ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চোখ থাকতেও আমরা কানা!

এস এম আব্বাস, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:৪০, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩
চোখ থাকতেও আমরা কানা!

ঢাকা: সন্ধ্যা থেকে মানুষের আনাগোনা। মধ্যরাতেও তাই, আসর জমজমাট।

চারদিকে উড়ছে ধোঁয়া! ভিড় আর তীব্র সুগন্ধ! মজমার (গান বাজনার আসর) ধারে কাছে যাওয়াও কঠিন।

ধোঁয়া আর ভিড় ঠেলে মজমার কাছে যেতেই হাতে একতারা নিয়ে এগিয়ে এলেন আসাদুজ্জামান। তিনি থাকায় সহজেই বাবা শাহ আলীর মাজারের আশেক আর মাশুকদের সঙ্গে মিশে যাওয়া সম্ভব হলো। ছবি আর তথ্য পেতেও তেমন বেগ পেতে হলো না।
 
কিছুদূর পর পরই মজমার আয়োজন। সমান তালে চলছে নাচ আর গান। কে কার গান শোনে আর কে কার নাচ দেখে, তা বোঝা দায়! কিছু দর্শককে দেখা গেল নারী শিল্পীদের লক্ষ করে টাকা উড়িয়ে দিতে।

বর্ণিত দৃশ্যপট জমজমাট মেলা কিংবা যাত্রাপালার স্বাভাবিক দৃশ্য বলে মনে হলেও রাতে মিরপুর শাহ আলীর মাজারে গেলে এমন দৃশ্যই চোখে পড়বে।  

বৃহস্পতিবার রাতভর মাজারে অবস্থানকালে এ রকম অনেক দৃশ্যই চোখে পড়লো, যা স্বাভাবিক নগর জীবন-যাপনকারীদের কাছে অনেকটাই অস্বাভাবিক।

চোখ গেল ব্যতিক্রমী এক মজমার দিকে, নাম- ‘কানার হাট’। এমন নাম কেন জানতে চাইলে, ‘কানার হাট সঙ্গীত সংঘ’-এর সভাপতি আরমান বলেন, ‘চোখ থাকতেও আমরা কানা (অন্ধ)। তাই, কানার হাট সঙ্গীত সংঘের উদ্যোগে আমাদের এই মজমা। চর্চা আর আনন্দের জন্যই এখানে এসেছি। যদি কিছু শিখে অন্ধত্ব ঘোচাতে পারি, তাই প্রতিরাতেই আসি, অর্থ উপার্জনের জন্য নয়!’

মিরপুর দুই নম্বরে আরমানী ইলেকট্রনিক্স নামে একটি ছোট্ট দোকানের উপার্জন দিয়ে সংসার চলে আরমানের। মনের টানে নিয়মিতই বাবার দরবারে এসে গান গেয়ে রাত কাটান তিনি।

বাংলানিউজের চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নাজমুল হাসান মজমার ছবি তোলার চেষ্টা করলেন, ভয়ে ভয়ে। ছবি তুলতেই সম্মুখীন হতে হলো নানা প্রশ্নের! বাধাও দিতে চাইলেন অনেকে।

এ সময় রক্ষা করলেন আসাদ্দুজ্জামান। ত‍ার একতারার ‍ওপর ভর করে সহজেই মজমায় শামিল হওয়া সম্ভব হলো। ছবি তুলতেও বাধা দিলো না আর কেউ।

যাত্রার মতোই মজমায় গান আর হালকা নাচ চলছে। নারী শিল্পীদের পোশাক আর অঙ্গভঙ্গি মার্জিতই। তবে কাউকে কাউকে তাদের দিকে টাকা ছুড়তে দেখা গেল।

শিল্পীদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ বছরের মেয়েরাও রয়েছে। গান গাওয়ার সময় নানা অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তারা।

তবে এত কম বয়সের মেয়েদের এভাবে উপার্জনের হাতিয়ার বানালে এর ফলাফল ভালো হবে না, মন্তব্য করেন সচেতন অনেক দর্শকই।

ধোঁয়া উড়তে দেখা গেল আরেকটি মজমায়। সেখানে গাঁজার আসর। গাঁজার গুরুদেবরা থাকতে পারেন ভেবে যাওয়া হলো সেখানেই।

একজনকে দেখা গেল, ধূপের ধোঁয়া ছড়াতে। গাঁজার দুর্গন্ধ কমাতেই এই ধূপের ধোঁয়া, জানালেন তিনি। বিনিময়ে গাঁজার মজমা থেকে কিছু টাকা-পয়সাও দেওয়া হয় তাকে।

জালাল নামে এক লোকের দেখা মিললো সেখানে। বাবার ভক্ত কিনা, বোঝা না গেলেও মজমায় তাকে দেখা গেল গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করতে। প্রতি পুরিয়া ত্রিশ টাকা। গাঁজার পুরিয়া সাধলেন এই প্রতিবেদকদেরও। পরে ক্যামেরা দেখে দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়লেন তিনি।

এই আসরেই দেখা মিললো পাগলা স্বপন নামে এক ব্যতিক্রমী ভক্তের। গাঁজাভর্তি কলকে টেনে ধোঁয়ায় আসর যেন ভরিয়ে দিচ্ছেন। কয়েক দফা কলকে টানার পরই কথা শুরু করলেন তিনি। জানালেন, তিনি বাবার ভক্ত। তাই, প্রতিরাতেই আসেন জিকির আজকার করতে। বাবার প্রেমে সংসারত্যাগী হয়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবার আশ্রমেই কাটাবেন। পুরো নাম জানতে চাইলে বলেন, মো. শফিকুর রহমান।  

দেখা মিললো লালন ভক্তের একটি দলেরও। বাবার প্রকৃত ভক্ত বলেই মনে হলো তাদের। দলের কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। গাইছেন, লালনের প্রেমের গান। ফুলেট (এক ধরনের বাদ্য যন্ত্র) বাজাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বৃদ্ধ শাহ আলম।

এই বয়সে ফুলেট বাজানো সহজ ব্যাপার নয়। ‘কান্দে হাছন রাজার মন মনিয়া রে...’। লালন গ্রুপের বৃদ্ধ ভক্তের এই গানটির সঙ্গে ফুলেট বাজানো উপভোগ করছেন, শত শত লোক।

গানের আয়োজনে তারা এতটাই মাতোয়ারা যে, কথা বলার ফুরসতও নেই কারো। সেখানেই কথা হলো, শাহীন হোসেন নামে এক যুবকের সঙ্গে।

শাহীনের ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া ভিডিও এডিটিং ও ফটোগ্রাফি করেও টাকা উপার্জন করেন তিনি। জানালেন, শান্তির খোঁজে শাহ আলীর মাজারে এসেছেন। বাবার প্রতি ভালোবাসা আর নিজের মনতুষ্টি খুঁজতেই প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে তার দরবারে আসা।

মজমায় মজমায় ঘুরতেই রাত শেষ হতে চললো, সে কারণে মাজারের পাঠ আমরাও চুকিয়ে দিলাম।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩
এসএমএ/আরআই/এসএটি/এইচএ/এবি/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।