া যায়।

বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় অবদান রেখেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, তন্মদ্ধে ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এভাবেই তিলে তিলে মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আর অত্যাচারী শাসক ও ধর্মান্ধদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কোনভাবেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে রোধ করা সম্ভব নয়। হয়ত এখনো কোন নিঃস্তব্ধ রাতে তাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, যাদের মেধা-মননে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রাচীন লাইব্রেরিটি। সে দীর্ঘশ্বাস শুধুই কষ্টের, বেদনার।

তথ্যসুত্রঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Library_of_Alexandria
http://en.wikipedia.org/wiki/Bibliotheca_Alexandrina
https://www.facebook.com/notes/kawsar-farhad/library-of-alexandria/10151201911724315

লেখক: আহমাদুর রহমান অনিক
শিক্ষার্থী, যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কৃতজ্ঞতা: জিরো টু ইনফিনিটি (বিজ্ঞান মাসিক পত্রিকা)

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।