ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মহাদায়ে বয়সী রিকশাচালক বাদশা মিয়া

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫:১৪, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৩
মহাদায়ে বয়সী রিকশাচালক বাদশা মিয়া

ঢাকা: রাজধানীর পলাশী মোড়ে রিক্সার সিটে ঠেস দিয়ে বসা এক বৃদ্ধা। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

যেন জগতের সব চিন্তা তার মাথায় ওপর ভর করেছে। একটু পর পরেই গামছা দিয়ে মুখ ও কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছিলেন। অনেক রিকশা আসছে, যাত্রী নিয়ে চলেও যাচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধের অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না।

রাস্তার উপর একটি রুটি দোকান। পাশে পিঠা বিক্রেতা। আরও দু’টি চায়ের দোকান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দলবেধে আসছেন নাস্তা করতে। আসছেন স্থানীয় অনেক যুবকও। দু’ একটি মালবাহি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রাতের নীরবতা ভেদ করে দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে। একবার সব রিক্সা চলে গেলে নড়ে চড়ে বসেন বৃদ্ধ। এইবার বুঝি তার ডাক পড়বে।

m4রুটির দোকানটি খরিদদারদের প্রতি খেয়াল রাখেন। কখন খাওয়া শেষ করে হোস্টেল অথবা বাড়ির পথে পা বাড়াবেন খরিদদার। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কাঁধ ঘুরিয়ে আশপাশেও দেখে নেন কোনো রিক্সা এসে পড়েনি তো আবার? এলেই ফ‍ঁসকে যাবে তার ভাড়া।

কিন্তু না খরিদদার ডিম রুটি খাওয়ার পর আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দেন। চা শেষে সিগারেট ধরান। অন্যদিকে চলতে থাকে বাদশা মিয়ার রদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। সিগারেট শেষ করে পা বাড়ানোর আগেই হঠাৎ দু’টি রিক্সা এসে হাজির। আবার কপাল থেকে ঘাম ঝরা শুরু হয় বৃদ্ধার।

এবারও তাকে হতাশ হতে হয়। রিক্সার কাছে এসে দু’যুবকের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। একজন উঠতে চাইলেও অন্যজন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। বলে ওঠেন বাবার বয়সী রিক্সা চালকের রিক্সায় উঠতে বিবেকে বাঁধে। আমি উঠতে পারব। তুই চাইলে একা ‍যা।

যাত্রীরা চলে গেলে কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন বাপেতো বাদশা মিয়াই রেখেছিলো। বাড়ি শরিয়তপুরের জাজিরা থানার কাজিকান্দি গ্রামে। জমি জিরাত ভালোই ছিলো। সারা বছর ঘরের ভাত খেয়েও কিছু চাল বিক্রি করা যেতো। আড়িয়ালখাঁ নদী সবটুকুই গিলে ফেলেছে। শেষে বসত ভিটা খেয়ে নিলে যুদ্ধের ২বছর পর ঢাকায় আসেন। সেই থেকে রিক্সা চালিয়ে জীবন চলছে বাদশা মিয়ার।

বলেন, ৪০বছর ধরে রিক্সা চালাই। আর কোন কাম জানি না। কিন্তু এথন আর যাত্রী উঠিতে চায় না। কেউ মনে করে বয়স বেশি, জোরে চালাতে পারবে না। আবার কারো নাকি বিবেকে বাঁধে! কেউ চিন্তা করে না, তারা না উঠলে আমাদের খাবার জুটবে কেমনে। বৃদ্ধ রিক্সা চালকদের নাকি সকলেরই এমন দুর্গতি। m2

বাধ্য হয়ে ছাড়া তাদের রিক্সায় কেউ উঠতেই চায় না। যখন অন্য রিক্সা পাওয়া যায় না শুধুমাত্র তখনই ডাক পড়ে তাদের। সে কারণে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে বাবা কিংবা দাদার বয়সী এসব রিক্সা চালকরা। যুবক ও তরুণরা এড়িয়ে গিয়ে দায় সারেন। আর তাদের এই সারা দায় নিয়ে মহা দায়ে থাকে বৃদ্ধ চালকেরা।

যৌনকর্মী আর রিক্সা চালকদের মধ্যে নাকি একটা সাদৃশ্য আছে। যতদিন যৌবন আছে ততদিন চাহিদা থাকে। আর যখনই যৌবন শেষ তখনই পদে পদে বিড়ম্বনা বলে জানান বাদশা মিয়া।

দিনে রিক্সা চালাতে পারে না গরমের কারণে। তাই পেটের দায়ে প্রতি রাতে বের হন রিক্সা নিয়ে। রিক্সার ভাড়া দিতে হয় ১’শ টাকা। যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না।

থাকেন কামরাঙ্গিচরের নয়াগাঁও এলাকায়। বাসা ভাড়া দিতে হয় হয় মাসে ৩ হাজার টাকা। বলেন ‘হের লাইগাই তো সমস্যা। ’ দুই ছেলে রয়েছে। তারা থাকেন শরিয়তপুরে। তার তেমন খোঁজ নেন না। আর নিবেনই কেমনে, তাদের নিজেদেরই চলে না।

আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, যদি নিজের একটা রিক্সা থাকত। তাহলে এত চিন্তা করতে হতো না। এখন নিজের খাওয়া না হলেও রিক্সার জমা ঠিকই দিতে হয়। একটা নতুন রিক্সার কেনার খুব ইচ্ছা। কিন্তু কোনভাবেই ১৬হাজার টাকা জুটছে না তার।

খেয়ে না খেয়ে কিছুটা জমাতে চাইলেও পারেন না নানা রকম অসুখের কারণে। শরীরটাও নাকি বেয়াড়া হয়ে গেছে। আর খাটুনি সহ্য করতে চায় না। আজ এক ‍অসুখ, কাল আরেক অসুখ এ করেই কাটছে দিন।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৩
ইএস/এনএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।