ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অবাকনাম ভিয়েতনাম, দরকার নতুন নাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৫৬, অক্টোবর ১৭, ২০১৩
অবাকনাম ভিয়েতনাম, দরকার নতুন নাম

pronob-sahaদই আমাদের অনেকের প্রিয় খাবার আর মই দিয়ে জমি চাষ করে কৃষক ফসল ফলায়। তবে গাছে তুলে মই সরিয়ে কাউকে বিপদে ফেলানো কারো কাম্য নয়।

কিন্তু হো চি মিনের দেশে দই-মই মানে খাবার কিছু নয় বরং ৯ কোটি ভিয়েতনামির জন্য জীবনমান উন্নয়নের জন্য দই-মই এক অব্যর্থ অর্থনৈতিক ফর্মুলা। ভিয়েতনামি ভাষায়  দই-এর অর্থ পরিবর্তন আর মই-এর অর্থ নবায়ন।

 

সমাজতান্ত্রিক দেশে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির শৃংঙ্খল কিছুটা আলগা করতেই এই দই-মই নীতি চালু হয় ১৯৮৬ সালে। তারই ফল আজকের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। চকচকে হো-চি মিন সিটিতে আমাদের গাইড কেলভিন যখন বাঙ্গালিরি মুখে শুনলো দই-মই এর উচ্চারণ, তখন তার মুখেও দেখলাম হাসির ঝিলিক।

 

এক সময়ের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের দেশ ভিয়েতনামে এখন পূঁজিবাদের হাল্কা ঝলক। আর বিদেশি কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ সুখের ছোয়া দিচ্ছে ভিয়েতনামিদের যারা হাজার বছর যুদ্ধ করেছে চীনের বিরুদ্ধে, শত বছর সংগ্রাম করেছে ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে আর একটানা এক দশক যুদ্ধ করেছে বিশ্বের সশস্ত্র মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

Pronob-bgমাত্র পাচঁ রাত ছয় দিন ভিয়েতনামের দুই শহরে কাটিয়ে মনে হয়েছে উন্নতির গতি পেয়েছে সংগ্রামী ভিয়েতনামিরা। হো চি মিন সিটি আর রাজধানী হ্যানয় জুড়ে যে মোটর বাইকের দাপট তা যে অচিরেই প্রাইভেট কার আর বিলাসবহুল জিপের শহরে পরিণত হবে পরিশ্রমী ভিয়েতনামিদের দেখলেই তা বোঝা যায়।

 

সাবেক সায়গন আর এখনকার হো চি মিন সিটির টুরিস্ট গাইড কেলভিনকে দেখেছি একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও কিভাবে পরিশ্রম করেছে বিদেশি টুরিস্টদেরকে খুশী রাখার জন্য।  

 

আমাদের সফরসঙ্গীরা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক পড়ে রুম ছেড়ে হোটেল লবিতে এসেছে। সায়গন থেকে ২০০ কিলোমিটার দুরে গিয়ে আব্দার ধরেছে ট্যাক্সি জোগাড় করে দাও এখনি শহরে ফিরে যাবো। ঠোটের কোনায় এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে রেখে তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে কেলভিন, কারণ আমাদের গস্খুপটি তার কাছে দ্বিতীয় বাংলাদেশি পর্যটক দল। এর আগে একটি বাংলাদেশি পরিবারকে গাইড করে সে ভিয়েতনামের প্রধান বাণিজ্যিক শহর হো চি মিন সিটি ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।  

Pronob-2এক সময়ের দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন। সায়গন নদীর তীরের এই শহরটি দেশের প্রধান বাণিজ্য নগরী। আর উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হওয়ার পর এই আধূনিক নগরীর নামকরণ করা হয়েছে ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিনের নামে। যাকে সবাই ডাকে ” আঙ্কেল হো ” নামে।

 

কেন জাতির জনক নয় ? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজধানী হ্যানয়ের টুরিস্ট গাইড হো চি মিনের সমাধির সামনে দাঁড়িয়েই জানিয়েছিল ভিয়েতনাম জাতি হাজার বছরের পুরোনো তাই ১৯৩০ সালে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তো আর জাতির জন্ম দিতে পারে না। কিন্তু ভিয়েতনাম যখন পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাধীন করেছেন হো চি মিন, যার আসল নাম নগুয়ান আই কুয়ক, তাকে তাই ভালোবেসে ভিয়েতনামিরা ডাকে আঙ্কেল হো বলে।

 

আর পরে উল্টর ভিয়েতনাম যখন ফিরে পেলো দক্ষিণ ভিয়েতনামকে তখন সেই দক্ষিণের সায়গনের নাম তারা নতুন করে রাখলো হো চি মিন সিটি। এই শহরের অনেক কিছুই আমেরিকানরা তৈরি করেছিল যখন তারা এখানকার শাসকদের কাধে ভর করে যুদ্ধ করেছে ভিয়েতনামি গেরিলাদের সঙ্গে। যাদের নাম চভিয়েতকং চ।

 

সেই যোদ্ধাদের সঙ্গে মার্কিন সেনাবাহিনীর যুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতেই শহরেই আছে ” এক্সিবিশন হাউস ফর ক্রাইম অব ওয়ার অ্যান্ড এগ্রিশন ”। এই মিউজিয়ামটিতে আছে মাকির্ন সেনাদেন ব্যবহার করা নানা আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, এমনকি যুদ্ধবিমান এবং ট্যাংক ও হেলিকপ্টারও।

 

হায় সেই মিউজিয়ামের বারান্দায় বসে ইলেকট্রিক গিটার বাজাচ্ছিল একটি জন্মান্ধ কিশোর আর শারীরিক প্রতিবন্ধী দুইজন বিশেষ ধরনের চেয়ারে বসে বানাচ্ছিল হস্তশিল্প সামগ্রী।

pronob-1আমেরিকানরা যুদ্ধের সময় যে বিষাক্ত গোলা বারুদ ব্যবহার করেছিল, আর দূষিত করেছিল নদীর পানিকে তারই ফলে এখনো বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয় সংগ্রামী মাটিতে। তারাই এই মিউজিয়াম পরিদশর্নে আসা শত শত মার্কিন টুরিস্টদেরকে জানিয়ে দেয় তাদের পূর্ব পুরুষরা কি ঘটিয়েছিল শস্য-শ্যামলা ভিয়েতনামে। হাজার হাজার হেক্টরও কৃষি জমিকে বোমা মেরে পুড়িয়ে দিয়েছিল মার্কিন মেরিন সেনারা।

কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত সেই ভিয়েতনাম এখন বিশ্বে চাল রপ্তানীতে তৃতীয় স্থান দখল করে আছে। যদিও ভাত নয় মেকং ডেল্টার পাড়ে আমাদের অবাক করে ভিয়েতনামি তরুণী পউল সবার হাতে তুলে দিয়েছিল রাইস পেপারে মোড়ানো এক অপূর্ব স্বাদের রোল, যার ভেতরে ছিল নুডলস,মাছ আর চিকেন এবং গাজর-পেঁপের কুচি।

 

জিভে জল আনা সসে ভিজিয়ে সেই রোল খাওয়া আর টেবিলের ওপর সুদৃশ্যভাবে বসানো ভাজা মাছ খেতে খেতে বন্ধু ওবায়দুল কবীর আর জায়েদুল আহসান পিন্টু যেন উটতেই চাইছিল না। ভাজা মাছটির নাম শুনে তো আমরা আরো বেশী উচ্ছসিত। এর নাম এলিফেন্ট এয়ার বাংলা করলে দাঁড়ায় হাতির কান।

 

ঢাকায় আমার নাতি এটিএন নিউজের মাস্টার কন্ট্রোল রুমের (এমসিআর) অধিপতি নাসের আহমেদের কাছ থেকে পাওয়া নতুন স্যামসাং গ্যালাক্সি এইচ এন্ড্রয়েড ফোনে তাড়াতাড়ি সেই মাছের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতেই হলো।
 

বিশ্বের বৃহৎ নদীগুলোর তালিকায় মেকং নদীর অবস্থান তেরতম। তিব্বতে এর উৎপত্তি যা ছুয়ে গেছে ছয়টি দেশকে। বার্মা, চীন, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম হয়ে মেকং পড়েছে সাউথ চায়না মহাসাগরে। সেই মেকং ডেল্টা ছিল আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য।

 

মেকংয়ের পাড়ের গ্রামে সেই রাজকীয় মধ্যন্থ ভোজের সব খাবার আমাদের কাছে অমৃতের মত লেগেছে। তার আগে অবশ্য আরো দুটি গ্রামে গিয়েছিলাম। যার একটিতে কোকোনাট ক্যান্ডি মানে নারকেলের তৈরি লজেন্স থেকে শুরু করে সাবান এমনকি নারকেলের দুধের তৈরি ওয়াইনও দেখানো হলো আমাদেরকে। মধু দিয়ে মিষ্টি করা চা খেয়ে সফরসঙ্গী আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় আইনের খোঁজ না নিয়ে নেচে ফেললেন দুই গায়িকার সঙ্গে। pronob-3

ওবায়েদুল কবীর ক্যামেরা নিয়ে রেডি তাই সুন্দরীদের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ কেউ ছাড়লো না। এমনকি চির সবুজ হাসান শাহরিয়ারও।

 

এন টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার মুকুল অবশ্য ছবি তোলার পাশাপাশি ঢাকার নিপা ভাবীর জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক কিনতেও ভুললেন না। এই দুই গ্রামের ভিতর দিয়ে ছোটো খাল দিয়ে যাওয়ার সময় ছোটো আকারের অন্যরকম নারকেলে দেখেছি, আর সবাই কমবেশী কিনেছি কোকোনাট ক্যান্ডি আর নারকেলের মালাই থেকে তৈরি চামুচ। এই গ্রামে ঘোড়ার গাড়ির ভিয়েতনামিও টমটম ভ্রমণ সত্যিকার অর্থেই আমাদেরকে পরিণত করেছিল ফরেন টুরিস্ট-এ।
 

ভিয়েতনামিদের সঙ্গে আমেরিকানদের এক দশকের যুদ্ধের স্মৃতির কথা বলতে বলতে চলে এসেছিলাম মেকং ডেল্টায়। আসলে এখন ভিয়েতনামে নতুন করে ট্যুরিজমের দিকে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। হো চি মিন শহরের যুদ্ধস্মৃতির জাদুঘর যেমন তেমনি মার্কিন গেরিলাদের সংগে যুদ্ধ করার জন্য আড়াইশ কিলোমিটার দীর্ঘ কো চি টানেলকেও পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে ভিয়েতনাম সরকার। আবার প্রকৃতির উপহার হ্যানয়ের অদুরে যে হা লং বে । তাও এখন পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চয়ের্র একটি।

 

হ্যানয় নেমে সেখানেও ছুটছে হাজার হাজার পর্যটক। ভরা পূর্নিমায় সবুজ জলরাশির ওপরে ভেসে থাকায় নৌকায় রাত কাটানোর সুযোগ হয়নি। তবে এক সময় ঢাকায় থাকা ভারতীয় কোম্পানি টাটার প্রতিনিধি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের আতিথেয়তায় হ্যানয়ের নাইট লাইফ সফরসঙ্গী সবাইকে এতটাই মোহিত করেছে যে সবাই পণ করেছে আবার যাবেন ভিয়েতনাম।

 

জায়েদুল আহসান পিন্টু ক্যসিনো খেলে জিতেছে কি হেরেছে তার সাক্ষী দিবেন আশরাফ ভাই আর বাবলু ভাই। তবে ভূয়া ব্যাচেলর পিন্টুর ঘোষনা এরপর ঢাকা থেকে ব্যাংকক সুবর্নভূমি বিমানবন্দরের রানওয়ে ছুয়ে চলে যাবো সরাসরি হ্যানয়। বিমানবন্দর থেকে ডাইরেক্ট হোটেল ফরচুনার বেসমেন্টে। আমাদেরও জানা আছে বেসমেন্টের সব নম্বর প্লেট । পাঠক তা জানতে হলে খুজতে হবে এই লেখার পরবর্তী কিস্তি। দাবার চালে কিস্তি মাত করা নয়,  ভিয়েতনামি সুন্দরীদের ভালোবাসার কথা জানা যাবে তখনই...।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৩
এডিএ/এনএস/এডিবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।