ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দইড় কারিগরের ভাসমান জীবন

আবু তালহা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৫০, অক্টোবর ৪, ২০১৩
দইড় কারিগরের ভাসমান জীবন

ঢাকা: রাজধানীর অতিপরিচিত জায়গা আমিন বাজার। শুধু রাজধানীবাসীদের কাছেই নয়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছেও এটি সুপরিচিত নাম।

একদিকে আমিন বাজার যেমন উত্তরবঙ্গ-রাজধানীর সংযোগস্থল, অন্যদিকে অনেক মানুষের অন্নদাতাও।

রাজধানীর এ প্রবেশ মুখকে ঘিরে বাস-ট্রাক-লঞ্চ পরিবহন, ডিঙি নৌকা, ইটভাটা গড়ে ওঠায় ভোর রাত থেকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পদচারণায় গভীর রাত অবধি কর্মব্যস্ত থাকে এ এলাকা, যোগান দেয় অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকার।

জীবিকার তাগিদে অনেকের মতো প্রায়ই আমিন বাজার আসেন মোহাম্মদ গুঞ্জুর আলী। তামাটে গায়ের রং, ধূসর চুল-দাড়ি। আসল নাম কফিল উদ্দিন ফকির হলেও বিভিন্ন সময় মানুষের মুখে মুখে বদলে হয়েছে গুঞ্জুর আলী। সোমবার দুপুরে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হয় তার।

১৯৩৯ সালের ৪ আগস্ট জামালপুর মেলানগড় থানার বীরহাতিজা গ্রামে জন্ম হয় গুঞ্জুর। তিন ছেলে, তিন মেয়ের জনক ৭৪ বছর বয়সী এ লড়াকু দীর্ঘ ৪৮ বছর বাঁশ কেটে গড়ে চলেছেন এক অসাধারণ শিল্প। বাঁশের চিকন শলাকার দইড়, চাঁই, খুলসুন বা মাছ ধরার ফাঁদ বোনেন তিনি। তবে তার কাছে দইড় হিসেবেই পরিচত এটা।

গুঞ্জুর আলী বাংলানিউজকে কাছে পেয়ে বলেন, বাবা ছিল গোয়াল, গ্রামে নসু গোয়াল নামে এক ডাকে পরিচিত ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরে কাজের সন্ধান করতে হলো। ছোটবেলা থেকে দুস্টুমি করে সময় কাটিয়ে দিয়েছি লেখাপড়া শিখিনি, কি করবো। আগে অন্যের জমিতে কাজ করতাম।

অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আগের মতো কাজ করতে পারতাম না। ছোটবেলাতেই শিখেছিলাম দইড় বানানো। তাই এ পেশা শুরু করলাম। যখন যেখানে কাজ পাই জামালপুর, ঢাকা, অন্য কোনো জেলায় সেখানেই যাই কাজ করতে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান সপরিবারে। যুদ্ধ শেষে ফিরে দখল পাননি জায়গা-জমিতে। আমিন বাজারের এক টুকরো জমিও হারান অভাবের তাড়নায়।

গুঞ্জুর আলী বলেন, যুদ্ধ করার সাহস ছিল না সেসময়। বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে আর কিছুই পাইনি। টাকার অভাবে আমিন বাজারের জমিও বিক্রি করে দেই। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারিনি।

তিনি বলেন, এখন স্ত্রী জমিলা বেগম (৬০), বড় ছেলে মোহাম্মদ দিলদার (৪৮) আর মেজ ছেলে মোহাম্মদ মান্নান (৪৩) আমার সঙ্গেই কাজ করে। আর ছোট ছেলে মোহাম্মদ শাহীন (৩৫) দেশের বাড়িতে রিকশা চালায়। আমরা চার জন ঘুরে ঘুরে কাজ করে বেড়াই।

সম্প্রতি ১৬৫টি মাছ ধরা দইড় তৈরির চুক্তি নিয়ে আমিন বাজার এসেছেন গুঞ্জুর আলী। প্রতিটি দই বিক্রি করবেন ২০০ টাকায়।

তিনি বলেন, একটি মাছ ধরা দইড় তৈরি করতে একজনের পুরো একদিন সময় লাগে। তাই আমরা সব কিছু তৈরি করে নিয়ে এসে শুধু বেঁধে দিই। বর্তমানে একটি দইড় তৈরিতে সব মিলিয়ে খরচ দেড়শ’ টাকা।

এভাবেই গত ৪২ বছর ধরে ভেসে চলেছে গুঞ্জুর আলীর জীবন। সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থাই এগিয়ে আসেনি তাদের কল্যাণে এমন আক্ষেপও আছে তার। দেশ স্বাধীন হয়েছিল সবার জন্য। কিন্তু আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধাই পেলাম না।

লড়াকু গুঞ্জুর আলী কোনো করুণা চান না। তাই জীবনের শেষ সময়ে এসেও স্রোতের বিপরীতে বেয়ে চলেছেন জীবন তরী। তার তৈরি করা দইড় কিনতে চাইলে (০১৭৭১ ০৮৪৯২২) এ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৩
এটি/এসএইচ/এএ/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।