মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: গতবছর দিল্লির অভিজ্ঞতা থেকে এখানেও দেখলাম ক্যাব চালকদের সঙ্গে বিভিন্ন বড় মাল্টিস্টোরের চুক্তি থাকে। এসব স্টোরে অবশ্যই বিশেষ কিছু এন্টিক সামগ্রী পাওয়া যায়, যা ওই দেশের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যকে ধারণ করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শত ফুট উঁচু মূর্তিটি চোখে পড়ে আমাদের। তবে তামিল চালক বাতু কেভসে নেওয়ার আগে এরকম একটি দোকানে নিয়ে যান আমাদের। প্রবেশের সময়ই বুঝতে পারলাম দোকানটিতে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এখানে ছবি তোলা নিষেধ।
প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই দরজা বন্ধ করা হলো। সেদিনটায় বেশ রোদ। আমাদের খেতে দেওয়া হলো ঠাণ্ডা জুস। সত্যি প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। এরপর একজন সেলসম্যান এসে অভিবাদন জানিয়ে দোকানের ধাতু আর বিভিন্ন মূল্যবান পাথরের তৈরি সামগ্রী দেখানো শুরু কোরে সেগুলোর ইহ ও পরজাগতিক গুণও বলতে শুরু করলেন।
তবে শেষ পর্যন্ত কিছু কেনা হলো না। বের হয়ে দেখি তামিল চালক কাউন্টারে কথা বলছেন। মনি আপা এর আগে আরও অনেক দেশে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি বেশ পটু। ট্যাক্সিতে উঠে বললেন, ‘আই বট অ্যা পেন’। মনে হলো চালক বেশ স্বস্তি পেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের সামনে দেখলাম হিন্দু দেবতা মুরুগানের ১৪০ ফুট দীর্ঘ মূর্তি দাম্ভিকতা আর আর্শীবাদের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সোনালি রঙের মূর্তিটি বাতু কেভসের বাইরে। এ মূর্তিটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ২৪ মিলিয়ন রুপি। এটিতে ব্যবহৃত হয়েছে ১৫৫০ কিউবিক কনক্রিট, ২৫০ টন স্টিলের বার ও তিনশ লিটারের গোল্ড পেইন্ট, যেগুলো কেনা হয়েছিল থাইল্যান্ড থেকে। মূর্তির সামনে বিশাল চত্বরে এক ঝাঁক কবুতর নিশ্চিন্ত মনে খেলে বেড়াচ্ছে।
মুরুগানের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঝটপট আমরা ফটোসেশন সারলাম। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান। যেখানে পর্যটকরা কেনাকাটা করতে পারেন।

ভূমি থেকে ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতু কেভস। আমি আর ইশতিয়াক ভাই পা বাড়ালাম পাহাড়ের ওপরের গুহায় প্রবেশের জন্য। মনি আপা আত্মসমর্পণ করলেন। বললেন, ‘তোমরা যাও, এই বয়সে আমার আর সম্ভব নয়। আমি এখানে কেনাকাটা করি। ’
তবে উঠতে উঠতে বুঝলাম এই কাঠফাটা রোদে ওপরে ওঠার সিদ্ধান্ত ঘাম ঝরাবে। সিঁড়ি ভাঙতে হবে ২৭৬টি। তাই আস্তে আস্তে ওঠা শুরু করলাম আমরা। কিছুক্ষণ উঠে পেছনে ফিরে দেখি মূর্তির মাথা সমান উঠতে পেরেছি কিনা। তারপর একটু জিরিয়ে নেওয়া, আবার উপরে ওঠা।
মাঝামাঝি ওঠার পর বললাম, ‘ভাইয়া, একটা ছবি তুলে দেন। এই যে উঠছি এত কষ্ট করে। ’ বিরক্ত হলেও না করলেন না ইশতিয়াক ভাই।

দুনিয়াজুড়ে ব্যাগপ্যাক ট্যুরিস্টদের একটা দাপট রয়েছে। পেছনে বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেন তারা। কোমর থেকে মাথার ওপর পর্যন্ত লম্বা ব্যাগ। এ ধরনের ব্যাগ নিয়ে যারা সিঁড়ি বাইছেন তাদের দেখে বেশ কষ্ট লাগছিল।
বাতু কেভসে বড় তিনটি গুহা, পাশে ছোট আরেকটি। যেন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে গুহাগুলোর ভেতরে।
মাঝামাঝি ওঠার পর থেকেই আশপাশে বাঁদরের বাদঁরামিও সহ্য করতে হচ্ছে। তবে বোঝা যায়, এখানে তাদের অবাধ বিচরণ। মানুষদের দেখে ভয় নয়, বরং আচরণে মনে হচ্ছিল, আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
একদম ওপরে ওঠার আগে হাতের বাম পাশে আরেকটি গুহা। বামে মোড় নিলাম। এটাকে বলে অন্ধকার গুহা।
এখানে পৃথিবীর বিরল সব মাকড়সারা বাসা বেঁধেছে। গুহায় পাথরের দেয়াল চুঁয়ে টিপ টিপ করে পানি পড়ছে, স্যাঁতস্যাতে। অন্ধকার গুহার ভেতরে তাকালে গা ছম ছম করে ওঠে। ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে বাদুঁড়ের ডানা ঝাপটানোর। অন্ধকারের কোলে প্রবেশ করতে হলে গুণতে হবে ১৫ রিঙ্গিত করে।
আবার সিঁড়ি ভেঙে সবচেয়ে বড় গুহার চত্বরে চলে এলাম আমরা। এটাকে বলা হয় মন্দির গুহা। এখানকার বাতাসে ধূপের গন্ধ। পাথরের ভিত্তির উপর রয়েছে আরও অনেক হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি।
অন্য দু’টি গুহার একটি আর্ট গ্যালারি গুহা, অন্যটি মিউজিয়াম গুহা। দু’টিতেই রয়েছে হিন্দু স্ট্যাচু ও চিত্রকর্ম। আবার রামায়ানা গুহাতে গিয়ে দেখা যায় ৫০ ফুট উচুঁ হনুমানের মূর্তি।
গুহাগুলোতে রয়েছে কিছু ছোট ছোট দোকান। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমরা। দু’জনে ডাবের পানি দিয়ে গলা ভেজালাম। মোট ৪০০ মিটার দীর্ঘ এ গুহাগুলো ১৮৯২ সালে আবিষ্কৃত হয়। বাতু কেভসের সামনে গুহায় প্রবেশ করার জন্য আছে সিঁড়ি।
বলা হয়, ৪০ কোটি বছরের পুরনো এ গুহাগুলো। এখানকার কিছু গুহায় আদিবাসী তেমুয়ান গোষ্ঠী বাস করতো। তেমুয়ানরা হচ্ছে পাহাড়ি আদিবাসী ওরাং অসলিদের জাতি। এরপর ১৮৬০ সালে চায়নিজ আশ্রয়ীরা এখানে সবজি চাষ করতো। পাহাড় আর বন এখানে মিশে রয়েছে একে অপরকে জড়িয়ে।
তবে গুহাগুলো বিখ্যাত হয়ে ওঠে আমেরিকান প্রকৃতিতিবিদ উইলিয়াম হর্নাদে ১৮৭৮ সালে আবিষ্কারের পর। ১৮৯০ সালে ভারতীয় ব্যবসায়ী কে থাম্বুসামী পিল্লাইয়ের উদ্যেগে গুহাগুলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার স্থান হয়ে ওঠে। তিনি গুহাগুলোর প্রবেশ দ্বারের ভেল আকৃতি দেখে উৎসাহ পেয়েছিলেন এবং মুরুগান দেবতাকে উৎসর্গ করেন। এই দেবতাকে ভারতীয়রা চেনেন কার্তিক নামে। গুহার মুখগুলো মুগ্ধ করে আমাদের। কোথাও কোথাও মনে হয়, পাথর যেন খসে পড়বে। শূলের মতো এসে পড়বে শরীরের ওপর।
পিল্লাই কুয়ালালামপুরে একই বছর শ্রী মহামারিয়াম্মান মন্দিরেরও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯২ সাল থেকে বাতুকেভস-এ তামিলদের থাইপুসাম উৎসব উদযাপিত হয়। এটা অনুষ্ঠিত হয় তামিল থাই মাসে, যেটা জানুয়ারির শেষ ভাগ ও ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগ নিয়ে।
উপরের এ গুহাগুলোর চত্বরে বাদঁরেরা আরও বেশি সাম্রাজ্য কায়েম করেছে। তবে মানুষকে ভয় দেখানো বা ক্ষতি করে না তারা। মাঝে মাঝে ভেংচি মেরে খাবার দিতে বলে। বাদাম বা কলা দিলেই আবার বন্ধু বোনে যায়।
কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে এবার নামার পালা। দীর্ঘ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমরা। অভিকর্ষের টানে নামলেও এসময়টায় আরেকটু সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে যখন দেখলাম সিঁড়ির কিছু ধাপে পড়ে রয়েছে কলার খোসা। এখানে পা ফসকালে শত ফুট নিচে পড়লে যে এ পৃথিবীর আলো শেষ হয়ে যাবে সেটা বাদঁরের বোঝার কথা নয়। আর বাদঁরকে মাথায় তুললে কি অবস্থায় হয় সেটার সাক্ষ্য রেখেছে তারা।
নামতেই দেখি মনি আপা দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়া দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি চলো। গরমে আমাদেরও জান যায় অবস্থা। দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠে এয়ার কুলারে নিজেদের ঠাণ্ডা করলাম। এরপর গন্তব্য গেন্টিং হাইল্যান্ড।
বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৩