ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আমার বাবার স্যুটকেস: ওরহান পামুক

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৬, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৩
আমার বাবার স্যুটকেস: ওরহান পামুক

তুরস্কের নোবেল বিজয়ী লেখক ওরহান পামুকের জন্ম ইস্তাম্বুলে ১৯৫২ সালে। ইস্তাম্বুল তার প্রিয় শহর।

তিনি এখনও সেখানে বাস করেন। তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রথম দিকে তার পরিবার রেলপথের লাইন নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে প্রচুর বিত্ত সম্পদের অধিকারী হন।

পামুক ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। অনেকেই আশা করেছিলেন রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে আলোচিত প্রথম তুর্কি নোবেল বিজয়ী ওরহান পামুকের নোবেল বক্তৃতা জুড়ে হয়তো তুরস্ক ও সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক সংঘাত প্রাধান্য পাবে। কিন্তু বক্তৃতা শুনে সবাই অবাক হয়েছেন। ভাষণে নিজের পরিবার বিশেষ করে বাবার কথা বলেছেন। বর্ণনা করেছেন একজন ব্যক্তির সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার কথা।

পামুকের বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। লেখক জীবনের দীর্ঘ একটি সময়জুড়ে তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন বাবা। পামুকের নোবেল বক্তৃতার শিরোনাম ‘আমার বাবার সুটকেস’। সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে দেওয়া ভাষণটির ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ তুলে দেওয়া হলো।

মৃত্যুর দু’বছর আগে বাবা আমাকে একটা ছোট স্যুটকেস দিয়েছিলেন। তাতে ছিল তার লেখা পাণ্ডুলিপি ও নোটবুক। তার স্বভাবসুলভ রসিকতা ও তামাসা করার ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, আমি চলে যাওয়ার পর এগুলো পড়ো। চলে যাওয়া বলতে তিনি মৃত্যুকে বুঝিয়েছিলেন।

ঈষ্যৎ বিব্রত ভঙ্গিতে তিনি বললেন, শুধু চোখ বুলিয়ে দেখো। হয়তো এতে এমন কিছু আছে যা তোমার কাজে লাগতে পারে। আমার চলে যাওয়ার পর হয়তো এগুলো থেকে কিছু বাছাই করে তুমি ছাপতেও পারো।

ঘটনাটা ঘটেছিল আমার পড়ার ঘরে। চারদিকে ছিল বইয়ের সারি। বাবা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন স্যুটকেসটা রাখার জায়গার সন্ধানে। যেন একটা লোক তার বেদনাদায়ক বোঝা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত সচরাচর চোখে পড়ে না এমন একটা জায়গায় স্যুটকেসটা রেখেছিলেন। এই লজ্জাজনক মুহূর্তটির কথা আমরা কেউই কখনো ভুলিনি। কিন্তু ঘটনাটা শেষ হওয়ার পর আমরা যার যার নিজের ভূমিকায় ফিরে গিয়েছিলাম। তামাসা, রসিকতা, জীবন নিয়ে হালকা কথাবার্তা আবার আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করেছিল। আমরা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। কোনো দুঃখবোধের অবকাশ না রেখে সবসময় যেভাবে কথা বলতাম সেভাবেই কথা শুরু হয়েছিল। দৈনন্দিন জীবনের টুকটাক বিষয় নিয়ে তুরস্কের অন্তহীন রাজনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে, বাবার ব্যর্থ ব্যবসা উদ্যোগগুলো নিয়ে।

আমার মনে পড়ে বাবার মৃত্যুর পর, বেশ কয়েকদিন আমি স্যুটকেসটার আশপাশ দিয়ে হেঁটেছি। কিন্তু একবারের জন্যও স্পর্শ করিনি। ইতিমধ্যেই ওই ছোট কালো চামড়ার স্যুটকেসটা তালা-চাবি ও বক্রাকার কোনাগুলোসহ আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ছোটখাটো ভ্রমণে বাবা সুটকেসটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কখনো কখনো এটা কাজে লাগতো তার কাজের কাগজপত্র বহনের জন্য। মনে আছে, ছোটবেলায় বাবা কোনো ভ্রমণ থেকে ফিরলে আমি স্যুটকেসটা খুলে ভেতরের জিনিসপত্রগুলো তল্লাশি চালাতাম। কোলোন আর ভিনদেশি গন্ধ এসে আমার নাকে লাগতো। এই স্যুটকেসটা ছিল আমার পরিচিত বন্ধু, আমার অতীতের, শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার এক শক্তিশালী উপাদান। কিন্তু এখন আমি একে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারছি না। কেন? সন্দেহ নেই, এর কারণ, এর ভেতরে যা আছে তার রহস্যময় গুরুভার।

এখন আমি বলবো এই ভার বলতে আসলে কি বোঝায়। এটা এমন এক জিনিস যা একজন ব্যক্তি সৃষ্টি করেন নিজেকে বদ্ধ ঘরে অন্তরীণ করে, টেবিলের সামনে বসে নিজেকে ঘরের এক কোনায় সমর্পণ করেন। এটাই সাহিত্যের মর্মার্থ।

স্যুটকেসটি স্পর্শ করলেও নিজেকে এর ডালা খোলার জন্য প্রস্তুত করতে পারি না। কিন্তু আমি জানি এর ভেতরে আছে কিছু নোটবুক। আমি বাবাকে এর কয়েকটিতে লিখতে দেখেছি। স্যুটকেসের ভেতরের জিনিসের গুরুভার বিষয়ে প্রথম আমি ওইবারই শুনেছি, তা নয়। বাবার একটা বড় লাইব্রেরি ছিল। তার যৌবনে, ১৯৪০ দশকে তিনি নিজেকে ইস্তাম্বুলের একজন কবি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভ্যালেরি কবিতা তুরস্কের ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তিনি গরিব দেশে অল্প পাঠকের বৃত্তের একজন কবির জীবন বেছে নিতে চাননি। আমার বাবার বাবা, আমার দাদা ছিলেন এক অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। শৈশব ও যৌবনে বাবা আরামের জীবন যাপন করেছিলেন। লেখালেখি বা সাহিত্যের স্বার্থে কঠোর জীবন বেছে নেওয়ার ইচ্ছা তার মধ্যে ছিল না। আমি বুঝতে পারি তিনি জীবন ও এর সব সৌন্দর্যকে ভালোবাসতেন।

বাবার স্যুটকেস থেকে আমাকে দূরে রেখেছিল, এর ভেতরের বস্তুগুলো। ভেবেছিলাম এগুলো পড়লে হয়তো আমার ভালো লাগবে না। বাবাও এটা জানতেন। আর এ কারণে এগুলোকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না এমন একটা ভাব নিতে চেয়েছিলেন। ২৫ বছরের লেখক জীবন অতিবাহিত করার পর এগুলো দেখতে গিয়ে আমি বেদনাবিদ্ধ হতাম। কিন্তু বাবা কেন সিরিয়াসলি সাহিত্য চর্চা করতে ব্যর্থ হলেন এটা ভেবে আমি রাগ করতে চাইনি। আমার আসল ভয় ছিল অন্য জায়গায়...

২.

একজন লেখক সেই ব্যক্তি যিনি নিজের ভেতরকার দ্বিতীয় সত্তাকে আবিষ্কার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। বুঝতে চান সেই পৃথিবীতে যা তাকে তৈরি করেছে। আমি যখন লেখা বিষয়ে কথা বলি তখন আমার সামনে উপন্যাস কবিতা বা সাহিত্যিক ঐতিহ্য নয়, ভাসে একজন ব্যক্তির ছবি। যে ব্যক্তি নিজেকে একটা ঘরে আটকে রাখেন, একা বসেন একটা টেবিলের সামনে, নিজের দিকে ফেরেন, ছায়াকেও গুটিয়ে নেন, শব্দের সাহায্যে গড়ে তোলেন এক নতুন পৃথিবী। এই লোকটি বা এই নারীটি টাইপরাইটার ব্যবহার করতে পারেন, কমপিউটার ব্যবহার করে সুবিধা পেতে পারেন, অথবা কলম দিয়ে কাগজের ওপর লিখতে পারেন - আমি যা ৩০ বছর ধরে করছি।

লেখার সময় তিনি চা বা কফি খেতে পারেন, সিগারেটও ফুকতে পারেন। ক্ষণে ক্ষণে তিনি টেবিল থেকে উঠে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতে পারেন। দেখতে পারেন বাচ্চাদের খেলাধুলা। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে কোনো গাছ বা দৃশ্য দেখতে পারেন। অথবা তার চোখ আটকে যেতে পারে একটা কালো দেয়ালে। তিনি কবিতা, নাটক বা আমার মতো উপন্যাস লিখতে পারেন। এ পার্থক্যগুলো ঘটতে পারে একমাত্র নিজেকে টেবিলে বসিয়ে নিজের দিকে ফেরানোর কঠিন কাজটির পরই। লেখা মানে নিজের অন্তর্লোকের শব্দগুলোর দিকে তাকানো, জগৎ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার পর ফেলে আসা জগৎকে পাঠ করা। ধৈর্য-আনন্দ নিয়ে আত্মগতভাবে কাজগুলো করা। …

অনুপ্রেরণা লেখকের রহস্য নয়, তার জেদ ও ধৈর্য এটা কোথা থেকে আসে তা কখনোই স্পষ্ট নয়। মজার একটা তুরস্কের প্রবাদ আছে – ‘সুই দিয়ে কুয়ো খোড়া` বলে। আমার মনে হয় লেখকদের মন নিয়েই কথাটা বলা হয়েছে। পুরনো গল্পগুলোর মধ্যে আমি ফরহাদের ধৈর্য পছন্দ করি, তাকে বুঝতে পারি যে প্রেমিকার জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় খুড়ে যাচ্ছে। …

৩.
আমি বাবার স্যুটকেস খুলতে ভয় পাচ্ছিলাম কারণ আমি জানতাম, আমি যে বাধাগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি নির্জনতা নয় বরং বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, ভীড়, স্যালুন, রসিকতা আর সঙ্গ ভালোবাসতেন। কিন্তু পরে আমার চিন্তায় একটা মোড় নিল। ভাবলাম এই চিন্তা, ধৈর্য ও ত্যাগের এই স্বপ্ন আমার নিজের জীবন থেকে এসেছে। আমার লেখক হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এই পূর্ব ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেক মেধাবী লেখকের চারদিকেই পরিবার ও সঙ্গীদের আবরণ ছিল। সাথিদের উজ্জ্বলতা ও গুঞ্জনের মধ্যেই তারা কাজ করতেন। তাছাড়া আমার বাবা আমাদের যৌবনে পারিবারিক জীবনের একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে অন্য লেখকদের মতো করে হোটেল রুম ভাড়া করে নোটবুকগুলো ভরেছিলেন।

আমি জানতাম ওই নোটবুকগুলোও স্যুটকেসে ছিল। কারণ যখন বাবা আমাকে স্যুটকেসটা দিয়েছিলেন তার আগে তিনি জীবনের ওই পর্বটার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। এমনকি আমার ছোট বেলাতেও তিনি ওই দিনগুলোর কথা বলেছেন। কিন্তু যা তাকে হোটেল রুম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল সেই নাজুক অবস্থা, লেখক হওয়ার স্বপ্ন ও আত্মপরিচয়ের সংকটের কথা তিনি বলেননি। তার বদলে তিনি বলেছেন কখন কখন তিনি প্যারিসের ফুটপাথে সার্ত্রেকে দেখেছেন, বলেছেন সেই বইগুলোর কথা যেগুলো তিনি পড়েছেন বা সেই মুভির কথা যেগুলো তিনি দেখেছেন। যে খবরগুলো দেওয়া যায় সবই তিনি দিয়েছেন।

আমি যখন লেখক হলাম তখন আমি ওই ঘটনাগুলোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আমি এমন এক বাবা পেয়েছি যিনি পাশা আর ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে কথা বলার চাইতে লেখকদের জগৎ নিয়ে বেশি আলোচনা করতেন। তাই বাবার নোটবুকগুলো পড়ার সময় হয়তো এ কথাগুলো মনে রাখতে হবে। মনে করতে হবে তার বিশাল লাইব্রেরির প্রতি আমার কতোটা ঋণ। মনে করতে হবে বাবা যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তখন আমারই মতো নিজের চিন্তা ও বইগুলো নিয়ে একা হতে ভালোবাসতেন। তার লেখার গুণ কি তা তার মনেই আসতো না। …

পৃথিবীতে নিজের, নিজের জীবনের, সাহিত্যের চিন্তা করতে গিয়ে আমার মুখ্য অনুভূতি হতো, আমি পৃথিবীর কেন্দ্রে নই। পৃথিবীর কেন্দ্রে জীবন আরো সমৃদ্ধ আরো উত্তেজনাময়। তুরস্কের সবকিছু, ইস্তাম্বুলের সবকিছু নিয়ে আমরা এর বাইরেই পড়ে আছি। আজ আমি জানি পৃথিবীর অনেক লোকই এভাবে ভাবেন। একইভাবে আছে এক বিশ্বসাহিত্য। আছে এর কেন্দ্র। আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। আসলে আমার মনে যা ছিল তা পশ্চিমি সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য নয়। আমার টার্কিশরা যা থেকে অনেক দূরে। আমার বাবার লাইব্রেরি ছিল এর একটা প্রমাণ। এর একদিকে ছিল তুরস্কের সাহিত্য, আরেক দিকে ছিল পশ্চিমি সাহিত্যের সংগ্রহ। আমার মনে হতো, বাবা এই বইগুলো পড়েছিলেন জীবন থেকে পালিয়ে পশ্চিমে উড়ে যাওয়ার জন্য, যা আমিও পরে করবো। অথবা আমার মনে হতো বইগুলো হলো অপূর্ণ সংস্কৃতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার করার হাতিয়ার। …

আমি বাবার স্যুটকেসের দিকে তাকাই, বুঝি এটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তুরস্কের একটি ঘরে বসে ২৫ বছর ধরে লেখক হিসেবে টিকে থাকার কাজ করার পর বাবার স্যুটকেসের গভীর চিন্তাগুলোর কথা জানার আগ্রহ হলো আমার। যেন লেখা সমাজ, রাষ্ট্র আর মানুষের চোখের আড়ালে করার মতোই এক গোপন কাজ। বাবা সাহিত্যকে আমার মতো সিরিয়াসলি নেননি বলেই আমি সম্ভবত তার ওপর রাগান্বিত ছিলাম।

৪.
আমি প্রথমবার বাবার স্যুটকেস খোলার সময় একটি প্রশ্নই আমাকে তাড়িত করেছিল। আমার বাবার কি গোপন কোনো ব্যাপার ছিল? অসুখী কোনো ব্যাপার ছিল যা আমি জানি না? যার অবসান ঘটতো একমাত্র লেখালেখির মাধ্যমেই? স্যুটকেসটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভ্রমণের গন্ধ পেলাম। বাবা এর আগেই আমাকে কয়েকটি নোটবুক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। বেশির ভাগ নোটবই তিনি ভরিয়েছেন প্যারিসে থাকার সময়। তখন তরুণ বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমি যে লেখকদের পছন্দ করি তাদের জীবনীর দ্বারা উৎসাহিত হয়ে আমি জানতে চাই আমার বয়সে আমার বাবা কি চিন্তা করতেন, কি লিখতেন। …

বাবার মধ্যেও হয়তো লেখালেখি করার বছরগুলোতে একই ধরনের সুখ অনুভব করেছেন। তার স্যুটকেসে চোখ বোলাতে বোলাতে আমি ভাবি। এ ধরনের আগাম বিচার হয়তো ঠিক নয়। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি কখনোই নির্দেশ দিতেন না। নিষেধাজ্ঞা, হম্বিতম্বি, শাস্তি দেয়ার মতো সাধারণ বাবা তিনি ছিলেন না। সব সময়ই আমাকে স্বাধীন থাকতে দিয়েছেন। সবসময়ই আমাকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। আমার বন্ধুদের থেকে আমার শৈশব আলাদা হয়ে গিয়েছিল কারণ বাবার দিক থেকে আমার কোনো ভয় ছিল না। আমি খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আমি লেখক হতে পেরেছি কারণ আমার বাবা তার যৌবনে লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন। তার ব্যাপারে আমকে সহনশীল হতে হবে। …

৫.
বাবা স্যুটকেসটা আমাকে দেওয়ার ২৩ বছর আগে আমি ঔপন্যাসিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ২২ বছর বয়সে আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে ঘরবন্দি করে আমি আমার প্রথম উপন্যাস ‘কেভদেত বে অ্যান্ড সন্স’ উপন্যাসটা শেষ করেছিলাম। কাপা কাপা হাতে টাইপ করা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তিনি যেন পড়েন আর তার ভাবনা আমাকে জানান। এটা শুধু এই কারণে নয় যে, তার পছন্দ ও মেধা নিয়ে আমার আস্থা ছিল। তার মতামতের ভীষণ মূল্য ছিল আমার কাছে। তিনি বললেন, আমি একদিন পুরস্কার পাবো। সেই পুরস্কারটি নিতে আমি আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি।

তিনি আমার কাজের প্রশংসা করার জন্যই এ কথা বলেননি। অথবা শুধু পুরস্কারকে লক্ষ্য হিসেবে বেধে দিতে চাননি। তুরস্কের অন্য বাবাদের মতোই তিনি ছেলেকে সাহস ও সমর্থন দিতে চেয়েছিলেন। অন্যরা যেভাবে বলে, ‘একদিন তুমি নিশ্চিত একজন পাশা হবে’ সেভাবেই তিনি দেখা হলেই কথাগুলো বলতেন। আমার বাবা মারা গিয়েছেন ২০০২ সালের ডিসেম্বরে।

আজ আমি সুইডিশ অ্যাকাডেমি এবং মাননীয় সদস্যবর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তারা আমাকে এই বিশাল পুরস্কার দিয়েছেন, এটা বিরাট সম্মান। আমি দাঁড়িয়ে আছি অ্যাকাডেমির মর্যাদাবান অতিথিদের সামনে, আর আমার বার বার মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে তিনি যদি আমাদের মধ্যে থাকতেন!

অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস/জেসিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।