খুলনা: সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কুঙ্গা ও মরাপশুর নদের মাঝে দুবলার চরের অবস্থান। মূলত এটি একটি জেলে গ্রাম।
রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত রাস পূর্ণিমার পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হবে। যেকেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন ভিন্নধর্মী এ রাসমেলা থেকে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাস পূর্ণিমায় নিরাপদে যাতায়াতে তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। এসব পথেই বন বিভাগ, পুলিশ, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড বাহিনী তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
বন বিভাগ নির্ধারিত আটটি পথ হল বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর। কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদারগাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর, কয়রা- কাশিয়াবাদ-খাসিটানা-বজবজা হয়ে আড়য়া ও শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর, নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর, ঢাংমারী/চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর, বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর এবং শরণখোলা স্টেশন-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর।
রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশ থেকে বিপুল পুণ্যার্থী ও পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রতিবছর এ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। মেলায় বসে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান। হিন্দুদের নানান পূজা-অর্চনার ফাঁকে সন্ধ্যায় ফানুস উড়ানো হয়।
ভোরের প্রথম জোয়ারে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে মেলার প্রধান প্রার্থনা শুরু হয়। আর উৎসবের শুরু হয়ে যায় ভোররাতেই। সুন্দরবনের আলোরকোল সমুদ্র সৈকতে প্রদীপ নিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। সূর্যোদয়ের পর জোয়ারের পানি পুণ্যার্থীদের পায়ে ছোঁয়ালাগা মাত্রই তারা নেমে পড়েন স্নানে। সুন্দরবনে মাছ ধরার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় দুবলার এ রাসমেলার মধ্য দিয়েই।
খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিসের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা গাজী জাকির হোসেন রোববার সন্ধ্যায় বাংলানিউজকে বলেন, দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীরা ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর তিন দিনের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি পাবেন। এজন্য প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে।
যাত্রীরা একটি মাত্র নির্ধারিত পথ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। এ পথেই দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবেন তারা। যাত্রীরা বনবিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানোর সুযোগ পাবেন না।
পুণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রাপ্ত সনদপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, পটকা ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাসমেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও এর নিরাপত্তায় ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বন বিভাগ ও প্রশাসন।
তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তা ছাড়াও হরিণ শিকার রোধে বন প্রহরীদের সঙ্গে মেলায় এবারও র্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশের বাড়তি টহল থাকবে। পুরো সুন্দরবনজুড়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকবে। এছাড়া কোনো দর্শনার্থী যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন সেজন্যও বিশেষ সতর্কাবস্থা নেওয়া হয়েছে।
দুবলার চরের রাসমেলার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নানান মত প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এ মেলা শুরু করেছিলেন। তিনি ২৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের গাছের ফলমূল খেয়ে অলৌকিক জীবনযাপন করেছেন।
অন্য একটি মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগের কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে রাসমেলার প্রচলন।
আবার কারো মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরেই দুবলার চরে নিয়মিত উদযাপিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৩
এমআরএম/এসএইচ/কেএইচকিউ/জেসিকে