চট্টগ্রাম: একদিন ভরদুপুরে মোবাইলফোনে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনারের কার্যলয় থেকে ফোন এল, ‘আপনি নিশ্চয়ই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের ফটো করেসপন্ডেন্ট সোহেল সরওয়ার। আপনার বয়স কি ৩০ এর মধ্যে?
হ্যাঁসূচক উত্তরেই ওপাশের কণ্ঠটির ঘোষণা, “আপনাকে আমরা বাংলাদেশের যুব প্রতিনিধি দলের হয়ে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি!”
ফোন ছেড়ে গলা ফাটিয়ে এক চোট হেসে নিলাম।
বিকেল নাগাদ যখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম ঘটনাটি এভাবেই ঘটতে চলেছে তখন খুশিটা একটু বেশিই লাগছিলো। সদ্য বিয়ে করেছি। স্ত্রীকে আর বাবা-মাকে খবরটি দেওয়ার জন্য ছুটলাম ঘরে। কেউই যেনো বিশ্বাস করতে চায় না খবরটি।
এর মাস খানেক পর যখন ব্যাগ গুছিয়ে সত্যিই ভারত যাবার জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছাড়লাম তখনও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটু অবিশ্বাস। আর আমার তখন শুধুই উচ্ছ্বাস।
এই উচ্ছ্বাস অনেকগুলো কারণে। সাংবাদিকতায় এসেছি ২০১০ সালে। আমার চেয়ে সিনিয়র অনেক সাংবাদিক আছেন। আমার মত কনিষ্ঠ একজন সাংবাদিক ভারত যাচ্ছি, তাও হাই কমিশনের আমন্ত্রণে। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
২১ অক্টোবর দুপুরে ১০০ বাংলাদেশি যুব প্রতিনিধি নিয়ে বিমানটি যখন দিল্লির আকাশে চক্কর দিচ্ছিল, তখন একটা উত্তেজনা ও মুগ্ধতা একসঙ্গে কাজ করছিলো।
বিশাল বিশাল ভবন, নখের পিঠের মত সড়ক সঙ্গে প্রকৃতির সমাহার, সাঁই সাঁই করে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা গাড়ির সঙ্গে যেন ছুটছে রাস্তার পাশে থাকা বাড়িগুলোও। বলা যায় প্রথমেই মুগ্ধ হলাম দিল্লি দর্শনে।
প্রথম দিনেই দিল্লির ঐতিহ্যবাহী কুতুব মিনার আর হুমায়ুনের সমাধিস্থল ঘুরিয়ে দেখানো হলো।
ক্যামেরা হাতে কাজ করি। সুন্দর দৃশ্য সামনে এলে দেখার চেয়ে ছবি তুলতেই বেশি ভালো লাগে। প্রচুর ছবি তুলেছি কুতুব মিনারের। সঙ্গে দেখেও নিলাম মন ভরে। বইপুস্তক পড়ে যতটুকু জেনেছি, আর বাস্তবে যা দেখলাম তাতে নিশ্চিত হলাম ঐতিহাসিক এসব স্থাপনার বর্ণনা দিয়ে এর সৌন্দর্য ও গুরুত্ব বোঝানো যায় না।
পরদিন ২২ অক্টোবর রাজঘাটে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সমাধিস্থলে গেলাম। সমাধির সামনে সবাই যখন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়েছিলাম তখন মনে ভাসছিলো বাংলাদেশ আর বাঙালীর অকৃত্রিম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর কথা।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, এই দলে আমরা যারা ছিলাম, তরুণ প্রজন্মের বলে আমরা কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। শুধুই শুনেছি, আমাদের মুক্তিসংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধী সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন, কোটি শরণার্থীকে তিনি তার দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর সহযোগিতা না পেলে হয়ত আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হত। এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ আমি পেলাম, এটাও আমার এবং আমাদের সবার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
তাজমহল দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা কাজ করছিলো গোটা টিমেই। ২৩ অক্টোবর দুপুরে যুব প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বাস আগ্রায় তাজমহলের অদূরে পৌঁছে, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল তাজমহলের একাংশ। উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারছিলাম না। অন্য অনেকের মতো আমিও বাসের মধ্যেই লাফালাফি শুরু করলাম, এই তো তাজমহল, এই তো তাজমহল!
চোখ ও ক্যামেরার লেন্স দুটোই তখন অনেক সজাগ ও সচল। বাসের ভেতর থেকেই ছবি তোলা শুরু করে দিই। তাজমহল পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই শ’খানেক ছবি বোধহয় আমার তোলা হয়ে যায়।
তাজমহলের তিনটি প্রবেশপথের মধ্যে যে পথ দিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের ঢোকানো হয় সেই পথ দিয়ে আমরাও ঢুকলাম। বিষয়টি ছিলো বাড়তি গর্বের।
উচ্চ মিনারের সমাহারে, মূল্যবান পাথরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটিকে প্রবেশপথের কাছ থেকেও অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল যেন ছোট্ট কোন বাড়ি।
প্রায় আধাঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে একপলক তাকিয়েই বুঝে যাই কেন এই তাজমহল পৃথিবীর মানুষের চোখে মানবসৃষ্টির অপার বিস্ময়!
খুব মনে হলো, ইতিহাসের পাতায় যেটি প্রেমের নিদর্শন সেটি একাধারে ভক্তি আর ভাবাবেগের উপলক্ষও বটে।
যমুনা নদীর পাড়ে বানানো তাজমহলকে যে পাশ দিয়েই দেখি সবদিকই মনে হয় একইরকম। ক্যামেরায় তাজমহলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করতে গিয়েই সেটা মনে হলো।
সম্রাজ্ঞী মমতাজের কবরের ছবি না তোলার অনুরোধ করেছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিন্তু আবেগের বশে সেই অনুরোধ রাখতে পারিনি। বেশকিছু ছবি তুলে ফেলি।
সেসময় একবার স্ত্রীকে ফোন করে কথা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তাবদ দুনিয়ায় স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার এই বিষ্ময় নিদর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে কি সবারই এমনটা মনে হয়! প্রশ্নটি মনে আসছিলো বার বার। দুর্ভাগ্য মোবাইল ফোন ভেতরে নেওয়ার অনুমতি ছিলো না।
বঙ্গভবনে যাওয়া হয়নি কখনো। সামান্য সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে সে সুযোগটিও হয়নি। কিন্তু ঘুরে এলাম ভারতের রাষ্ট্রপতির বাসভবন! ২৪ অক্টোবর ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর বাসভবনে তার সঙ্গে দেখা হলো আমাদের।
প্রণব মুখার্জী বাংলাভাষী, বাঙালি। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে সেতো জানা। পত্রপত্রিকায় বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের কথাও অনেক পড়েছি। তবে খুব একটা যেনো মেলাতে পারছিলাম না। ভারতের মত একটি পরাশক্তির কর্ণধার হয়েও তার খুবই সাধারণ জীবনযাপন, সুমিষ্ট ব্যবহার দেখে শ্রদ্ধা জাগে।
রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকার আগে আমাদের ব্রিফিং দেওয়া হয়, কিভাবে দাঁড়াব, কিভাবে কথা বলব। কিন্তু সাধারণ একটি সাফারি স্যুট পরে খুব সহজ, সরলভাবে রাষ্ট্রপতি যখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, মনে হলো এতো আমাদেরই লোক।
হবে না কেনো, জাতি হিসেবে বাঙালি ঠাঁট-বাটের চেয়ে কাজটিকেই যে বড় করে দেখে। আর প্রণবতো কেবল বাঙালিই নন, তিনি আমাদের বাংলাদেশের জামাই বাবুও বটেন।
সে কথা বললেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী নিজেই। বলেন, আমি যখন রাষ্ট্রপতি হই, তখন বাংলাদেশের পত্রিকায় নিউজ হয়েছে-বাংলাদেশের জামাইবাবু ভারতের রাষ্ট্রপতি। এটা আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে।
সাক্ষাৎ, ফটোসেশনের শেষে ভারতের রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ভারতকে ভাল করে ঘুরে দেখো কিন্তু। ’
আটদিনের সফরে কি আর এতবড় ভারতবর্ষকে ভাল করেই ঘুরে দেখা যায়! তারপরেও যা দেখেছি তার তালিকা অনেক বড়। ইন্ডিয়া গেট, ইউনিভার্সিটি অব দিল্লি, মিরিন্ডা হাউস, ভারতের পার্লামেন্ট ভবন, বিধানসভা, লালবাগ, ব্যাঙ্গালোরে দেবী শেঠীর হাসপাতালসহ আরও অনেক কিছু।
২৮ অক্টোবর কোলকাতা হয়ে আমাদের যুব প্রতিনিধি দলটি দেশে ফেরে। আমিও ঘরে ফিরি ভারতজয়ীর বেশে।
একটি কথা বলতেই হয়, ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাকে বেছে নিয়েছেন আমি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ কর্মরত বলেই। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ছিলাম আমি।
বাংলানিউজ কেন তাদের কাছে প্রিয় ও গুরুত্বের তার প্রমানও পেয়েছি সফরকালেই। ভারত থেকেই আমি ছবি তুলে পাঠিয়েছি, সেগুলো বাংলানিউজে প্রকাশ হয়েছে নিয়মিতভাবে। ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের নিউজ সবার আগে ও অত্যন্ত দ্রুততায় বাংলানিউজে আপলোড হয়। এতে ভারতের কর্মকর্তারাও খুব খুশি হন। সর্বোপরি আমি যে সুযোগ পেয়েছি সেজন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
আরডিজি/এমএমকে