দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য এবারের রোকেয়া দিবসে (৯ ডিসেম্বর) ‘বাঁশখালির শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ হওয়ার সম্মাননা জিতেছেন দিলারা আনোয়ার।
সরকারের মহিলা অধিদপ্তরের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষ প্রোগামের আওতায় এ সম্মাননা ও স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি।
শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের সোনালি দিনগুলো পেরিয়ে জীবনের অপরাহ্নে এসেও বাঁশখালিতে আলো ছড়াচ্ছেন দিলারা আনোয়ার। নিজের উচ্ছল ও সাফল্যমুখর দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়ে বাংলানিউজের কাছে বলেছেন সাবলীলভাবে। আলো ছড়ানোর সে গল্প শোনা যাক এবারে।
শৈশব থেকেই ভালো শিক্ষার্থী ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তেই হয়নি। প্রথম শ্রেণী থেকে এক লাফে তৃতীয়। ডাবল প্রমোশন। চতুর্থ শ্রেণীতে বৃত্তি। ষষ্ঠ শ্রেণীতেও বৃত্তি। তারপর আচমকা পড়াশোনা বন্ধ। আম্মুর যুক্তি, ‘অনেক হয়েছে। এবার ঠিকঠাক মত ঘর-কন্নাটা শেখো। মেয়েদের অতো পড়াশোনার দরকার নেই। ’
কিন্তু তিনি দমলেন না। স্কুলে তিনিই ছিলেন একমাত্র মেয়ে। দু-দু’বার বৃত্তি। এ প্রাপ্তিগুলো তাকে সাহস যোগালো। সে শক্তিতে দু’বছর পর আবার শিক্ষাজীবন শুরু করলেন দিলারা। ১৯৫৬ সালে প্রাইভেটে মেট্রিক দিলেন। ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম কলেজে। আর তখনই ঘটল জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটন। তাকে কলেজে ভর্তি করানোর অপরাধে গ্রামের মাতবররা বাবাকে সমাজচ্যুত করে। পুরো পরিবারকে এক ঘরে করে ফেলা হলো।
অবশ্য ষাট দশকের চিত্রটা এমনি ছিল। পড়াশোনা দূরে থাক। মেয়েদের বাড়ি থেকে বের হওয়াই পাপ ছিল। তার ওপর স্কুল-কলেজে আসা যাওয়ার পথে যুবক ছেলেদের উৎপাত-লোলুপ তো ছিলই। অবস্থা বেগতিক দেখে আপাতত হার মানলেন তিনি। বিয়েটা করে সংসার পাতলেন। সন্তান বড় হলো। তাদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে পড়াশোনার ‘ভূত’টা আবার ঘাড়ে চাপল। বার বার মনে বাজাতে লাগলেন, নেপোলিয়ানের সেই অমর উক্তি, ‘আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও। আমি তোমাকে একটা জাতি উপহার দেব’।
ওই ‘ভূত’র দাবড়ানিতে ছেলেদের সঙ্গে নিজেও পড়তে শুরু করলেন। অবশেষে মেট্রিক দেওয়ার ২৬ বছর পর পাস করলেন ইন্টারমেডিয়েট। তখন তার বয়স- ৪২ বছর! তারপর ৪৪-এ বি.এ, ৪৭-এ বি.এড ডিগ্রিও নিলেন। মজার বিষয় ছিল, তার বড় ছেলে যে বছর এস.এস. সি পাস করলো, তার কিছু দিন পরই তিনি আই.এ পাস করলেন। মা-ছেলের এক সঙ্গে পড়াশোনা, পরীক্ষা পাস দেখে লোকজনের তখন সে কী হাসাহাসি!’
তার জন্ম বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামে। ১৯৪১ সালে। অশিক্ষা-কুশিক্ষায় ওই গ্রামের অবস্থা তখন খুবই ভয়াবহ। বিশেষ করে মেয়েদের অবস্থান ছিল একেবারেই নাজুক। বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, অন্ধ পর্দা প্রথা, কথায় কথায় তালাক, পারিবারিক নির্যাতন, স্বামীদের নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। শৈশব থেকেই চলা-বলায় তিনি ছিলেন একটু অন্যরকম। মেয়েদের এই ক্রীতদাস দশা তাকে খুব ভাবাতো। বিচলিত করতো। মনে মনে উপায় খুঁজতেন। কিন্তু ঠিক খুঁজে পেতেন না। একদিন পেলেন। ১৯৮০ সাল তখন। গ্রামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাধনপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এলাকার প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। তা হলে কী হবে? ছাত্রী পাওয়া যাবে কোথায়? বিশেষ করে গোঁড়া মুসলিম পরিবারগুলো তো তাদের মেয়েকে কোনোভাবে স্কুলে পাঠাতে রাজী নয়।
মেয়েদের উৎসাহিত করতে নারী শিক্ষকও লাগবে। কিন্তু নারী শিক্ষক পাওয়া যাবে কই? দিলারা আনোয়ার বুঝলেন, এ-ই সুযোগ। এই ‘অবরোধবাসিনীদের’ ভাগ্য যদি পরিবর্তন করতে হয়, সবার আগে তাদের শিক্ষিত করা দরকার। তাই তিনি স্বেচ্ছায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিনা বেতনে শিক্ষকতার প্রস্তাব দিলেন। বললেন, ‘দায়িত্বটা আমি নিতে চাই’।
অচিরেই স্কুলটি চার শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো, আর তিনি নিলেন প্রথম ক্লাস। শুরু হল আরেক ‘বেগম রোকেয়া‘র সংগ্রামী জীবন। ক্লাস শেষে চলত ছাত্রী সংগ্রহ অভিযান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্ণা দেওয়া, অভিভাবকদের বোঝানো। বেতন দিতে রাজী না হলে বা অপারগ হলে, ওই দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেওয়া। তারপরও ছাত্রী চাই-ই চাই। এভাবে কষ্ট, ধের্য্য ও ত্যাগের ফলটা আসল ছয় বছরের পর। ১৯৮৬ সালে ১০ জন ছাত্রী স্কুল থেকে এস. এস. সি পাসের কৃতিত্ব দেখায়। ওই বছরই স্কুলটি প্রথম বারের মতো এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশ নেয়। আর ছাত্রীসংখ্যা? চারজন নিয়ে শুরু হলেও ওই সংখ্যা, আর এখন তা শতো শতো।
তখন দিলারা আনোয়ার ও তার সঙ্গীদের ডাকে অনেকে সাড়া দিলেও এলাকার হাজেম পাড়া ও জেলে পাড়া ছিল অসাড়, নিস্তেজ । আগের মতো সেই গণ্ডমূর্খ। তাদের আলোকিত করতে দুই পাড়ার নারীদের নিয়ে ১৯৮৬ সালে গঠন করেন ‘শহীদ স্মৃতি মহিলা সমিতি’। প্রথমে ছিল অক্ষরজ্ঞান দান, স্বাক্ষরতা অভিযান। পরে ধাপে ধাপে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুন্দর-শুদ্ধ আচার-ব্যবহার শিক্ষা, নারী-অধিকার আদায়, নারী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিচিত্র গঠনমূলক ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম। তন্মধ্যে ১৯৯০ সালে তালাকের প্রতিবাদে ৫০ জন মহিলা নিয়ে করা ঝাড়ু মিছিল এলাকায় ব্যাপক সাড়া জাগায়।
১৯৯৩ সালে সরকারি সহযোগিতায় যোগ হয় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এর আওতায় প্রতিবছর কমপক্ষে ২০-৩০ জন নারীকে জাল ও পাটি বুনন, বাঁশ বেতের কাজ, কাটিং, সেলাই, এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। এ পর্যন্ত আনুমানিক ৪০০ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সেলাইমেশিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিও দেয়া হয়েছে অনেককে। এছাড়া, প্রতিবছর ৩-৫ জন মহিলাকে দিয়ে পুকুরে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হয়। কিশোর-কিশোরীদের উন্নয়নের জন্য মায়েদের নিয়ে বৈঠক করা হয়।
শিশুদের মানস গঠন ও বিকাশের লক্ষ্যে ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ মেমোরিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুল’। ওই স্কুলে দীক্ষা নিচ্ছে একশরও অধিক কোমলমতি শিশু। এর সাফল্যও ঈর্ষণীয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন ছাত্র ক্যাবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তি পেয়েছে।
মানুষ আসে, মানুষ যায়। কেউ আসে পথিক হয়ে, আর কেউ আসে পথ নির্দেশক হয়ে। দিলারা আনোয়ার দ্বিতীয়দেরই একজন। দিলারাদের হাত ধরেই সৃষ্টি হয় নতুন সভ্যতা, নতুন ইতিহাস, ঘুরে সময়ের বাঁক। তাই কেবল বাঁশখালী নয়, বাংলার প্রতিটি জনপদে জন্মাক হাজারো দিলারা! দিলারাদের আলোয় আলোকিত হোক অন্ধকার পৃথিবী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর
ফিচার
দিলারা আনোয়ার: একজন জয়িতার গল্প
| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।