ঢাকা: শুক্রবার ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল মাঠ।
পুবাকাশে উঁকি মারছে সূয্যি মামা। সোনালি রোদে ঝিলমিল করছে শিশিরের জল। তাপহীহ রোদে দাঁড়িয়ে শিশিরের অট্টহাসি দেখতে ভালোই লাগছে।
ভর দুপুরে আকাশ জুড়ে সূর্যের রাজত্ব দেখা গেলেও নিচে প্রচণ্ড রোদকে কেউ যেন গ্রাহ্যই করছেন না। কাজকর্মেও কাউকে তেমন ক্লান্ত হতে দেখা যায় না। প্রশান্তির মাঝেই কেটে যায় কর্মজীবী মানুষের পুরো দিন।
কার্তিকের সন্ধ্যা। প্রকৃতি উদার। শির শির হাওয়া বইছে উত্তর দিক থেকে।
রাজধানীর হাতিলঝিলের সন্ধ্যা। অনেকের গায়ে মোটা কাপড়। অনেকে পাতলা কাপড় পড়ে আটোসাঁটো হয়ে বসে আছে। পাশে তৈরি হচ্ছে ভাঁপা পিঠা। দূরে তাকালে চোখে পড়ে কুয়াশা।
বেশ কয়দিন ধরে রাজধানীতে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ছে। এর মাধ্যমে প্রকৃতি জানান দিচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ অতিক্রম করে রাজধানীতে শীত সমাগত।
বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদন পার্ক, শপিং সেন্টার, কাঁচা বাজার, হাসপাতাল ও ফুলের দোকান ঘুরে শীতের আবহ লক্ষ্য করা গেছে।
জমে উঠছে শীতের মার্কেট:
রাজধানীর গুলিস্তান হকার মার্কেট। সোয়েটার, মাফলার, কানটুপি, হাত মোজা, ব্লেজার, চাঁদর ও জ্যাকেট নিয়ে বসে আছেন মোজাম্মেল দোকানদার।
মোজাম্মেল বাংলানিউজকে বলেন, এখন রাজধানীতে হালকা শীত। কয়দিন পর প্রচণ্ড শীত নামবে। এর জন্য আগে-ভাগেই ক্রেতারা শীতের কাপড় কিনে রাখছে। দোকানে ভিড়ও বাড়ছে।

শীতের পোশাক কিনতে আসা সুইটি আক্তার তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি শীত আসার আগেই গরম পোশাক কিনে রাখি। সামনে শীত তাই সোয়েটার কিনতে এসেছি। মার্কেটেও সব পছন্দের কাপড় পাওয়া যাচ্ছে।
সবজি বাজার:
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, পলাশী, মালিবাগ, শান্তিনগর ও সদরঘাটের শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে শীতকালীন শাক-সবজিতে ভরে গেছে কাঁচা পণ্যের দোকানগুলো।
ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর, শিম, মূলা, বরবটি, লাল শাক, সরিষা শাক, লাউ শাক, পালং শাক, পুঁই শাক, ডাটা শাক ও কচু শাকের পশরা সাজিয়ে বসে আছেন জাহিদ সরকার।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন প্রচুর শীতকালীন শাক-সবজি পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো কিনতে ক্রেতারাও ভিড় করছে।
ফুলের দোকান:
রাজধারীর শাহবাগে ফুলের দোকান ঘুরে দেখা যায়, জেরিন ফ্লাওয়ার সপে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডালিয়া, রজনীগন্ধ্যা, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, গ্ল্যাডিওলাস, জিনিয়া, কাটবেলি ও লাল গোলাপ।
এই দোকানের ফুল বিক্রেতা নুর জামাল বাংলানিউজকে বলেন, এখন শীত এসেছে তাই এসব ফুল বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে কর্ণফুলি ফ্লাওয়ার সপেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। ফুল কিনতে আসা ফারহানা রুবি বাংলানিউজকে বলেন, এখানে গ্লাডিওলাস ও চন্দ্রমল্লিকা কিনতে এসছি। প্রিয়জনের জন্মদিনে এই ফুলগুলো উপহার দিতে আমার খুব ভালো লাগে।
শীতের পিঠা:
রাজধানীতে প্রায় প্রতিটি সড়কের মোড়ে এখন চোখে পড়ছে পিঠার দোকান। ঝটপট তৈরি হচ্ছে ভাঁপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা ও তেলের পিঠা। বিক্রিও হচ্ছে সমানতালে।
পুরান ঢাকার শাখারি বাজার, যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা মোড়, কারওয়ান বাজার, পলাশীর মোড় ঘুরে এই চিত্র দেখা যায়।
এছাড়া শীতকে ঘিরে রাজধানীর সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো তৈরি করছেন গোলাপ ফুল পিঠা, রসফুল পিঠা, জামদানি, হাঁড়ি, ঝালপোয়া, ঝুরি, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, কুলশি, নারকেল, তেজপাতা, তেলপোয়া ও বিবিয়ানাসহ আরো নানা ধরনের পিঠা।
আজিমপুরের বাসিন্দা জহুরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমি শীত এলেই নানা ধরনের শীতের পিঠা তৈরি করে থাকি। এবারও দুধরাজ, ফুল ঝুরি, বিবিয়ানা, সেমাই, চিড়ার মোয়া, কাউনের মোয়া, ঝাল মোয়া, নারকেল নাড়ু, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি নারকেল জেলাফি তৈরি করেছি।
তিনি বলেন, শীতকালে পিঠাগুলো সংরক্ষণের সুবিধা অনেক। এসময় তৃপ্তি সহকারে খাওয়া যায়। প্রচুর খেলে শরীরেরও তেমন সমস্যা হয় না।
শীতের প্রাদুর্ভাব:
মায়ের নরম কোলে নুয়ে পড়েছে শিশু হাসানের মাথা। তার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর সাথে সর্দি, কাশি ও শ্বাস-কষ্ট। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন মা সালমা বেগম। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বসে আছেন হাসপাতালের শিশু মেডিসিন বহির্বিভাগের কক্ষে।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলো তার। সালমা বেগম বলেন, তিন-চার দিন ধরে ছেলের শরীর খুব খারাপ। ঠাণ্ডা রোগে ধরেছে। বার বার শ্বাস-কষ্ট হচ্ছে। ছেলের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে এসেছি।
হাসানের যাবতীয় সমস্যা পর্যবেক্ষণ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক চিকিৎসক শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ইউ কে এম নাজমুন আরা বাংলানিউজকে বলেন, হাসানের আগে থেকেই শ্বাস-কষ্ট ছিল শীত আসার কারণে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এই শিশুর জ্বর, সর্দি ও কাশিও শীতের কারণেই হয়েছে বলেও জানান তিনি।
হাঁপানি বেড়ে যাওয়ার ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে এসেছেন আলমগীর হোসেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন তিনি। বড় ছেলের কাঁধে ভর করে এসেছেন হাসপাতালে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শীত এলেই আমার হাঁপানি বেড়ে যায়। প্রচণ্ড শ্বাস-কষ্ট হয়। সহ্য করতে পারি না।
বুধবার সকালে ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগে ঠাণ্ডাজনিত রোগীদের সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে।
এ সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রাজ দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, বয়স্ক ও শিশুদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অনেক কম। তাই শীতকাল এলে তাদের শরীরে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দেখা যায়।
তিনি বলেন, বিশেষ করে যাদের শ্বাস-কষ্ট আছে তাদের শীতকালে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ শীতকালে শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাস সংক্রমনের সুযোগ বেড়ে যায়।
এছাড়া এ সময় নিউমোনিয়া, এলার্জি ডিজিস, সাইনোসাইটিস, এ্যাজমা ও স্কিন ডিজিসের মতো সমস্যাও দেখা যায় বলে জানান তিনি।
তবে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া, ধুলা বালি এড়িয়ে চলা, গরম পোশাক পড়া ও অত্যধিক ঠাণ্ডা খাবার না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
এফআইএস/এমজেএফ/জেসিকে