ভোলা: ‘নৌকা আমার জীবন ওরে,
তাইতো নদীর কূলে ভাসা
তুমিতো নও শুধুই নদী,
তুমি আমার ভালবাসা...’
পানিতে ভাসমান জীবন কাটানো মানতা সম্প্রদায়ের মেয়ে সাফিয়া খাতুনদের উপলদ্ধি এ রকমই। নৌকা ও নদী তাদের শুধু সমগ্র জীবনই নয়, ভালবাসাও।
৫৫ বছর আগে সাফিয়া খাতুনের জন্ম হয়েছিল নৌকায়। তারও আগে তার বাবা-মা, তাদের পূর্বপুরুষদের জন্মও তারই মতো নৌকাতেই।
জন্মের পর সাফিয়া খাতুনের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য কেটেছে নৌকায়। যৌবন ও জীবনের সবটুকু সময়ই নৌকায় কাটিয়ে দেওয়া এই বৃদ্ধার ঘরবাড়ি সাধ-স্বপ্ন সবটুকই ক’ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের নৌকাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে অহর্নিশ।
একসময় বাপের নৌকা ছেড়ে তার আশ্রয় হয়েছে স্বামীর নৌকাতে। সেখানেই বেড়ে উঠেছে তার সংসার এবং সন্তানেরা।
বাপ-দাদার নৌকাভাসী ঐহিত্য লালন করেই তিনি পার করে এসেছেন জীবনের ৫৫টি বসন্ত বেলা। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মের কারোরই এই পানিতে ভাসমান জীবন ভাল লাগেনা। ভাল লাগেনা এই যাযাবর জীবন। তারা ফিরতে উগ্রগীব ডাঙার জীবনে। যেখানে সবাই সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ও মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা গৃহে বাস করে। মাথার উপরে ডেকে ডেকে হয়রান হয় দোয়েল, কোকিল। শুকিয়ে কাঠ হওয়া মাটির বুক চিরে কৃষক বের করে আনে শস্যদানা, পড়াশোনা করে কেতাদুরস্ত পরিপাটি চলাফেরা করে মানুষজন।
মানতাদের তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে এরকম জীবন। তারা চায় ক্ষুদ্র ক’ফুট ছাউনির তলা থেকে বেড়িয়ে এসে বিশাল আকাশের নিচে মাটির পৃথিবীর আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে।
মানতারা জানান, দেশের নাগরিক হয়েও কোনো নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। সরকার যদি তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিত তাহলে তারা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত।
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়। মানতাদের বৃদ্ধরাও অনেকে চান শেষ জীবনে অন্তত মাটির গন্ধে দিন কাটাতে।
প্রায় সাত দশক নৌকায় কাটানো বৃদ্ধ মো. সাদেক সর্দার (৬৮) চান মাটির পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন।
সাদেক সরদারের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেরাও সংসার করছে, তার মতো নৌকাতেই।
তিনি জানান, এ দুর্বিষহ জীবন আর ভালো লাগে না। শেষ বয়সে মূল ভূ-খণ্ডে বাঁচার স্বপ্ন তার। অন্তত মরার আগে তিনিও চান অন্যদের মত স্বাভাবিক জীবন।

নৌকাতেই চলছে তাদের ঘরকন্না, হাসিকান্না, ঈদ-পার্বণ সব। এমনকি বিয়ে বা উৎসব তাও হয় নৌকাতেই।
ভোলা সদরের ইলিশা ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজন মানতা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের সঙ্গে।
তারা জানান, সারাদিন তারা নদীতে জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন। কারেন্ট, সান্দি আর পোয়া জাল দিয়ে ইলিশ, পোয়া, পাঙ্গাস আর ছোট বড়-মাঝারি সাইজের বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ শিকার করেন। সেগুলো বাজারে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে চলে সংসার।
কিন্তু এ জন্য তাদের বহু কষ্ট পোহাতে হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবিকার খোরাক যোগান তারা। কখনওবা মোকাবেলা করতে হয় বৈরি প্রকৃতি কখনওবা দস্যুর হামলা।
তারা জানান, একই স্থানে ২/৩ মাসের বেশি সময় থাকেন না। যেখানে বেশি পরিমাণে মাছ ধরা পড়ে উপকূলের সেই স্থানেই তাদের বেশি সময় অবস্থান করা হয়। মাছ ধরা না পড়লে কখনও কখনও পরিবার-পরিজন নিয়ে উপোষ থাকতে হয়।
এছাড়া নৌকার জীবন কাটাতে গিয়ে নদীতে পড়ে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট শিশুর প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
মানতা সম্প্রদায়ের এক সদস্য জামাল সরদার (৩১)। ৫ ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক নৌকাতে গাদাগাদি করে থাকেন তিনি।
তিনি জানান, মাছ পাওয়ার আশায় সারাদিন নৌকা নিয়ে ঘুরতে হয় নদীর একপ্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সারাদিন জাল বেয়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয়। এরমধ্যে তেল খরচ বাদ দিয়ে যা থাকেই তা দিয়ে পরিবারের খাবার ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ করাই দুরূহ। কিন্তু যখন মাছ কম পড়ে তখন কষ্টের সীমা থাকেনা।
এ সময় জামালের স্ত্রী হাসিনার ছবি তুলতে গেলে তিনি এ বলেন, আমাগো ছবি তুইল্যা কোনো লাভ নেই। সরকার আমাগো কোনো খবর নেয়না।

মানতা গৃহবধূ মনিরম বিবি জানান, তাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভুগতে হয় শীতকালে। সে সময় নদীতে মাছ খুব কম ধরা পড়ে।
বৃদ্ধ সাফিয়া খাতুন জানান, যাযাবর জীবন হলেও তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভোটার হয়েছেন। তিনি নিজেও ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের একজন ভোটার। নির্বাচন এলে কখনও কখনও তাদের ভোট দিতে হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তাদের খোঁজ নেয়না। সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দ এলেও নাগরিক হিসেবে ওই বরাদ্দের ছিঁটেফোটাও তাদের ভাগ্যে জোটেনা।
মাছ ধরা পদ্ধতি
মানতাদের মাছ ধরার পদ্ধতি সাধারণ জেলেদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ছোট ছোট জাল দিয়ে পোয়া, ইলিশ, পাঙ্গাস আর ছোট ছোট পোনা জাতীয় মাছ শিকার করেন তারা। মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করে সেই মাছ আবার উপকূলের বিভিন্ন ঘাটে কম দামে বিক্রি করেন। তবে তারা গভীর নদীতে মাছ শিকারে যান না। উপকূলের কাছকাছি থেকে মাছ শিকার করেন।
মাছ শিকারে পুরুষদের মতো নারীরাও সমান পারদর্শী। অল্প বয়স থেকেই মানতা সন্তানেরা মাছ শিকারের কৌশল শিখে নেয়। বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে মাছ শিকারে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে এরা।
মানতাদের বিয়ে পদ্ধতি
মানতাদের একেকটি বহরে ৩০-৭০টি নৌকা থাকে। একযোগে এরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। প্রতিটি বহরের সদস্যরা একে অপরের আত্মীয়। এদের বিয়ে হয় আত্মীয়দের মধ্যেই। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকার কারও সঙ্গে। তবে এরা ডাঙাবাসীর মতোই ইসলামী রীতিতে কাজী ডেকে এনে বিয়ে পড়ায়। আর্থিকভাবে একটু স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যরা সাউন্ড বক্স, মাইক বাজিয়ে নাচ-গান করে বিয়ে উৎসব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে নৌকা বহরের সকল সদস্য দাওয়াত পান। সেদিন সবার মাছ শিকার বন্ধ থাকে।
মানতাদের বিয়েতে যৌতুক প্রথা নেই বললেই চলে। তবে মেয়ে জামাইকে কেউ কেউ খুশি হয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তবে কিছুদিন ধরে প্রচলিত নিয়ম পাল্টানোর চেষ্টা করছে মানতাদের অনেকেই। অনেকেই এখন নিজ বহরের নৌকায় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে চান না। অন্য বহরে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তাদের।
নৌকাই জীবন
মানতা সম্প্রদায়ের শিশুরা জম্মের পর থেকে নৌকার জীবন দেখে। নৌকার ছাউনি থেকে উঁকি মেরে দেখে বিশাল আকাশ আর নিচে অথৈ জলরাশি। এই নৌকাতেই তারা বেড়ে ওঠে। নৌকাতেই তাদের রান্না, খাওয়া-দাওয়া, নৌকাতে ঘুম, নৌকাতে বিয়ে, নৌকাতেই ঈদ, নৌকাতেই সব।
পরিবারের সদস্য বেশি থাকলে দুই বিছানা তৈরি করা হয়। সেখানেই রাত্রিযাপন। মানতাদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য প্রবল। যেকোনো হামলা ও বিপদ তারা একত্রে প্রতিহত করেন। একে অপরের প্রতি তাদের হিংসা-বিদ্বেষ নেই বললেই চলে।
মানতাদের প্রতি বহরেই রয়েছে একজন সর্দার। তিনিই নিজেদের মধ্যে ছোট বড় সব ঝামেলা নিষ্পত্তি করেন। তবে বড় ধরনের অপরাধ হলে তা থানা পর্যন্ত গড়ায়।
ইদানীং মানতা যুবকদের দু একজন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এছাড়া খবরাখবর জানতে নৌকা বহরে দু একটি রেডিওর দেখা মেলে।
স্বাস্থ্য চিত্র
অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশেই এরা বেড়ে ওঠে। নৌকাতে জীবন কাটানোর ফলে এরা স্বাভাবিক পরিবেশ পায়না। ছোট ছোট শিশুরা ভোগে নানা অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে। তবে বয়স্কদের রোগ বালাই নেই বললেই চলে। গর্ভবতী নারীরা সন্তান প্রসব করেন নৌকাতে। তবে জটিল সমস্যা হলে হাসপাতালে যেতে হয়। অনেক প্রসূতি নারীই আবার হাসপাতালে যেতে চাননা। ফলে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে হরহামেশাই।
অনিশ্চিত জীবনমানতাদের জীবন চরম অনিরাপদ। নদীতে অহরাত্রি তাদের দস্যুর ভয়ে কাটাতে হয়। যখন উপকূলের কাছাকাছি থাকেন তখন আবার চোর-ডাকাতদের ভয়। ঝড়-জলোচ্ছাসের সময় এরা পায়না কোনো সতর্কতা সংকেত। তাই দুর্যোগের মধ্যেও তাদের থাকতে হয় নদীতে।
মানতাদের পড়াশোনা
মানতা সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই অশিক্ষিত। নতুন প্রজন্মের কারও কারও সামান্য অক্ষরজ্ঞান থাকলেও বাকিরা সবাই অক্ষরজ্ঞানহীন। মূলত নদীতে ভাসমান জীবন কাটানোর ফলে মানতাদের পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনা। এছাড়া নিত্য অভাব আর টানাপোড়েনও তাদের শিক্ষার অন্তরায়।
সাফিয়া, সাদেক, জামাল, কদম আলী ও সুলতানদের মতো আধুনিক সভ্যতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ যুগ যুগ ধরে বাস করছেন নৌকাতে। বাপ-দাদার পেশা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে চলছে এদের দিন। অনেকটা নির্বাসন দণ্ডের মতো জীবন কাটছে এদের। এক সময় এ জীবনে প্রাচুর্য্য ও সুখ থাকলেও এখন আর সেই সুদিন নেই। কিন্তু ডাঙায় নিজেদের জমি-জমা না থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছেন না তারা। তবুও অধীর প্রতীক্ষা নিয়ে তারা চেয়ে আছেন সরকারি পদক্ষেপের আশায়।
তাদের চাওয়া সরকারিভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের এই নৌকার জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। তৈরি করে দেওয়া হোক কোনোরকম মাথা গোঁজার ঠাই। এটুকুই তাদের পরম চাওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৩
এসআই/এসআর/এমজেডআর