ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

জীবন চলে মাছ কুড়িয়ে

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪৮, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩
জীবন চলে মাছ কুড়িয়ে

ভোলা: শাহিনুর আক্তার (১৩)। খুব ভোরে ঘুম ভাঙে তার।

ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যায় পাতার খালের মৎস্যঘাটে। জেলেদের কাছে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত।

সারাদিনে ছোট ছোট যেটুকু মাছ যোগাড় হয় তা বিক্রি করেই দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে সে। আবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একইভাবে হাত বাড়ায় জেলেদের কাছে।
 
যে বয়সে তার বই নিয়ে স্কুলে পড়াশোনা করার কথা, সঙ্গীদের সঙ্গে আনন্দ উচ্ছ্বাস করার কথা, সে বয়সেই ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে ছিন্নমূল পরিবারের এ মেয়েটিকে।

দৌলতখানে মেঘনার পাতার খাল মৎস্যঘাটে কথা হয় শাহিনুরের সঙ্গে। সে জানায়, পরিবারে বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বড় বোন নাছিমার বিয়ে হলেও যৌতুকের জন্য তাকে ফেলে রেখে গেছে পাষণ্ড স্বামী।

এ অবস্থায় তাদের বাবা হারুন তাদের ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছে। এ পরিবারের ভরন পোষণ আর তিনি দেন না।

বাধ্য হয়েই মা রহিমা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। অভাব বেড়ে যাওয়ায় শাহিনুর ছোট বোন কহিনুরকে নিয়ে মাছ ভিক্ষা করে বেড়ায়।

শুধু শাহিনুর নয়। শাহিনুরের মতো এ ধরনের অনেক শিশু রয়েছে যারা অভাবের তাড়নায় ভিক্ষার ঝুলি হাতে তুলে নিয়েছে। অভাবই তাদের বাধ্য করেছে অন্যের কাছে হাত বাড়াতে।

নদী ভাঙনে ভিটেহারা শত শত পরিবারের আশ্রয় ভোলার দৌলতখান উপজেলার বিভিন্ন বেড়িবাঁধ এলাকায়। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এসব পরিবারের শিশুদের মধ্যে কেউ কাজ করেন চায়ের দোকানে, কেউ নৌকাতে আবার কেউ মাছ ভিক্ষা করে।

ভবানীপুর ও পাতারখাল মৎস্যঘাটে এ ধরনের ভিক্ষুকের সংখ্য ৩ শতাধিক। যারা একটি ছোট মাছের জন্য ছুটে যান এ নৌকা থেকে ওই নৌকাতে।

পাতারখাল মৎস্যঘাটে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দল বেধে ছোট ছোট মেয়েরা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। টাকা পয়সা কিংবা চাল নয় এরা ভিক্ষা করে নদীতে আহরণকৃত মাছ।

সারাদিন ভিক্ষা করে যা মাছ পাওয়া যায়, সবটুকু বাজারে বিক্রি করে টাকা মেলে, তা দিয়ে চলে সংসার তাদের। সাহায্য চাইতে গিয়ে তাদের কখনও কখনও মারপিট ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
 
জেলেদের নৌকা ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় এসব শিশুদের ব্যস্ততা। ছুটে যায় ভিক্ষা করতে। কার আগে কে সাহায্য চাইবে এ প্রতিযোগিতা চলে নিজেদের মধ্যে।

নদীতে মাছের ওপর নির্ভর করেই চলে এদের জীবন জীবিকা। জেলেদের জালে বেশি মাছ ধরা পড়লে জেলেরা খুশি থাকেন। তখন তাদের কাছে মাছ চাইলে তারাও বেশি মাছ দেয়।

কিন্তু নদীতে মাছ কম পড়লে তারা মাছ দিতে চায় না। তখন এদের সংসার চালানো হয়ে পড়ে দুস্কর।

ছিন্নমূল পরিবারের এসব মানুষ অভাবের তাড়নায় জেলে নৌকাতে হাত বাড়ান। তবে মাঝে মধ্যেই মাছ চাইতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হন কিশোরীরা। তবুও মাছ পাওয়ার আশায় তা নিরবে সহ্য করে তারা।
 
ঘাটে গিয়ে এ ধরনের কয়েক শিশুর সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, তাদের সুখ-দুঃখ আর জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার কষ্টের কথা।

কমলা (১৪) জানায়, তারা ৫ বোন এক ভাই। দুই বোনের বিয়ে হলেও এক বোন নিখোঁজ। এখনও দুই বোনের বিয়ে দেওয়া বাকি।

সে নিজেই নিজের বিয়ের টাকা জোগাড় করছে। সারাদিন মাছ কুড়িয়ে ও ভিক্ষা করে ৩/৪শত টাকা পাওয়া যায়। ওই টাকা কিছু অংশ সংসারের খরচ মেটানো হয়। বাকি টাকা তার বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখা হয়।

তার বাবা আবু তাহের রিকশা চালক ছিলেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। রিকশা চালাতে পারেন না। তাই মা কামরুন নাহারকে নিয়ে মাছ ভিক্ষা করে সে।

ছিন্নমূল পরিবারের মেয়ে বকুলি (১৩) জানায়, অভাবের তাড়নায় মাছ ভিক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। পরিবারে তাদের ৫ বোন। কারও বিয়ে হয়নি।

ছোট বোন পারুল, জিনুম, আছিয়া ও রানুকে পড়াশুনা করানোর ইচ্ছা থাকলেও যেভাবে বেঁচে থাকার লড়াই সেখানে পড়ালেখা স্বপ্ন তার কাছে। নদীতে ঘরভিটা ভেঙে যাওয়ায় অন্যের জমিতে কুঁড়েঘরে কষ্টে দিন কাটছে তাদের।

তাহমিনা (৯)। ২য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে অভাবের তাড়নায় আর লেখাপড়া হয়নি তার।

সে জানায়, বাবা ফারুক ভরন পোষণ করে না। ভাই না থাকায় খোঁজ খবরও নেয় না। পরিবারের সবাই এখন ভিক্ষা করে দিন কাটাচ্ছে। সারাদিনে ২/৩শ টাকা জুটে। ওই টাকাই একমাত্র ভরসা।

সে জানায়, ইচ্ছে করে পড়ালেখা করতে। খেলাধুলা করতে। কিন্তু যেখানে খাবারই জোটে না, সেখানে পড়াশোনা হবে কোথা থেকে।

রাবেয়া (১০) জানায়, তার বাবা কামাল হোসেন ছোট থাকতেই মারা গেছে। মা তাসনুর অন্ধ। ছোট ভাইকে নিয়ে মাছ ভিক্ষা করছি। ছোটবেলা থেকেই মাছ ভিক্ষা করে দিন কাটাচ্ছি।

ছিন্নমূল পরিবারের গৃহবধূ রেবু বেগম (২৬) জানায়, স্বামী জাহাঙ্গীর বহু বছর আগেই মারা গেছেন। ৫ মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে দিন কাটছে তার। পরিবারের সাবই মাছ টোকান। সকালে, দুপুরে ও বিকেলে ৩ বার মাছ টুকিয়ে দিন কাটে তাদের।

তিনি জানান, নদীতে মাছ বেশি ধরা পড়লে বেশি মাছ পাওয়া যায়। কম পড়লে কম মাছ কপালে জোটে।

দৌলতখানের বেড়িবাঁধ এলাকায় বাস করেন প্রায় ৪ হাজার মানুষ। সেখানে ছোট ছোট ঘরে বসবাস করেন তারা। নদী ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে ঠিকানাও পাল্টাতে হয় তাদের।

সহায় সম্বল হারা পরিবারগুলো অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বাস করে। নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ভুগছেন অপুষ্টিতে। বাল্যবিয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেখানে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩
এমজেড/পিসি/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।