ঢাকা, শনিবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৯ জুলাই ২০২৫, ২৩ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

যুদ্ধ যখন যৌনতার সুযোগ

তামীম রায়হান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৩৪, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
যুদ্ধ যখন যৌনতার সুযোগ

সিরিয়ার যুদ্ধে একদিকে ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটছে, অন্যদিকে আরববিশ্বের আয়েসি সমাজে তা যৌনচাহিদা উস্কে দিচ্ছে। সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা অসংখ্য নারী শরণার্থী আশেপাশের আরব দেশ থেকে ছুটে আসা যুবক ও শেখদের রিয়াল-দিনারের সামনে নিজেদের কয়েক রাতের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছেন।



m1শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিনদিন ইভটিজিং ও যৌন হয়রানির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। শরণার্থী ছদ্মবেশে দালালরা ঢুকে শেখদের লোভনীয় প্রস্তাবের কথা বলে এসব অপকর্মে নারীদের রাজি করাচ্ছে। পেটের দায়ে খুব সামান্যতেই মা-বাবারাও তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী কন্যাকে তুলে দিচ্ছেন শেখদের সাময়িক ভোগের জন্য। এসব ঘটনায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে জর্ডানের ‘আয যাতারী’ শরণার্থী শিবিরের নাম।

‘আয যাতারী’ শরণার্থী শিবির নিয়ে নতুন করে আবারও হইচই শুরু হয়েছে আরব বিশ্বে। সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ জর্ডানের সীমান্ত শহর ‘মাফরাক’ থেকে দশ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত এ ক্যাম্পটি প্রথম উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসের ২৮ তারিখে। তারপর থেকে প্রতিদিনই আশ্রয়গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একলাখ ষাট হাজারের বেশি। এখনও প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ এ ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসছেন। এরই মধ্যে তা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরণার্থী হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। m420

খাদ্য ও পানীয়ের অভাব, প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রা এবং ধুলোবালির ঝড়ে অতি সাধারণ তাঁবুতে মানবেতর দিনযাপন করছে এই বিপুলসংখ্যক অসহায় পরিবার। প্রায় সবার পরিবারে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের নারীরা গত দেড় বছর ধরে এ অসহনীয় কষ্ট ও ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সম্প্রতি তাদের কপালে যোগ হয়েছে ‘যৌন নিপীড়ন’।

অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পের আশেপাশে বসবাসরত জর্ডানী তরুণ এবং ক্যাম্পের ভেতরে বসবাসরত সিরিয়ান যুবকদের হাতে প্রায় প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছেন আশ্রয় নেয়া তরুণীরা। এমনকি অপ্রাপ্ত বয়স্করাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কোনো কোনো পরিবারের তরুণীরা সন্ধ্যার পর আর তাঁবুর বাইরে বের হতে সাহস করেন না। তাঁবুর অদূরে টয়লেটেও যেতে হলে সঙ্গে মা কিংবা বাবাকে নিয়ে যেতে হয়।

Shewra-m22তবে এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো থেকে জর্ডানে আসা ভ্রমণবিলাসী শেখদের লোভ-লালসা। বিশেষ করে আরব উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে যুবক-তরুণ তো বটেই, ষাট-সত্তর বছরের বৃদ্ধরাও ছুটে আসছেন আয যাতারী ক্যাম্পের আশপাশে। ‘রিয়াল-দিনার’ দিয়ে তারা ক্যাম্প থেকে সিরিয়ার নারীদের বিয়ে করেন এবং সপ্তাহ-দশদিন পর তালাক দিয়ে চলে যান। পরিভাষায় তারা এ বিবাহকর্মকে ‘মুতআ’ বলে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছেন।

আরববিশ্বের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনা হলেও আকারে-ইঙ্গিতে তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তিনদিন আগে তা সবিস্তারে প্রচারিত হয়েছে ‘ইসরাইল’ নিয়ন্ত্রিত একটি টেলিভিশনে। ইসরাইলি সাংবাদিক হেনরিকা জর্ডানের ‘আয যাতারী’ শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেখানকার কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন যাদের বয়স ১৩-১৮ এবং এরা সবাই এ ‘মুতআ’ নামক জঘন্য লালসার শিকার হয়েছেন। হেনরিকা তার এ ফুটেজে উম্মে মাযেন এবং উম্মে মুহাম্মাদ নামের কয়েকজন দালাল নারীর সঙ্গেও কথা বলেছেন যারা ক্যাম্পের ভেতর থেকে এনে তরুণীদের আরব শেখদের হাতে তুলে দেয়ার কাজে ব্যস্ত। m52

ওই টিভি রিপোর্টে ১৩ বছর বয়সী কিশোরীকে দেখানো হয়েছে, যার বিয়ে হয়েছিল ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের সঙ্গে। ১৫ বছর বয়সী আরেক কিশোরীর বিয়ে হয়েছে ৭০ বছরের বুড়োর সঙ্গে।

এসব কিশোরী জানায়, আর্থিক অভাবেই তারা এসব বিয়েতে রাজি হয় এবং বিনিময়ে কিছু আয়-রোজগার হয়।

আয যাতারী ক্যাম্পটিকে জাহান্নাম আখ্যা দিয়ে সাংবাদিক হেনরিকা বলেন, দু’ হাজার কিংবা তিন হাজার দিনারের বিনিময়ে প্রায় প্রতিদিন এখানে এসব আরব শেখ বিয়ে করছেন এবং সপ্তাহ-দশদিন পর তাদের তালাক দিয়ে ফেলে যাচ্ছেন। সৌদিআরব এবং আশেপাশের অঞ্চল থেকে যুবকরাও আসছেন এবং তাদের সবার চাহিদা সর্বোচ্চ সতের বছর বয়সী অবিবাহিত কুমারী কন্যা। প্রস্তাব পাওয়ার পর ভয়ার্ত চোখে কোনো মেয়ে যখন জানতে চায়, ‘আমাকে কি ওই লোক তার সঙ্গে সৌদিআরব নিয়ে যাবেন?’ দালালের উত্তর তাদের নিরাশ করে জানায়,‘না। ’

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যেসব খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে, ক্যাম্পের ভেতর সেগুলোও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি ক্যাম্পের আশেপাশে বসবাসরত জর্ডানের লোকজনও এসে সেসব কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষায়, বাজারের চাল-ডালের চেয়ে জাতিসংঘের পাঠানো এসবের মান অনেক ভালো।

m620জাতিসংঘের হিসাবমতে, আযযাতারী ক্যাম্প বর্তমান পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। এ শরণার্থী শিবিরের অধিবাসীরা জর্ডানের সমগ্র জনসংখ্যার দশভাগ। আযযাতারী ক্যাম্পের ভেতর চলমান এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে এর আগে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরে একটি ফুটেজ প্রচারিত হয়েছিল যা সেসময় আরবদুনিয়ায় আলোচিত হয়েছিল। এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত জর্ডানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইডসহ আরও নয়টি রোগের মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে ওই শরণার্থী শিবিরে।

উল্লেখ্য, ‘মুতআ’ নামের এমন সংক্ষিপ্ত মেয়াদী বিয়ে ইসলামের সূচনাযুগে বৈধ থাকলেও রাসূল (সা.) পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ করে দেন। একমাত্র শিয়া সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোথাও ‘মুতআ’ বিয়ে বৈধ নয়। বরং তা ব্যভিচারের সমতুল্য অপরাধ।

তামীম রায়হান: শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়, amimraihan@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
জেডএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।