ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ঈশ্বরদীতে আবিষ্কৃত সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

আদনান আরিফ সালিম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:১১, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩
ঈশ্বরদীতে আবিষ্কৃত সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেসবুক বন্ধুদের অনেকেই সোমবার রাত থেকে ইনবক্সে একটি লিংক শেয়ার করে আসছেন। প্রত্যেকটি লিংকই জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর।

নিউজটি ছিলো ঈশ্বরদী এলাকায় সম্প্রতি প্রাপ্ত একটি স্থাপত্য নিদর্শন সম্পর্কে যাকে প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় আমরা চান্স বা ইনসিডেন্টার ডিসকভারি হিসেবে চিহ্নিত করি।

বাংলানিউজ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টের বরাত দিয়ে বলা হয়, ঈশ্বরদীর নিভৃত এক গ্রামে পুকুর খনন করতে গিয়ে মাটির ২৫ ফুট নিচে প্রাচীন একটি সুড়ঙ্গ পথ ও ইটের তৈরি বাড়ি সদৃশ্য স্থাপনার সন্ধান পাওয়া গেছে।

সোমবার সকালে উপজেলার লীকুণ্ডা ইউনিয়নের নুরুল্লাপুর গ্রামে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি জমিতে পুকুর খনন করার সময় এ প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে। আর এটি দেখার জন্য এলাকাবাসী ওই পুকুরপাড়ে ভিড় জমানোটা ছিলো স্বাভাবিক।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে গবেষণার কাজে যে কয়েকটি অঞ্চলে খনন বা জরিপে অংশ নিয়েছি প্রতি ক্ষেত্রেই আগ্রহী জনতার উপস্থিতি ছিলো লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নিদর্শন প্রাচীন হয়ে হয়ে যাবে। অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাচীন কথাটির পরিবর্তে বর্তমানে অতীত শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

দু’টি কারণে এ সংবাদটি নিয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। প্রথমত আমার বাড়ি ঈশ্বরদী অঞ্চলে ওই ঘটনাস্থল থেকে খুবই কাছে। দ্বিতীয়ত আমি শিক্ষাজীবন শেষ করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে আর বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো নিয়ে এখনো গবেষণা করে চলেছি।

ঈশ্বরদীর বাসিন্দা হিসেবে দেখেছি সেখানকার ধানক্ষেতগুলোতে পানি সেচ দেওয়ার জন্য কিংবা বাড়িঘর তৈরির ফাউন্ডেশন ট্রেঞ্চ হিসেবে গর্ত করা হয়। পদ্মার তীরবর্তী এ অঞ্চলে পুকুর খনন করার তেমন কোনো প্রবণতা মানুষের মধ্যে নেই। কারণ অপেক্ষাকৃত মোটা দানার মাটির এ অঞ্চলে পুকুরে পুরো বছর ধরে পানি থাকেনা। তবুও কিছু কিছু এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে শখের বশে পুকুর খনন করে থাকেন। হয়তো এমনি কোনো ঘটনা থেকেই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ বর্ণিত ঘটনাটির সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।

নিউজটি পড়ে এবং এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে যতোদূর জেনেছি ড্রেজার দিয়ে কয়েকদিন আগে ওই এলাকায় একটি পুকুর খননের কাজ শুরু হয়েছিলো। প্রায় ২৫ ফুট খনন করার পর কিছু দেখতে পুরাতন ইটের সন্ধান মেলে। এরপর মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে পাকা পাকা দালানের মোটা বিম ও চওড়া দেওয়ালের সন্ধান মেলে। বলতে গেলে যতো আগ্রহের সূচনা এখান থেকেই। এসময় বাড়ি সদৃশ্য স্থাপনা ও দেওয়ালের পাশেই একটি সুড়ঙ্গ পথের সন্ধানও পেয়েছেন শ্রমিকরা।

বাংলানিউজের সংবাদ অনুযায়ী সোমবার ওই সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করে ফিরেও এসেছেন এলাকার কয়েকজন যুবক। সুড়ঙ্গপথটি প্রায় ২০ ফুট যাওয়ার পর দু’দিকে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং ওই সুড়ঙ্গ পথের ২০ গজ দূরে ৪০ ফুট চওড়া চুন-সুরকি ও ইটের তৈরি একটি দেওয়াল আছে।

ঈশ্বরদী উপজেলার ঐতিহাসিক সমৃদ্ধি বলতে গেলে পাকশীতে হার্ডিঞ্জ রেলসেতু স্থাপনের সময় থেকেই শুরু বলা যেতে পারে। অন্যদিকে ষাঁঢ়ায় অবস্থিত নৌ-বন্দরের সঙ্গে এ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত ছিলো। ঔপনিবেশিক যুগে নির্মিত হয়েছিলো ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ রেলসেতু। ওই সময় পাকশী থেকে ধরা পড়তো প্রচুর ইলিশ। এ ইলিশ বিপনণ ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনে এ এলাকায় আরো অনেক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়। এক সময় ঈশ্বরদীতে তৈরি হয় বাংলাদেশের সব থেকে বড় রেল জংশন।

পাবনার অন্য উপজেলার মতো ঈশ্বরদীতেও গড়ে উঠেছিলো অনেকগুলো নীলকুঠি ও জমিবাদবাড়ি। বিশেষ করে পাকুড়িয়াতে একটি প্রাচীন জমিদারবাড়ির অস্তিত্ব ছিলো। আমার দাদার কাছেও জনৈক আজিমুদ্দি চৌধুরী, ফণিভূষণ মজুমদার ও অনন্ত মজুমদারদের নারকীয় অত্যাচার অপকর্মের বিবরণ পেয়েছি। তারা ওই সময়ে এখানে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। সম্প্রতি আবিষ্কৃত স্থাপনাটি ওই সময়ের হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি যার বয়স আনুমানিক ১৫০-২০০ বছরের কাছাকাছি।

নারায়নগঞ্জের পানাম, কুষ্টিয়ার রবীন্দ্রকুটিবাড়ি, মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদারবাড়ি এমনকি ঔপনিবেশিক যুগে নাটোর-পাবনা-কুষ্টিয়ায় গড়ে ওঠা স্থাপত্যগুলোর সঙ্গে এর মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। ঔপনিবেশিক সময়ের হলেও এ ভবনগুলো ছিলো অনেক চিত্তাকর্ষক। আর অনেক দিন মাটির নিচে চাপা পড়া নিদর্শন হিসেবে এর গুরুত্ব জনগণের কাছে বেড়ে গেছে। আর ওই সুড়ঙ্গ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সেটা নীলকুঠি সম্পর্কিত কোনো স্থাপনা হিসেবে ধরে নেয়াটাই শ্রেয়। এখন মানুষ ওই সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প ফাঁদতে পারে। কেউ মনে করবেন ওই সুড়ঙ্গের সঙ্গে কোনো অশরীরি আত্মার যোগসূত্র আছে, কেউবা ভাববেন সেখানে লুকোনো আছে রত্মভাণ্ডার, কেউবা বলবেন ওটা কোনো টর্চারসেল বা অন্ধকূপ।

ইত্যোকার নানা কথা শোনা গেলেও মূল ইতিহাস হচ্ছে এটা ঔপনিবেশিক সময়ে নির্মিত একটি স্থাপনা যা এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির প্রমাণ দেয়। তবে এটাকে হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন, রত্নভাণ্ডার কিংবা কোনো ভূত-প্রেত-অশরীরি সম্পর্কিত কিছু মনে করে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

ঈশ্বরদীর প্রাচীন সুড়ঙ্গ পথ পরিদর্শনে যাচ্ছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ দল


ঈশ্বরদীতে প্রাচীন সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান


লেখক: আদনান আরিফ সালিম, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক
aurnabmaas@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।