ঢাকা: হা লং বে বাংলাদেশে পরিচিতি পায় মাত্র বছর কয়েক আগে। প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায় স্থান পেতে আমরা যখন সুন্দরবন এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিলাম তখন সেই প্রতিযোগিতায় নাম আসে ভিয়েতনামের হা লং বে-এর।
একে তো ভিয়েতনাম, তার ওপর হা লং বে। এনটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার মুকুল মিডিয়া ক্লাবের বৈঠকে, তাই যখন প্রস্তাব করলেন ভিয়েতনাম ভ্রমণের, তখন কেন জানি না অন্যরা এক কথায় সায় দিলেন।
ভিয়েতনাম সফরের ভিসা যোগাড় করা থেকে শুরু করে সবার এয়ার টিকিট কেনা এবং ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে পুরো প্যাকেজ তৈরিতে বন্ধু ওবায়দুল কবীর অনেক পরিশ্রম করেছেন। এই পরিশ্রমের অনেকটাই তার লাঘব হয়েছিল হা লং বে গিয়ে।
ভিয়েতনামে পাঁচদিনের সফরে আমরা মাত্র দুই রাত ছিলাম রাজধানী হ্যানয়তে। এর মধ্যে একটি দিনের পুরোটাই চলে যায় হা লং বে তে যাতায়াতে। তবে হা লং বের সবুজ জলের প্রকৃতি আমাদের সব ক্লান্তি মুছে দিয়েছিল। কারণ, ভিয়েতনাম ছাড়ার আগের দিনটিই আমরা কাটিয়েছিলাম সাগরের জলে। আগের রাতে জমজমাট নাইট লাইফ। তরলে গলা ভেজানো, ক্যাসিনোতে কম্পিউটারে ডিজিটাল জুয়া খেলা আর সঙ্গে ভিয়েতনামি সুন্দরীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে নৃত্য।

আনন্দিত রজনী সফর সঙ্গীদের অনেকের ঘুম গাঢ় করে দিয়েছিল। সকালে সঠিক সময় ঘুম থেকে উঠতে তাই অনেকেরই কষ্ট হয়েছিল। ফলে, সকাল থেকে মুখ গোমরা করে ফরচুন হোটেলের লবিতে পায়চারী করছিল গাইড হাঙ। নিজেই সে বলেছে, তার নামের অর্থ- সমৃদ্ধি, মানে ধনী হওয়া।
নির্ধারিত সময়েই হোটেল লবিতে পাঁচজন এসে পৌঁছালেও বাকি তিনজন রুম থেকেই নামছিলেন না। বিরক্ত হয়ে গাইড হা লং বে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল করারও হুমকি দিয়ে বসলো। কিন্তু আমরা তো কাউকে ফেলে যেতে পারি না। তাই, কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে হা লং বে-র উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলেও বিপুল জলরাশি আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল অনাবিল আনন্দের মুগ্ধতায়।
হা লং উপসাগর উদ্দেশে আমাদের গাড়ি চলতে শুরুর পরই অনেকটা বাংলাদেশের মতোই ভিয়েতনামের গ্রামীণ দৃশ্য আমাদের মনকেও সবুজ করে দিয়েছিল অল্পসময়ের মধ্যেই।
বাস ছুটে চলছে হাইওয়ে দিয়ে। হ্যানয় থেকে একশ ৭০ কিলোমিটার পথ যেতে হবে। চার ঘণ্টা সময় লাগবে। মহাসড়কের দুপাশে গ্রাম। আবার আছে ছোট শহরও। সঙ্গে চলছে ভিয়েতনামের ঐতিহ্য মোটরবাইক। এবার হাইওয়েতে কিছু বাইসাইকেল চোখে পড়লো। সাইকেলে চড়ে ঝাঁক বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা।
মোটরবাইকগুলো যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি মাল পরিবহন করছে। গাইড হাঙ জানালো, ভিয়েতনামবাসী ফল খেতে খুব ভালোবাসে। আর যারা শহরে মারা যান, তাদের অনেকেই চান, গ্রামে যেন তাদের সমাহিত করা হয়। তাতে করে নিজেদের স্বজনদের কাছেই থাকতে পারবেন তারা। আমরা দেখি, সত্যিই দুটি জমির সীমানায় গ্রামের ভাষায় যাকে আমরা ক্ষেতের আইল বলি, সেই আইলেই বেশির ভাগ পাকা কবর।
কিছুদূর যেতেই ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি আর এই মেঘ তো এই রোদ। এর মধ্যেই আমাদের নিয়ে ট্যুরিস্ট কোচ এগিয়ে চলেছে কাঙ্ক্ষিত হা লং বের দিকে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটি দেখার জন্য আমাদের আগ্রহের পারদ যখন সর্বোচ্চ মাত্রা ছুঁয়েছে, তখন গাইড হ্যাং ঘোষণা দিলো, আর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো হা লং বের তীরে।

চওড়া নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। তাই, কিছুটা ভাঙাচোরা পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। বৃষ্টির কারণে অবস্থা আরো খারাপ। সেখান থেকে তাকাতেই চোখে পড়লো উপসাগরের অপার সৌন্দর্য। পানির ওপর ভেসে থাকা ছোট-বড় সবুজ দ্বীপগুলোর হাতছানি!
সুন্দর করে বাঁধানো ঘাট। ঝকঝকে কাচের দেওয়ালে তৈরি রিসেপশন। গাইড টিকিট কিনলো। আমাদের জন্য অপেক্ষা করা দোতলা বোট। এ রকম আরো কয়েকশ বোট সার বেঁধে অপেক্ষা করছে ট্যুরিস্টদের জন্য। বোটে ওঠা থেকেই ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলছিল ওবায়দুল কবীর।
জনকণ্ঠের চিফ রিপোর্টার কিন্তু ছবি তুলছিল প্রফেশনার টিভি ক্যামেরা ক্রুর মতোই। আমি তুলতে গিয়ে দু/একবার ধমকও খেতে হলো। কারণ, ওর মন মতো হচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোট চলতে শুরু করলো হা লং উপসাগরের বুক চিরে।
উত্তর ভিয়েতনামের উত্তর-পূর্ব কোণে চীন মহাসাগরের উপসাগর হা লং বে; যার আয়তন এক হাজার পাঁচশ ৫৩ বর্গকিলোমিটার। নানা আকারের প্রায় দুই হাজার পাথরের দ্বীপের আকার তিনশ ৩৪ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপের সংখ্যা ছোট-বড় সাতশ ৭৫টি।
উপকথা বলছে, বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে ভিয়েতনামকে রক্ষা করার জন্য দেবতারা ড্রাগনদের পাঠিয়েছিল এই উপসাগরে। বাইরের শত্রুদের নৌযানগুলোকে প্রতিহত করার জন্য ড্রাগনরা মুখ থেকে যে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করেছিল, সেগুলোই প্রস্তর খণ্ড হয়ে পরিণত হয় ছোট দ্বীপে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, প্রায় পাঁচ কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে পাথরের দ্বীপগুলো।
দ্বীপগুলোর বুক চিরে জন্ম নিয়েছে সবুজ শ্যামলিমা। আর এই সবুজের প্রতিচ্ছায়া সাগরের নীল জলকে রাঙিয়েছে সবুজ আভায়। তাই, আমি বলি নীল নয়, হা লং বে হলো সবুজ জলরাশির বিশাল আধার। অংসখ্য সবুজ দ্বীপে নাকি এখন তৈরি হয়েছে ভ্রমণ পিয়াসুদের মনোরঞ্জনের আধুনিক সুবিধার বেশ কয়েকটি রিসোর্টও। নৌযান যখন ঘুরে বেড়ায় উপসাগরের বুক চিরে, তখন এসব সবুজ দ্বীপ জুম ইন আর আর জুম আউটের মতো ক্রমশ ছোট হতে হতে মিশে যায় দিগন্ত রেখার সঙ্গে। আবার সামনে চলে আসে বিশাল আকার নিয়ে।

হাজার বছর ধরেই এই সাগরের বুকে জেগে থেকে দ্বীপগুলো সৌন্দর্য বিতরণ করেছে নিজেদেও মতো করেই। কিন্তু, ইতিহাস বলছে পাঁচশ বছর আগে ‘নিয়ন ট্রাই’ নামে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নেতা এবং কবি দ্বীপগুলো কিনেছিলেন উপসাগরের সৌন্দর্য রক্ষার লক্ষ্যে।
তিনি তার লেখা অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধে হা লং বের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। তখন থেকেই এটি পর্যটকদের প্রিয় স্থান হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে উত্তর ভিয়েতনাম সরকার এই এলাকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং এর সৌন্দর্য কথা প্রচারের উদ্যোগ নেয় ।
তথ্য খুঁজে জানা গেল, ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো হা লং উপসাগরকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ২০১২ সালে সপ্তমাশ্চর্য ফাউন্ডেশন এটিকে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। হা লং বে বাংলাদেশের সুন্দরবন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকায় তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমে ছিল কক্সবাজার এবং সুন্দরবন। পরে সপ্তমাশ্চর্যের প্রতিযোগিতায় অনেক দূর এগিয়েছিল সুন্দরবন। শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের স্থান না হলেও সপ্তমাশ্চর্যে স্থান করে নেয় হা লং বে।
আমারা প্রায় চার ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালেও, ভরা পূর্ণিমায় রাত কাটানো নাকি আরো বেশি আকর্ষণীয়। সেই সুযোগ আর হলো না। কারণ, পরের দিন সকালেই আমাদের ভিয়েতনাম ছাড়ার ফ্লাইট নির্ধারিত ছিল আগে থেকেই। ভালো হতো প্রথম দিন দুপুরে হ্যানয় নামার পরেই যদি আমরা হা লং বে গিয়ে বোটে রাত কাটাতে পারতাম!
এবার সে সুযোগ না থাকায় বন্ধু জায়েদুল আহসান পিন্টু তো ঘোষণাই দিলো আবার আসবে সে। আমি নিশ্চিত, এই আগ্রহের বেশিটাই ফরচুনার ডিজিটাল ক্যাসিনো আর ফরচুনার বেসমেন্টের এক্সটিক নাইট বার। সফর সঙ্গী বাবলু ভাই যখন বোটের ডেকে শুয়ে ছবির পোজ দিচ্ছিলেন, তখন তারও সায় ছিল পিন্টুর প্রতি। চিরকুমার হাসান শাহরিয়ারের অবশ্য আগ্রহ সব কিছুতেই। আর ইয়াং আশরাফ ভাই তো টি-শার্টে দারুণ রঙিন সবসময়ই। সবাই মিলে দারুণ রাঙানো ছিল হা লং বের নৌ ভ্রমণটি।
সাগরের পানিতে ছোট ছোট জেলে নৌকা। ভিয়েতনামি জেলেরা সাগর থেকে চিংড়ি আর কাঁকড়া ধরে বিক্রি করছে নৌযানের যাত্রীদের কাছে। জীবন্ত মাছ আর কাঁকড়ার সুস্বাদু রান্না করেছিল ভিয়েতনামি বাবুর্চি। তরুণী হি লা মাছ সুন্দর করে পরিবেশন করছিল জাহাজের টেবিলে। বাবাবা আর হ্যানয় বিয়ারের চুমুকের সঙ্গে সেদ্ধ করা টাটকা কাঁকড়ার স্বাদ এখনে জিভেতে লেগে আছে। খাবার শেষ, শেষ নৌভ্রমণও।
এবার তরুণী হি লা খুলে বসলো তার হ্যান্ডিক্রাফটের দোকান। হা লং বের তল থেকে তোলা স্টোন আর মুক্তার গহনার সঙ্গে আছে সেই সাইকেলে চড়া তরুণীদের ছবির সূচিকর্ম।
ফেসবুকে হা লং বে থেকেই অনেক ছবি আপলোড করেছিলাম। সারা বিশ্বের বন্ধু এবং অতি অবশ্যই বান্ধবীদের উদ্দেশে। তাদের লাইক আর কমেন্টে ফেসবুক যখন ভরপুর, তখন মুকুল ভাইয়ের ফোনে কথা হয় নীপা ভাবির সঙ্গে। উপহার না পেলে বান্ধবীদের কাছে ভিয়েতনাম ভ্রমণের গোপন সব তথ্য ফাঁস করার হুমকি। অতঃপর তাই ভাবির মুখ বন্ধ করতে সবুজ জলরাশির গভীর থেকে তুলে আনা বোটলগ্রীন স্টোনের মালা কেনা হলো এবং পৃথিবীর সপ্তম প্রাকৃতিক আশ্চর্যের একটি হা লং বের বুক থেকে নেমে আসীন হতে হলো চার চাকার কোচে। আমাদের তখনকার গন্তব্য হ্যানয়, যেখানে অপেক্ষায় ছিল আরো একটি চমৎকার নাইট লাইফ।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৩
এডিএ/এবি/জেসিকে