ঢাকা: ধসে পড়েছে সাভারের রানা প্লাজা। ভেতরে আটকে রয়েছেন হাজারো মানুষ।
স্মরণকালের ভয়াবহ ভবনধসের দুর্যোগ ছাড়াও অসংখ্য ঘটনায় বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ফেনীর ছাগলনাইয়ার সাইফুল ইসলাম নেসার। কখনো হাজির হয়েছেন চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের পাশে, কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের কাছে। কখনো শ্রম দিয়ে, কখনো নিজের সব সামর্থ্য দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অসহায় মানুষের।
মানবতার সেবায় নেসার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও করেছেন। নাম ‘শুনতে কি পাও’। রানা প্লাজা যেদিন ধসে পড়ে তখন দ্রুত এর সদস্যদের আলোচনা করে ৫০ জনের টিম নিয়ে পর দিনই ছুটে আসেন রানা প্লাজায়। নিজেরা ফান্ড করে জোগাড় করেন ২৫ হাজার টাকা।
ভবন ধসের উদ্ধার কাজের দু’তিনদিনের মধ্যে সংগঠনের কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি চলে গেলেও যাননি নেসার। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করেছেন। সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যও তখন নেসারের সাহসিকতার প্রশংসা করেন। দেশি-বিদেশি মিডিয়ারও নজর কাড়েন নেসার।
বঞ্চিত মানুষদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন এ যুবক। প্রতি সপ্তাহে ফেনীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরেন তিনি। দেখেন কেউ চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন কি-না! হাসপাতালে ঘুরে প্রথমে নেসার দেখেন এমন কোনো রোগী আছেন কি-না যার কেউ নেই। অসহায় এমন রোগী দেখলেই তার সহায় হন তিনি। কখনো শারিরীকভাবে, কখনো আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। নিজের কাছে অর্থ না থাকলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বা সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা তুলে এসব মানুষদের পাশে দাঁড়ান তিনি।
টাকা চাইলে কেউ উপহাস করেন, কেউবা তাড়িয়ে দেন। তবে দমে যান না নেসার!
এভাবে কেনই বা নেসার অসহায় মানুষের পাশে ছুটে চলেন? জানতে চাইলে নেসার বাংলানিউজকে বলেন এর পেছনের গল্প।
নেসার বলেন, ২০০৭ সালে আমার বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মারা যান। আমার বাবার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। আমরা তিন ভাই এক বোন। ভাইয়েরা কাছাকাছি বয়সী। বড় ভাই ওষুধের দোকানে এবং মেঝ ভাই গার্মেন্টসে সামান্য বেতনে চাকরি করতো। আর আমি ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ১ম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। তাই পরিবারের জন্য কিছুই করার ছিল না। ভাইদের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হতো বাবার জন্য।
তিনি বলেন, সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকত। পরিবারকে সহায়তা না করতে পারায় চোখের জলই ছিল আমার সান্ত্বনা। বাবা আমাকে ছোট ছেলে হিসেবে অনেক বেশি ভালবাসতেন। কিন্তু বাবার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি, পারিনি উন্নত চিকিৎসা করাতে।
পরিবারের দুঃসময়ে আমার চাচাতো ভাই ইব্রাহিম খলিল ছাড়া কেউই পাশে দাঁড়ায়নি।
নেসার বলেন, ছোটকাল থেকেই পথ শিশুদের অসহায়ত্বের প্রতি আমি খুব দুর্বল ছিলাম। রেলস্টেশন থেকে ছিন্নমূল ছেলেদের আমার বাসায় এনে গোসল করাতাম, খাওয়াতাম আবার আগের জায়গায় রেখে আসতাম। যখন ২০০৬ সালে ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই, তখন ফেনী সদর হাসপাতালে গরীব, অসহায় রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করে দিতাম।
তিনি বলেন, ঠিকানাহীন অজ্ঞাত রোগীদের সহায়তা করতাম কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদন জানাই, যেন আমার বাবার মতো চিকিৎসার অভাবে যাতে কারও মৃত্যু না হয়, অন্তত আমার চোখের সামনে।
অনেক অজ্ঞাত রোগীর প্রতিই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন নেসার। এর মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষও ছিল। যার গায়ে দুর্গন্ধ, গন্ধের কারণে হাসপাতালের নার্সরা তাদের চিকিৎসা দিতে পারতেন না।
কখনো নিজ উদ্যোগে, কখনো বন্ধুদের সহায়তায় অসংখ্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন এই যুবক।
এমন অনেক আনন্দমিশ্রিত কষ্টের অনুভূতি বাংলানিউজকে জানালেন অদম্য সাহসী, মানবতার সেবক যুবক নেসার।
এমনই এক অভিজ্ঞতার নিয়ে বলেন, মলম পার্টি আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসার সহায়তা করেছি। হাসপাতালে নেওযার পর কখন জ্ঞান ফেরে এই অপেক্ষায় হাসপাতালের বারান্দায় রাতযাপন করেছি। বাড়ি থেকে কলেজে আসা এবং নাস্তা খরচ কোনো সময় ৫০ টাকা, কোনো সময় ১০০ টাকা পেতাম।
এ থেকে বাঁচিয়ে প্রায় সময়ই অজ্ঞাত রোগীর জন্য আমার সামর্থ্য অনুযায়ী ওষুধ, খাবার কিনে পকেট খালি হয়ে যেত। কিন্তু কখনো আমি কাউকে বুঝতে দিইনি। কারণ রোগীকে সেবা দেওয়াই ছিল আমার আত্মতৃপ্তি।
নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলে নেসার বলেন, আমি ২০১১ সালে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করি। কিন্তু দু’তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেছিলাম। কিন্তু যা আয় করতাম তা অসহায় মানুষের জন্য খরচ করে ফেলতাম। পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ দেড় বছর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলাম। কারণ তারা আমাকে ফোন করে বকা দিত। আর ভাইয়েরা বলতেন সংসারে টাকা দিতে।
তিনি বলেন, কিন্তু আমার মাকে আমার লক্ষ্য ও উদ্যোগের কথা একটা সময় খুলে বলি। মাকে স্মরণ করিয়ে দিই ওষুধের অভাবে বাবার মৃত্যুর কথা। একদিন আমার মা আমার মাথায় হাত রেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর শুধু একটাই কথা বলেন, নেসার তুই এই কাজটা করবি। প্রয়োজনে আমি আরও অভাব করবো।
সবশেষে নেসার জানালেন, মায়ের এই প্রেরণাই তার এপথে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য সাহস, শক্তি। নেসার সবার সঙ্গে রয়েছেন ‘শুনতে কি পাও’ এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৩
এডিএ/এএ/আরআইএস