ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নান্টু মিয়ার হাতে কোরবানের গরু!

মাজেদুল নয়ন; স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩২, অক্টোবর ১৫, ২০১৩
নান্টু মিয়ার হাতে কোরবানের গরু!

ঢাকা: হাফ প্যান্টের হুক না থাকায় সেটি কলা গাছের আঁশ দিয়ে শক্ত করে বাঁধে ৬ বছরের নান্টু মিয়া। এই হুকজনিত সমস্যার কারণে অনেকবার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সে।

গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দল বেঁধে গরু দেখে বেড়াচ্ছে তারা।  

নান্টুদের বাড়িতেই কয়েকজন গৃহস্থের গরু আছে। প্রতিদিনই দেখতে পায় ওগুলোকে। গ্রামে গরু বিশেষ আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে কোরবানীর ঈদের ক্ষেত্রে গরুর মাজেজা ভিন্ন, একে ঘিরেই চলে শিশুদের হৈ-হুল্লোড়।
বন্ধু রাফিদের ঘরের সামনের উঠানে একটা লাল বড় গরু বাঁধা। রাফি দাবি করছে তাদের গরুটা খুব তেজী। সকালে কয়েকজন মিলেও এ গরুটাকে আনতে পারছিল না। তবে তার এক সাহসী আর শক্তিমান কাকার সঙ্গে পেরে উঠেনি গরুটা।

নান্টুর আরেক বন্ধু সোহাগ এ কথার সঙ্গে একমত হতে পারে না। সে বলে তাদের গরুটা আরো বেশি তেজী। গায়ের রং কালো। সোহাগের দাবি অনুযায়ী তাদের গরুর শিং এর গুতো খেলেই রাফিদেরটা পালিয়ে কুল পাবে না। এ নিয়ে চলে বাকবিতণ্ডা।

কম যায় না নান্টুও। বলে, তার বাবা ঢাকায় আরো বড় গরু কিনেছে। সেটি আরো তেজী, অনেক বড়। আর মহিষের মতো শিং। যেন কল্পনায় ওই গরুটি চোখে ভাসে তার। এ বিশাল গরুর কল্পনা নান্টুকে দিয়েছে তার মা।

নান্টুর বাবা শহরের স্বল্প আয়ের কর্মজীবি, তার পক্ষে সম্ভব হয় না কোরবানীর পশুতে ভাগ থাকার মতো অর্থের যোগান দেয়া। গত কয়েক বছর ধরে কোরবানীর ঈদে বাড়িতেও আসেন না তিনি। বাবার এই  আর্থিক অপারাগতা বুঝতে দিতে চায় না মা। তিনি সন্তানদের বলেন, ‘তোদের বাবা ঢাকায় গরু কিনেছে। বিরাট লাল রং আর বড় শিংয়ের সে গরু। ওতো বড় গরু ঢাকা থেকে বাড়ি আনবে কি করে?’ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না, নান্টু বা তার অন্য ৩ ভাই বোনও।

গ্রামে বেশ আগেই গরু কেনে গৃহস্থরা। নান্টুর জ্যাঠা সালাম মিয়াও গরু কিনেছেন ঈদের প্রায় দশদিন আগে। এই দশদিন ধরে নাওয়া খাওয়া বন্ধ নান্টু এবং তার সমবয়সীদের। নান্টুর এখন কাজ সারাদিন এ গরুর যত্ন নেওয়া। মাঝে মধ্যে খড় খাওয়ানো। কোরবানীর পশুটির ক্ষুধা না লাগলেও মুখের সামনে ঘাস বা খড় এগিয়ে দেওয়া। তাদের মার্বেল খেলা, লাটিম খেলা বা ডাংগুলি খেলাও এখন এ গরুর আশপাশের কয়েক গজের মধ্যে।

ঈদের আগের বিকেলে গরুর পাশেই চলছে মার্বেল খেলা। মার্বেল গর্তে পড়া নিয়ে ঝগড়া বেধে যায় তার ১ বছরের বড় জ্যাঠাতো বোন সোনিয়ার সঙ্গে। হাতাহাতির পর্যায়ে পৌছালে জয় লাভ করে নান্টু মিয়া। সোনিয়ার দুটি মার্বেল নিয়ে ঘরে ফিরে সে।

কিন্তু এ জয়ই কাল হলো নান্টুর। সন্ধ্যা নামলে সে আবার যায় গরুর যত্ন নিতে। এবার এক হাত দেখে নেয় সোনিয়া। নান্টুকে হুশিয়ার করে বলে, তাদের গরুর গায়ে যেন হাত না দেয়। নান্টুও প্রতিউত্তরে বলে ঢাকায় তাদের আরো বড় গরু আছে। তবে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে সে। দুটি মার্বেল এর জন্যে গত আটদিনের ভালবাসা বিসর্জন দিতে হচ্ছে তাকে। বাবার কেনা গরুতো আর সে ছুঁতে পারেনি কোনদিন। তার মাংসও দেখেনি সে। শুধু মায়ের কাছেই শুনেছে।

ঘরে ফিরে মাকে আবারো প্রশ্ন করে তাদের গরু  কেন ঢাকায় কেনা হয়? জবাব দেয়না নান্টুর মা। এবার নান্টু মাটিতে আছড়ে পড়ে কান্না শুরু করে, তাকে গরু কিনে দেয়ার জন্যে। শেষ পর্যন্ত মায়ের হাতে এক প্যাকেজ উত্তম মধ্যম খেয়ে দীর্ঘ সময় গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে কান্না থামে তার।

গামছা দিয়ে নান্টুর শরীর থেকে বালু ঝাড়তে ঝাড়তে মা শাসিয়ে দেয় আর সোনিয়াদের গরুর কাছে না যেতে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ঘরের দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে সোনিয়াদের গরুটার দিকে তাকিয়ে থাকে নান্টু মিয়া। তার মনে হচ্ছে গরুর চোখের কোনে কান্নার জল। রাত পেরোলেই জবাই করা হবে পশুটাকে। বড়দের কাছে শুনেছে এ জন্যে আগের রাতে কান্না করে কোরবানীর পশুরা।

আবারো কান্না আসে নান্টুর। মাটিতে আছড়ে পড়তে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু মায়ের মারের ভয় এবার আর সাহস যোগায় না। তার মনে হয় অভুক্ত হয়ে আছে গরুটা। গরুর লোমশ পিঠে হাত বুলাতে ইচ্ছে করে তার।

ঢাকায় নান্টু
নাখালপাড়ায় ৪র্থ তলার ভাড়া বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে নান্টু মিয়া। ১২ নাম্বার গলির বেশ কয়েকটি গ্যারেজে বা গেটের বাইরের পিলারে বাঁধা রয়েছে কোরবানীর পশু।

একটি বাড়ির গ্যারেজে অনুর্দ্ধ ১০ বয়সী এক শিশু চেয়ারে বসে রয়েছে গরুর সামনে। কিনে আনা খড় মুখে গুজে দিতে চাচ্ছে গরুর। হয়তো প্রতি বছর এই একবারই প্রাণীটিকে এতো কাছ থেকে দেখে সে। শহুরে শিশুদের দল নেই। তাই সে জানে না গরুর শরীরের রং, শিং বা তেজদীপ্ততা নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করা যায়।

এখানকার বাবা-মায়েরাই শিশুর বন্ধু হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর শিশুটির বাবা আসেন। ছেলের সঙ্গে গরু নিয়ে খুনসুটি করেন এরপর তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় নোংরা আবর্জনার অজুহাত দেখিয়ে।

শহরের বাসিন্দারা কোরবানীর গরু কিনে ঈদের এক বা দুদিন আগে। শিশুরা এ দুদিনেই আপন করে নেয় অবলা পশুটিকে।

বেসরকারি চাকুরিজীবি নান্টুর পক্ষে এবার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে গত কয়েক বছর ধরেই আর কোরবানের পশু কেনার প্রশ্নে চুপ থাকতে হয় না নান্টুর মাকে। তাদের বাড়ির উঠানে ঈদের এক সপ্তাহ আগেই বাধাঁ পড়ে কোরবানীর পশু। মাকে আর বলতে হয় না, ঢাকায় দেয়া হচ্ছে কোরবানী।

রাস্তায় চোখ ফেরায় নান্টু। নীল রংয়ের গেটের সামনে আরেকটি গরু নিয়ে মেতে আছে ছোট দুই ভাই বোন। বোনটি একটু পর পর সাহস করে গরুর মাথায় হাত বুলাতে যায়। নান্টুরও ইচ্ছে করে অবলা প্রাণীটির মাথায় হাত বুলিয়ে আসতে।

বাড়ির উঠোনে গরু
বাড়ির উঠোনে বাশেঁর খুটিতে বেশ বড় লাল রংয়ের গরু বাঁধা। তার একটু দূরেই কাঠের চেয়ারে বসে আছেন সত্তোরোর্দ্ধ নান্টু মিয়া। শিশুরা হৈ-হুল্লোড় করছে গরু ঘিরে। বেশ উপভোগ করছেন তিনি। গরুর শিং, লেজ, আর নড়াচড়া দেখেন তিনি। এ গরুটা বেশ শান্ত।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হঠাৎ করেই দৃষ্টি আটকে যায় নান্টুর, গরুর চোখের কোনে পানি জমেছে। চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে আসেন তিনি। অবলা প্রাণীটির লোমশ পিঠে গভীর মমতায় হাত বুলাতে থাকেন নান্টু মিয়া।

বাংলাদেশ সময় ১৪২০ ঘন্টা; অক্টোবর ১৫, ২০১৩
এমএন/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।