ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সিনেমাকেও হার মানালো যে পুনর্মিলন!

হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৫৫, ডিসেম্বর ৩, ২০১৩
সিনেমাকেও হার মানালো যে পুনর্মিলন!

ঢাকা: খুব সম্ভবত চলচ্চিত্রেও মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের পুনর্মিলনের এমন অভাবনীয় গল্প নেই। নেই এমন আবেগ, আর অশ্রু ঝরা ভালোবাসা! অপহরণের দীর্ঘ ২৩ বছর পর মা-বাবার বুকে ফিরলো সন্তান! মা-বাবা-সন্তানের মহামিলনের এমন বাস্তব ইতিহাস রচনায় সহযোগিতা করলো বর্তমান সময়ের আশীর্বাদ তথ্য-প্রযুক্তিও।



১৯৯০ সালে পাঁচ বছর বয়সে চীনের সিচুয়ান প্রদেশ থেকে অপহৃত হয়েছিলেন লুয়ো জ্যাং নামে এক স্কুলবালক। অপহরণের পরই তাকে ১৫শ’ কিলোমিটার দূরে আরেকটি প্রদেশে এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

বাবা-মা, গ্রাম বা এলাকার নাম না জানায় নতুন পরিবারটির সঙ্গেই বসবাস করতে শুরু করে শিশুটি। প্রিয় জন্মধাত্রী আর জন্মদাতাকে চোখে না দেখলে সবার চোখে যেমন অশ্রু গড়ানোর কথা, তেমনি অশ্রু গড়িয়েছে লুয়োরও। কখনো বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে, কখনোবা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছে নিজের কলিজা। কিন্তু প্রিয় মুখগুলো ফের দেখার আশায় বুঝিয়েছেন অবুঝ মনটিকে। সেই বুঝ থেকেই বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবাকে খুঁজে বের করার কাজ শুরু করেন।

চলচ্চিত্রের গল্পকেও হার মানিয়ে যুগ দুয়েক পর সম্প্রতি কাব্যগাঁথা সৃষ্টি করেছে সেই শিশুটি। এখন অবশ্য মা-বাবার বুকে ফেরা সেই ‘শিশু’ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা।

মা-বাবা কিংবা প্রিয় ভাইকে চিহ্নিত করে বাড়িতে ফেরার পর কী আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল সে দৃশ্যটি যে কাউকেই কাঁদাবে। কাঁদিয়েছে লুয়োর প্রতিবেশী- আত্মীয়দেরও।

হাউমাউ করে কেঁদে ছেলেকে বুকে টেনে নেন মা, যেন মায়ের চেয়েও তীব্র শোকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন লুয়ো।

তাইতো পাঁচ বছর বয়সে খাওয়া ছেলের প্রিয় নুডুলস রান্না করে তার সামনে রেখে কেবল মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন মা, আর বলছিলেন, সেগুলো মনে করো না বাবা, এই নুডুলসগুলো কি সুস্বাদু? আরও দেবো? আর কিছু চিলি সস দেবো তোমায়?

ক্ষীণ স্বরে ‘না’ শোনা গেলেও ছেলে যে খাওয়ার মধ্যেও ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন তা বুঝতে মুহূর্তও সময় লাগে না মায়ের। ফের বুকে টেনে নেন ছেলেকে।

অন্যদিকে, ২৩ বছর পর ফেরার খবর পেয়ে শিশু লুয়োকে দেখতে আসা পাড়া-প্রতিবেশীদের আশীর্বাদ-শুভ কামনা গ্রহণ করছিলেন বাবা।

লুয়োকে তার মা-বাবার কোল থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এই নির্মম গল্পের শুরুর দিকে ফিরে যান বর্তমান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

সেটা ১৯৯০ সাল। সিচুয়ান প্রদেশের ইয়াওশিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী হুয়াং জ্যান। নির্মাণ শ্রমিক বাবা আর দোকানী মায়ের সঙ্গে সে এবং তার আদুরে এক ভাই থাকতো। মা-বাবার কোলজুড়ে হৈ-হুল্লোড়ে সময় কাটতো দুই ভাইয়ের।

এক শান্ত সকালে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সময় লুয়োকে ২৩ বছরের জন্য ‘ভিন দুনিয়ায়’ নিয়ে যায় এক পাচারকারী দম্পতি।

লুয়ো বলেন, আমি যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন এক দম্পতি আমার সামনে দাঁড়ান। ভেবেছিলাম তারা হয়তো আমার মা-বাবার বন্ধু, তাই তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাই।

তিনি বলেন, এরপর আমাকে গাড়ি থেকে গাড়িতে চড়িয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়। বুঝে উঠতে পারি না। পথে পথে কেবল প্রশ্ন জাগতো মা-বাবাকে দেখছি না কেন? আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

একসময় জানতে পারি, ফুজিয়ান প্রদেশের একটি পাহাড়ি এলাকায় আছি আমি।

নিষ্পাপ একটি স্কুলছাত্রকে নিজের পরিবার থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে ফুজিয়ানের পশ্চিমাঞ্চলীয় স্যানমিং শহরে একটি পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেয় পাচারকারীরা। কিনে নেওয়া দম্পতি স্কুলবালকটির নতুন নাম দেন ‘লুয়ো’ এবং তাকে নতুন একজন বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

লুয়ো বলেন, অপহরণের পর আমি খুব শঙ্কিত ছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো কিছুদিন থাকতে হবে, কিন্তু ক’দিন পরই আমি বুঝতে পারি সে সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু অবুঝ শিশুমনকে বুঝিয়ে ‍লুয়ো সিদ্ধান্ত নেন তিনি তার হারানো সোনালী দিনগুলো ফিরিয়ে আনবেন। প্রতি রাতেই বিছানায় ঘুমোনোর সময় মা-বাবার কোলজুড়ে দুই ভাইয়ের দুষ্টুমি-খেলার কথা স্মরণ করতেন, আর একান্তেই বালিশ ভেজাতেন চোখের জলে।

তার চোখে ভাসতো বাড়ির পাশে পুরাতন ব্রিজের ওপর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলার দৃশ্য। মেঠোপথ ধরে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য, মায়ের সঙ্গে দোকানে বসার দৃশ্য, ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়ে পিঠে ব্যাথা পেয়ে মায়ের কোলে বেশ ক’দিন আরামে ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য।

অপহৃত হওয়ার পর লুয়োর মা-বাবা অভিযোগ করলেও কোনো সুফল পাননি। চীনের পাহাড়ি এলাকায় এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে গিয়ে কাউকে খোঁজ করা বেশ দুস্করই বটে, তার ওপর লুয়ো প্রায় ১৫শ’ কিলোমিটার দূরত্বের আরেকটি প্রদেশে ছিলেন।

লুয়ো বলেন, দত্তক মা-বাবা আমাকে তাদের সন্তানের মতোই আদর-যত্ন করলেও আমি আমার জন্মদাতা মা-বাবাকে ফিরে পেতে চাইতাম এবং অনেক সময় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতাম। যেহেতু পাচারকারীদের পাঁচশ’ পাউন্ড (প্রায় ৬৪ হাজার টাকা) দিয়ে তারা আমায় কিনেছিলেন তাই তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না।

লুয়ো অপহৃত হওয়ার পর মা দ্যাই ঝিয়ানফ্যাং ও বাবা হুয়াং কিংঝং পার্শ্ববর্তী শহর ও এলাকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি লেখা লিফলেট ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, মা-বাবার চোখের অশ্রু শুকিয়ে যায়, কিন্তু ছেলের মায়াবী চেহারার দেখা মেলে না। সে কারণে, আরেকটি সন্তান দত্তক নেন দ্যাই ও হুয়াং।

ওদিকে, স্কুল-কলেজ শিক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার ব্রিগেডে চাকরি নিয়ে নিজের নতুন জীবন শুরু করেন লুয়ো। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিণতও হয়ে ওঠেন তিনি। পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার বুকে ফেরার আগ্রহও তার তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

মা-বাবার বুকে ফিরতে লুয়োর এই কামনা এড়িয়ে যাওয়ার সাহস করেননি স্বয়ং বিধাতাও। লুয়ো ফিরলেন মা-বাবার বুকে। চীনের একটি প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করে লুয়ো বলেন, ‘সবকিছুই তার শেকড়ে ফেরে’।

লুয়োর মা-বাবাকে ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও বিস্ময়কর আরও চমকপ্রদ। এ প্রক্রিয়া তুলে ধরেন লুয়ো নিজেই।

মা-বাবাকে ফিরে পাওয়ার তীব্র ‍আকাঙ্ক্ষা থেকে গত বছরের অক্টোবরে ২৭ বছর বয়সী লুয়ো ‘বেবি কাম হোম’ নামে একটি ওয়েবসাইটে নিজের স্মরণে থাকা তথ্যগুলো পোস্ট করেন এবং বেড়ে ওঠার বেশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করেন।

মা-বাবা যাতে ছেলেকে চিহ্নিত করতে পারেন সেজন্য নিজের দৈহিক বিশেষত্বগুলো উল্লেখ করেন লুয়ো।

তিনি লেখেন, ‘আমার উচ্চতা ছিল ১১০ সেন্টিমিটার, আমার চোখগুলো অনেক বড় ছিল, ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ার দাগ আছে আমার হাতে।

অপহরণের সময় তার গায়ে সাদা মোটিফের মধ্যে লাল রঙা সোয়েটার পরা ছিল এবং তিনি বাড়িতে সস দিয়ে শূকরের মাংস খেতেন সেটাও উল্লেখ করেন পোস্টে।

কোন গ্রাম থেকে এসেছেন সেটা উল্লেখ করতে না পারলেও স্কুল জীবনে পড়া প্রদেশের নাম উল্লেখ করেন যে, তিনি সিচুয়ান থেকে এসেছেন।

বাড়ি ও গ্রামের বিশেষত্ব উল্লেখ করে তিনি পোস্টে বলেন, ‍আমার বাড়ি টাইলসে তৈরি ছিল। বাড়ির সামনে দিয়ে একটি পিচঢালা নতুন রাস্তা ছিল। অনেক গাড়ি চলাচল করতো সেই রাস্তা দিয়ে। বাড়ির পাশে ছিল কিছু পাহাড়। আর একপাশ দিয়েই একটি নদী বয়ে গেছে বাবার কাছে শোনা শহরের দিকে। কোনো ট্রেন চলাচল না করলেও বাড়ির পাশ ঘেষে একটি পুরাতন রেলরাস্তা ছিল।

লুয়োর পোস্টটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে একের পর এক পরামর্শ ও মন্তব্য আসতে থাকে।

জনৈক স্বেচ্ছাসেবী লিখেন, ১৯৯০ সাল! উত্তর সিচুয়ানের নিম্নভূমি এলাকার লোকজন সস ও সরঘাম উৎপাদন করে না।

আরেকজন লিখেন, যদি সেখানে পিচঢালা রাস্তা থাকে ‍তার অর্থ সেটা দরিদ্র এলাকা নয়, নিশ্চয় শহরতলী এলাকা।

ক’দিন ধরে এমন আলোচনা-পরামর্শের মধ্যেই নিজের গ্রামের দৃশ্য এঁকে সেটি পোস্ট করেন লুয়ো। গ্রামের ছবিতে বাড়ির পাশের পুরাতন ব্রিজ, ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে স্কুলে যাওয়ার মেঠোপথ, বাড়ির অদূরে পাহাড় এবং নতুন তৈরি করা পিচঢালা পথ ফুটিয়ে তুলেন তিনি।

কিছু মাস পর লুয়োর গ্রামের ছবি অনুযায়ী সিচুয়ানের কয়েকটি শহরের নাম উল্লেখ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কিন্তু অনেক বেশি শহর ও অনেক বড় আয়তন হওয়ায় নিজের গ্রাম চিহ্নিত করতে পারছিলেন না লুয়ো।

মা-বাবাকে খোঁজার কার্যক্রম খানিকটা ধীরগতির হয়ে গেলেও হতাশ হয়ে যাননি লুয়ো। লুয়োর আবেগী সব পোস্টে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবীরা। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ১৯৯০ সালের কাছাকাছি সময় বন্যায় সিচুয়ানের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়ে কাঠামো পরিবর্তনের ওপর সংবাদ পত্রের কাটিং সংগ্রহ করে সেগুলো পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায় নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নতুনভাবে গড়ে তোলা হয় ওই এলাকাকে।

এরপর গত মার্চে ১৯৯০ সালের সময়কার ওই এলাকার একটি সড়ক যোগাযোগের ম্যাপ পান লুয়ো। ওই ম্যাপে দু’টি রাস্তা দেখানো হয়, যার একটি পরে (বন্যার পর) তৈরি করা হয়।

লুয়ো স্যাটেলাইট যন্ত্রের মাধ্যমে সেই রাস্তাগুলো খুঁজতে থাকেন এবং তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত পুরাতন ব্রিজ ও বাড়ির পাশের ধানক্ষেতগুলো খোঁজার চেষ্টা করেন।

স্বেচ্ছাসেবীদের নির্দেশনা মতো গ্রামটির পাশ দিয়ে শহরের দিকে ৯০ ডিগ্রি বেঁকে প্রবাহিত হওয়া নদী লক্ষ্য করেন তিনি। তার পাশ দিয়ে ধান ও মিষ্টি আলুর ক্ষেত খুঁজে পান তিনি।

এরপর গত এপ্রিলে ডিজিটাল ভ্রমণ যন্ত্রের মাধ্যমে লিনশুই কাউন্টির ইয়াওশিয়া গ্রামে যান লুয়ো। সেখানে গিয়ে পুরাতন স্কুল ও ব্রিজ চিহ্নিত করেন তিনি। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন স্কুলের বিপরীতে একটি সিরামিক কারখানা গড়ে উঠেছে। লুয়োর চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, চোখের সামনে যেন তার সবকিছুই মনে পড়তে থাকে।

লুয়ো বলেন, আমি যখন একের পর এক আমার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করছিলাম তখন কেবল কাঁপছিলাম আর মা-বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম।

পরে এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় নিজের মা-বাবার ঘরে গিয়ে ওঠে ‘মায়াবী চেহারার শিশুটি’।

লুয়ো বলন, আমি আমার অশ্রু ধরে রাখতে পারছিলাম না। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আমার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন।

পরিবারের সঙ্গে লুয়োর এ মহামিলনকে প্রকৃতির বিস্ময়কর উপহার বলে মন্তব্য করেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।