বান্দরবান থেকে ফিরে: দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। আমরা ফিরছি নাফাখূম থেকে।
ছবি তুলতে চাইলে লাজুক হাসি, থামালো না গল্প। এ পরিবেশে যেন এ শিশু দুটিকেই মানায়। এ ফুল, জল, গাছ, পাহাড় সবই যেন তাদের জন্যই।
মুহূর্তেই মনে হলো রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ক্যামেলিয়া কবিতার সাঁওতাল মেয়ে কমলার কথা। আর সেই বিখ্যাত চরণ ‘বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে। ’/বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া/সাঁওতাল মেয়ের কানে,/কালো গালের ওপর আলো করেছে। /সে আবার জিগেস করলে, ডেকেছিস কেনে। ’/আমি বললেম, এই জন্যেই। ’
পাহাড়ের নীরবতায় রাত নামে যেন একটু তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যা তাই পাহাড়ি শিশু-কিশোরদের ঘুমের সময়। তবে অনেকেই টর্চ নিয়ে বের হয় মাছ, ব্যাঙ আর সাপ ধরতে।
কেরোসিন পুড়িয়ে পড়াশুনার সামর্থ্য তাদের নেই। এ কাজটি তাই করতে হয় দিনের শেষ আলো অবধি।
সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত অবধি ঘুমিয়ে সঞ্চয় করতে হয় সারাদিন পথচলার প্রাণশক্তি। চলার শক্তি এজন্য যে, বয়সে শিশু-কিশোর হলেও ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয় তাদের জীবন সংগ্রাম। পানি সংগ্রহ তাদের প্রধান এবং প্রথম কাজ। পরিবারের জন্য প্রতিদিনের যে পানি দরকার তা সংগ্রহ করার যে প্রক্রিয়া ও কষ্ট সেটা শুধু একার পক্ষে করা দুরূহ। তাই ভোর হতেই সাঙ্গু, ঝিরি বা পাতকূয়ায় মাথায় থুরং ঝুলিয়ে তার মধ্যে টুই, বোতল বা ছোট কলস নিয়ে ছুটতে হয়।
পানির যখন বেশি সংকট দেখা দেয় তখন ছোটদের দায়িত্ব পড়ে ঝিরি বা নদীর পাশের পাথুরে বালি মাটি খুঁড়ে তৈরি করা পাতকূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করার।
সাত-আট বছর বয়সে পাহাড়ি শিশুরা ঘরের প্রায় সব কাজই শিখে যায়। না শিখেও উপায় নেই তাদের।
কারণ সংগ্রামেই তাদের জীবন। প্রতি মুহূর্তে যেন চলে টিকে থাকার নিরন্তন সংগ্রাম।
জল, পাহাড়ের সঙ্গে লড়াই করে জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাদের। আর দু-তিন বছর বয়স অবধি তো মায়ের পিঠে কাপড়ের ভাঁজেই কাটে তাদের।
ধানে পা দেওয়া, পানি সংগ্রহ, কাপড় ধোয়া, থালাবাটি মাজা, বাজার করা, জুমে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপই যে তাদের দেখতে হয় পৃথিবী চিনতে শেখার বয়স থেকেই।
কখনও কখনও সকাল, দুপুর কিংবা বিকেলের ঘুমটুকুও সেরে নিতে হয় মায়ের শরীরের ওমে কিংবা পিঠের ঝোলায়।
স্কুলে যাওয়ার, পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা সব শিশু কিশোরের নেই। মাচাং বারান্দায় খেলায় মেতে থাকতে বা সাঙ্গুর সবুজ স্বচ্ছ ডুবজলে মাথাটুকু বাইরে রেখে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ আর লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করতেই তারা বেশি পছন্দ করে। জাল বেয়ে মাছ ধরতেও ওস্তাদ বনে যায় এসব অল্পবয়সী শিশুরা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাজেই চলে পাহাড়ি পরিবারগুলো।
দুরন্ত পাহাড়ি শৈশব কাটে কাজ আর সংগ্রামে। শুধু থুরংয়ে পানি বহন নয়, বাজার করা, বাজারে জুমে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতেও ওস্তাদ এসব শিশুরা।
তবে যে বয়সে তাদের যাওয়ার কথা স্কুলে, যখন তাদের বসে থাকার কথা বই নিয়ে, অভাবের তাড়নায় তখন তারা এসব কাজ করছে।
শিক্ষা বঞ্চিতই বলা যায় এদের। কারণ শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তারা পায় না। তাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিইবা বলার আছে।
আরও একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় পাহাড়ি শিশু-কিশোরদের। অনেক সময় মা-বাবা জুমে গেলে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যটিকে দেখার দায়ভার পড়ে তুলনামূলক একটু বড় শিশুটির ওপর। শুধু তাই নয়, হাঁস-মুরগির খাবার দেওয়া, শূকর দেখাশোনা করা, টুকটাক রান্নাবান্নার কাজও করতে হয় তাদের।
তাদের অবসর কাটে মা-বাবা অথবা দাদি-নানির সঙ্গে। বিনোদন বলতে শুধুই গল্প শোনা। কোনো কোনো পাড়ার কারবারির বাসায় টিভি দেখা যায়। তাও আবার শুধু সিডি বা ডিভিডির মাধ্যমে।
মাচাং ঘরের তিন বাই দুই ফিট জানালা অনেক শিশুর কাছেই স্বর্গ দর্শন। উঁচু-নিচু পাহাড়ে হেঁটেচলা মুশকিল। তাই জগতটা উপভোগ করতে হয় অনেক সময় এখান থেকেই।
সব কিছুর পরেও যখন কোনো শিশু স্কুল ছুটির পর প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে বই খাতা হাতে মুচকি হাসে, তখন মনে হয় তারাও স্বপ্ন দেখতে জানে, জানে এগিয়ে যেতে, জীবন যুদ্ধকে জয় করতে আর জীবনকে ভালোবাসতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩
এসএটি/এএ/জেসিকে