ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

একদিনে বান্দরবান

আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:২৭, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
একদিনে বান্দরবান

রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।

পাহাড়ের কোল বেয়ে বঙ্গোপসাগর পানে ছুটে চলা সাঙ্গু-মাতামুহুরি অন্যরকম এক আবহ যোগ করেছে এ জেলার সৌন্দর্যে। আকর্ষণ আরো বাড়িয়েছে চিম্বুক ও বগা লেক, ঋজুক ঝরণা, শৈল প্রপাত। পাহাড়ের আদরে বসে শরীরে মেঘ মাখার বিরল সুযোগও হরহামেশা পাওয়া যায় বান্দরবানে। ১১ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছাড়াও বাংলাভাষীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে পাহাড়ময় বান্দরবান জেলায়। সম্প্রতি বান্দরবান ঘুরে এসেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।

বান্দরবান থেকে ফিরে: পিঠে জোর আছে তো! তাহলে একদিনে ঘুরে আসুন বান্দরবান। চট্টগ্রাম থেকে ৯২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বের পাহাড়ি শহর বান্দরবান। এর আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবারিত সবুজের সমারোহ আর মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে যার আছে তিনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের হিমালয়কন্যা খ্যাত বান্দরবান থেকে।     

হাতে খুব বেশি সময় নেই। তহালে দুই রাত একদিনেই ঘুরে আসতে পারবেন বান্দরবান থেকে। ঢাকা থেকে সরাসরি রাতের গাড়ি আপনাকে ভোরেই পৌঁছে দেবে বান্দরবান শহরে। হাতে মুখে পানি দিয়ে নাস্তা সঙ্গে নিয়ে ঠিক করে ফেলুন একটি চাঁদের গাড়ি।   দলে বেশি হলে এতে একটু সাশ্রয় হবে।

বান্দরবান শহর জেগে ওঠে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। আর তা যদি হয় পর্যটন মৌসুমে তাহলে তো কথাই নেই। ঝামেলা এড়াতে চাইলে আগে থেকে ফোনে যোগাযোগ করে ঠিক করে রাখতে পারেন গাড়ি। গাড়ি ঠিক সময় মতোই উপস্থিত থাকবে আপনার জন্য। তবে ভয়ের কিছু নেই, যদি না পারেন রাতে ঠিক করে রাখতে তাহলে সকালেও ঠিক করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার সময় অপচয় হবে খানিকটা।

বান্দরবান শহর থেকে চাঁদের গাড়ি নিয়ে সারাদিন ঘুরতে ভাড়া নেবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আপনার যদি না জানা থাকে কোথায় কোথায় যাবেন তাতেও কোনো সমস্যা নেই। গাড়ির ড্রাইভার-হেলপারই আপনাকে জানিয়ে দেবে সব। সকাল ৭টার মধ্যেই রওনা দিতে হবে আপনাকে। নইলে সবগুলো স্পট ঘুরে দেখার সময় পাবেন না আপনি।

সকাল ৭টায় রওনা হলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন নীলগিরি। তবে এর আগে আপনি পেয়ে যাবেন আরও একটা দর্শনীয় স্থান। বান্দরবান শহরের সবচেয়ে কাছাকাছি উঁচু চিম্বুক পাহাড়। নীলগিরির পর্যটন কেন্দ্র তৈরির আগে এটাই ছিল অন্যতম দর্শনীয় স্থান। নীলগিরি হওয়ার পর এর জাঁকজমক কিছুটা কমে গেছে।

অনেক ভোরে পৌঁছুলে এখনও মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পাবেন এখানে। ‘বাংলার দার্জিলিং’ খ্যাত চিম্বুকের নাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আজ বিদেশেও পরিচিত। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী পর্যটন স্পট যা জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা প্রায় ২৬০০ ফুট।

চিম্বুকে খানিকটা সময় কাটিয়ে সোজা নীলগিরি। নীলাম্বরী যেন তার আঁচলখানি পেতে রেখেছে আপনার জন্য। সেখানে স্বচ্ছ নীল চূড়া (আকাশ) যখন আপনাকে অভিভূত করে রাখবে তখন আপনি আরো অবাক হবেন এই দেখে যে আপনি ভাসছেন মেঘের ভেলায়।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কাফ্রুপাড়াসংলগ্ন পাহাড়চূঁড়ায় এটি অবস্থিত।

চাইলে রাতও কাটাতে পারেন এখানে। রাত কাটানোর জন্য আছে রিসোর্ট। এসি অথবা নন এসি। প্রতি রাতের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ৩-৫ হাজার টাকা।

মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কাটাতে পারেন বেশ খানিকটা সময়। এরপর গন্তব্যস্থল আবারো বান্দরবান শহর। সকালে ঢাকা থেকে নীলগিরি যাওয়ার পথটা উভোগ করতে ভুলবেন না। কারণ মেঘের ভেলায় চড়ে, একরাশ সিন্গ্ধতা নিয়ে যখন নীলগিরি প্রথম পৌঁছুবেন, তখন অনেকের মুখেই শুনতে পাবেন, খরচ করে মেঘ দেখতে কেন নেপাল যাব। বান্দরবান তো আরও সুন্দর!

শহরে ঢোকার মুখে নেমে যাবেন শৈলপ্রপাত। পাহাড়ের খাঁজ কেটে কেটে বয়ে চলছে পানির নহর। এখানে আপনি পেয়ে যাবেন প্রিয়জনের জন্য কিছু সুন্দর উপহারও। তাঁতে বোনা কাঁথা, মাফলার প্রভৃতি। ডিজাইন আর সুতা ভেদে দাম পড়বে ছয় থেকে ১২শ’ টাকা।

এরপর সোজা শহরে। দুপুরের খাবার সেরে আবারও বেরিয়ে পড়ুন। এবার গন্তব্য মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের পাশে পাহাড়বেষ্টিত স্বচ্ছ জলের মনোরম লেক। বান্দরবান শহর থেকে ৪.৫ কিলোমিটার দূরে এই কমপ্লেক্স রয়েছে চিত্তবিনোদনের নানাবিধ উপকরণ। প্যাডেল বোড, কেবল কার, মিনি চিড়িয়াখানা সহ রয়েছে নানা জিনিস। সাথে নানা রকম পাহাড়ি ফল তো রয়েছেই। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি চিড়িয়াখানাসহ পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে।

এতে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৩০ টাকা। এখানে জেলা প্রশাসন পরিচালিত একটি সুন্দর রেস্ট হাউজ রয়েছে, যেখানে রাত্রিযাপন করা যায়। রেস্ট হাউজটি দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় পাওয়া  যায়। মেঘলা রেস্ট হাউজে রাত্রিযাপনের জন্য চারটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিকক্ষের ভাড়া ২০০০/- (প্রতিদিন)।

এখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে চলে যান স্বর্ণ মন্দির। বিকেলের সোনালি রোদ আর মন্দিরের রং মিলে মিশে একাকার। পড়ন্ত বিকেলে দূর থেকে যখন মন্দিরে দিকে চোখ পড়বে মনে হবে পুরো মন্দিরটি যেন স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা। আদতে এর মুকুটগুলো স্বর্ণের বলে জানা যায়।

বান্দরবান শহর থেকে ৪ কি মি দূরে বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কের পার্শ্বে পুরপাড়া নামক স্থানে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় স্বর্ণ মন্দিরের অবস্থান। এ স্থানটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।

স্বর্ণ মন্দিরে এলে পাশাপাশি সাঙ্গু নদী, বেতার কেন্দ্রসহ বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহজেই উপভোগ করা যায়। বালাঘাটস্থ পুরপাড়া নামক স্থানে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় এ জাদি অবস্থিত, যা বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র এক তীর্থস্থান।

স্বর্ণ মন্দিরের বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর অবকাঠামোগত সৌন্দর্যও দেখার মতো। মন্দিরের বাইরের অংশে ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে তিব্বত, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভুটান, মিয়ানমার, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের শৈলীতে সৃষ্ট ১২টি দণ্ডায়মান বুদ্ধ আবক্ষ মূর্তি এখানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

মন্দিরের পূর্বদিকে বান্দরবান শহর ও চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মায়ানমার থেকে শিল্পী এনে এটি তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ স্থানটি খুবই আকর্ষণীয় এবং একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট।

শেষ বিকেলে অবশ্যই যাবেন নীলাচলে। নীলাম্বরী যেন তার সবটুকু নীল ঢেলে দিয়েছে এখানে। চারদিকে ধোয়াটে কুয়াশা। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়িদের ঘর। দূর থেকে উকি মারছে স্বর্ণ মন্দির। আর একটা মজার বিষয় হল এ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবের পুরো বান্দরবান শহরই।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না, একটু পরেই দেখতে পাবেন কনে দেখা আলোয় ছেয়ে আছে আপনার চারপাশ। নীল, লাল আর সোনালি আভায় সে এক বিস্ময়কর রঙের ছটা। আমাদের মতো অভিভূত হবেন আপনিও।    

একটু পরেই দেখবেন আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা নামছে। শুভ্র মেঘ উড়ে উড়ে জমা হচ্ছে সবুজ গাছের মাঝে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মেঘের জন্ম দেখাকে এ ছাড়া আর কি বলা যায়!  

নীলাচলের কোলে সুন্দর একটি সন্ধ্যা উপভোগ করে শহরের বার্মিজ মার্কেটে কেনাকাটা সেরে রাতে রওয়ানা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।

যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।

থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।

বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন।   খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
এসএটি/এএ/এমজেএফ/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।