কলকাতা: ‘সুরুচি’ মধ্য কলকাতার এক সম্পূর্ণ বাঙালি খাবারের প্রতিষ্ঠান। অতি সুস্বাদু সাবেকি বাঙালি রান্নার ভাণ্ডার আছে সুরুচি’র ভাঁড়ারে।
সুরুচি সম্পূর্ণ নারী পরিচালিত বাঙালি রেস্তোরাঁ। রান্না থেকে শুরু করে ক্যাশ সামলানো- সব কিছুই করেন নারী। ব্যতিক্রমী হলেও সুরুচি সেই কারণেও আজ শিরোনামে নয়। গোটা ভারতে এ রকম আরও বেশ কিছু সম্পূর্ণ নারী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান আছে।
তবে সুরুচি আজ খবরের শিরোনামে তার লড়াই এর কারণে। যে মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা হেনরি লুইস ডিরোজিও, সেই মশাল বয়ে নিয়ে চলেছে আজকের সুরুচি।
মধ্য কলকাতার যে পথ দিয়ে বহুবার হেঁটেছেন মাদার তেরেসা তার ‘নির্মল হৃদয়’ আশ্রমের দিকে, সেই রাস্তায় মাদার তেরেসার বাড়ির থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত ‘সুরুচি’। ৮৯ ইলিওট রোড সুরুচির ঠিকানা।

প্রান্তিক অসহায় নারীদের সেই লড়াই আরও কাছ থেকে দেখতে এবং কুর্নিশ জানাতে হাজির হয়েছিলাম সুরুচি’র দপ্তরে। কথা হচ্ছিল ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক অঞ্জনা দেবীর ঘরে বসে। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম কেন সুরুচি শুধু বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ নয়।
সুরুচির আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস
অঞ্জনা দেবীর কথা শুনতে শুনতে উঠে পড়লাম ইতিহাসের ভেলায়। ১৯৫২ সাল, সময়টা ভারতের স্বাধীনতার পরপরই। পূর্ববঙ্গ থেকে কাতারে কাতারে মানুষ আসছেন কলকাতায়। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা নারীরা নানা রকমারি মিষ্টি বানাতে জানতেন। তাদের হাতের মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পশ্চিমবঙ্গে। এসব নারীকে স্বনির্ভর করতে তৈরি হল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
রসনার রসায়নীতে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বিখ্যাত হয়ে উঠল এই মিষ্টি। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় তৈরি হল সম্পূর্ণ বাঙালি খাবারের দোকান ‘সুরুচি’। তখন থেকেই পথ চলা শুরু।
সুরুচি পরিচালনা করেন নারীরা। এরাই রান্না করা, অর্ডার নেওয়া, পরিবেশন থেকে শুরু করে ক্যাশ সামলানোর মত সব কাজই করেন। এরা সবাই ‘সুরুচি’ পরিবারের সদস্য।
সুরুচি’র পরিবারে এসে মনে হল এখানে ‘পরিবার’ কথাটি যেন তার আক্ষরিক অর্থের পোশাক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। পরিবার বলতে সাধারণভাবে আমারা যা বুঝি, এই নারীদের সেই ‘পরিবার’ নেই। এরা প্রায় সকলেই অনাথ। কেউ তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে হারিয়েছেন আইলার ঝড়ে, কেউ বা ঠিক মায়ের কোলের নিরাপত্তা পাবার আগেই আশ্রয় পেয়েছেন ধুলো মাখা পথের ধারে। কেউ বা হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসেছেন। আবার শুরু করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাঁচার লড়াই। স্থান পেয়েছেন ‘অল বেঙ্গল ওম্যানস ইউনিয়ন’ হোমে।

অল বেঙ্গল ওম্যানস ইউনিয়ন শুরু হয়েছিল ১৯৩২ সালে। কিছু সমমনস্ক নারী মিলে তৈরি করেছিলেন এই সংগঠন। উদ্দেশ্য ছিল অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা।
সেই দিনের সেই গাছ আজকের মহীরুহ
তিনটি বিভাগে আছেন অনেক নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। এরা সাধারণত সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে এই হোমে আসেন। এই হোমে থেকেই তারা পড়াশোনা শেখেন। হোমের আছে নিজেদের স্কুল। এরপর তারা কলকাতার বিভিন্ন স্কুলে উঁচু ক্লাসে ভর্তি হন।
শুধু যে কন্যা সন্তানরাই শিশু বিভাগে আসেন তেমনটা কিন্তু নয়। ছোট ছোট অনাথ ছেলেদেরও এই হোমে নিয়ে আসা হয়। তবে কিছুটা বড় হলে তাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ছেলেদের হোমে।
শুধু শিশু কিংবা নারীরাই নন, ‘অল বেঙ্গল ওম্যানস ইউনিয়ন’-এর হোমে আছেন জনা ২৫ বৃদ্ধা। এদের কেউ কেউ ছোট বেলা থেকেই আছেন এই হোমে।
তবে নারীদের স্বনির্ভর করতে শুধু রন্ধন শিল্পই নয়, এই হোমের মেয়েদের শেখানো হয় নানা ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষা। আছে কাপড়ের উপর ছাপার ক্লাস, তাঁত বোনার ক্লাস, সেলাই ক্লাস ইত্যাদি। স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে মেয়রা এই সব ক্লাসে হাজির হয়। আর এই তাঁত বোনার ক্লাসের মেয়েরা ঘটনাচক্রে সকলেই মূক ও বধির।

এখানে কেউ বোনে তাঁত কেউবা শাড়ির উপর তোলে অপূর্ণ সব নক্সার ছাপ। আবার কেউ নিপুণ হাতে বানায় নানা ধরনের জামা কাপড়। রুমাল, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড়ের সাথে সাথে আগামী দিনে তাঁতের কাপড় বানাবার পরিকল্পনাও আছে এই হোমের আবাসিকদের।
অনেকেই নিয়মিত এসে কিনে নিয়ে যায় এসব জিনিসপত্র। আবার মাঝে মাঝে প্রদর্শনীও করা হয়। ‘গুড কম্প্যানিয়ন’ নামে কলকাতার একটি বিখ্যাত দোকান থেকেও বিক্রি হয় এই নারীদের তৈরি জিনিসপত্র।
সংগঠনের পেট্রন স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল
এখানেই শেষ নয়, এই হোমের মেয়েরা অনেকেই ‘নার্সিং’ শিখে নিজেদের সঁপে দেন সেবা ধর্মে, কেউবা সফলভাবে কাজ করেন সরকারি দপ্তরে। হোমের ভেতরেই আছে মশলা বানাবার ব্যবস্থা। নির্ভেজাল মশলা তৈরি করে বিপণন করা হয়। গোটা কাজটিই করেন হোমের আবাসিকরা।
এই বছরই পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে এবং কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়েছেন দু’জন মেয়ে। এই রকম দৃষ্টান্ত আছে অনেক।
অনেকেই জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়ে নতুন সংসার পাতেন। আবার অনেক পাত্রের পরিবার নিজেরা হাজির হয়ে পাত্রী পছন্দ করে নেন। এই রকম ঘটনা আছে অনেক। কথা বলতে বলতে অঞ্জনা দেবী বললেন, চিনি চট্টোপাধ্যায়ের কথা। চিনি দেবী এই হোমেই বড় হয়েছেন। তারপর মনের মত সঙ্গীর সাথে ঘর বেঁধেছেন সুদূর অস্টেলিয়ায়। স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ঘর-সংসারী তিনি। এক ছেলে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন সেখানে।
হোমের কোন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে হোম কর্তৃপক্ষ। হোমের সদস্যরাই তার সেবা শুশ্রুভার নেন। প্রতি বছর হয় বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। তাতে সকলেই অংশগ্রহণ করেন।
পুরনো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে হোমের পুরনো আবাসিকদের নিয়ে পুনর্মিলণী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তাতে হাজির হন সমস্ত আবাসিক। যারা এক সময় এই হোমে থাকতেন আজ তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন নানা ক্ষেত্রে। আবাসিকরা জানালেন ওই দিন তারা পুরনো বন্ধুদের ফিরে পান। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে।
এবার হাজির হলাম ‘অল বেঙ্গল ওম্যানস ইউনিয়ন’র নারী পরিচালিত রেস্তোরাঁর ভেতর। সাবেকি আঙ্গিকের ছিমছাম রেস্তোরাঁ, আধুনিকতার সঙ্গে আছে বাঙালিয়ানার মিশেল।

এখানে আসতেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। এসেছিলেন ব্রিটেন রাজ পরিবারের প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স চার্লস, প্রিন্স অ্যান্ড্রু। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থকে এসেছেন বিখ্যাত সেফ রিক স্টন। রিক এখানকার মেয়েদের কাছ থেকে রিক শিখেছেন ভারতীয় রান্না, দিয়েছেন নানা রকমের টিপস।
পহেলা বৈশাখে থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। অনেক মানুষ হাজির হন সুরুচি’র রকমারি আয়োজনে। এছাড়াও হয় পিঠে পার্বণ। পৌষের আমেজে প্রতি বছরই জমে ওঠে উৎসব। এছাড়া ইলিশ উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ তো আছেই।
প্রতিদিন থাকে চার রকমের বিশেষ পদ। কোন দিন দোর্মা তো অন্য কোনদিন মালাইকারি। এছাড়া আছে ভেজ থালি। যারা নিরামিষ খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য আছে আলাদা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিনিই অনেক অতিথি আসেন। অনেকেই আবার কলকাতায় এলেই একবার অন্তত হাজির হন সুরুচিতে। প্রবাসী বাঙালিরা শহরে এলে একটি বেলা সুরুচির জন্য বরাদ্দ রাখেন।
রান্না করেন মোট ছয় জন। এর মধ্যে দুইজনের কাজ শুধু জলখাবার তৈরির। পাঁচজন পরিবেশনের কাজটি নিপুণ হাতে সামলান।
কথা বলা শেষ করে বেরিয়ে আসছি। দূর থেকে দেখলাম ‘অল বেঙ্গল ওম্যানস ইউনিয়ন পরিচালিত হোমের শিশুরা, মেয়েরা স্কুল-কলেজ থেকে ফিরে নানা কাজে ব্যস্ত। দূর থেকেই কুর্নিশ জানালাম তাদের লড়াইকে।
এ যেন একটা সীমানা ছাড়িয়ে ইচ্ছে ডানা মেলার লড়াই, এ যেন এক স্বাধীন আকাশে উড়বার লড়াই। যে লড়াইয়ের মুহূর্তগুলোকে প্রকাশ করার শব্দ আমার ঝুলিতে নেই। তবে একটা কথা হলফ করে বলা যায়, এই শিকল ভাঙাবার এই লড়ায়ের শেষে আসবে এক স্বণির্ভর জীবন, স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ সময়: ০১২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৩
এমআইএইচ/জেডএম/আরকে