তার জন্যে আমি সাত ক্রোশ হেঁটেছি সেবার। পথে এত মৃত্যুঘন বাতাবিলেবুর বন! আর আফিমের চারা হাতে অজস্র ভিখিরি চলেছে চুপচাপ।
‘বাতাবিলেবুর বন কী কী বললো তোমাকে?’
কিছু শুনতে পাই নি, পতঙ্গদের রসিকতায় ভরপুর সেই বন। বাতাসে উড়ে উড়ে তারা কী কী সব এমব্রয়ডারি করছিল বিকেলের আলোয়। আর একটা বৃষ্টিভেজা আতাগাছের সঙ্গে জোর করে সঙ্গম করতে চাইছিল বুড়ো অজগর। আমি বললাম, ছাড়ো ওকে! অজগর তৎক্ষণাৎ একটা কাঁচা আতা চিবোতে চিবোতে বললো, ‘একদম চুপ, আমি জাতিস্মর!’
‘বিকেলের আলো কি তোমার অন্তর্দেশে পড়েছিল একটুখানি?’
স্বর্ণালোকিত মন গোপন মুহূর্ত থেকে আরও কোনো গোপনতায় টলতে টলতে চলেছে যেন। পাখিদের ভিড় ঠেলে যাওয়া যায় যদি, একটা লাল কূপ চোখে পড়বে, গোপন চিঠির ওপর সেইখানে আলো ফেলছে স্বয়ং বিকেল। সে-অনেক আগের কথা, বিকেল মানে তখন ছিল হারমোনিয়ামের পাশে বসা মেয়েটি, সবজান্তা এক বিড়ালের সঙ্গে কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে বেড়ানো, কিম্বা আকাশে মেঘেদের মূকাভিনয়।
‘গোপন চিঠিই কি তোমার লিরিক?’
আমি যাকে ওস্তাদ ভেবে এসেছি, তা ঐ ক্রুদ্ধ কাঠঠোকরা। কোথা থেকে এত ক্রোধ সে জড়ো করেছে মাথায়, গাছেরা জানে তাকে! কখনো ময়ূর, কখনো-বা এই রামকৃষ্ণমাঠের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি, মহাপয়ার ফুটে থাকে ঘন ঘাসের ভিতর। ঘুরে ফিরে আসি, ধুলোমাখা সাপ আশ্চর্য পঙ্ক্তির মতো পড়ে আছে, আমি দ্রুত টুকে নেই তাকে, পর্দা টেনে দেই তারপর, তারও অনেক পরে কেঁদে ওঠে গ্রামোফোন।
‘ময়ূর আর রামকৃষ্ণমাঠের মাঠের মাঝেও তো থাকতে পারে কোনো পথ?’
কিন্তু আমি নভোসন্ন্যাসী নই, ঐদিকে থাকে ঘুমে ঢুলু ঢুলু পথিক। তাকে দেখতে যাওয়া মানে একগাদা অভিমান নিয়ে ফিরে আসা। আর, তারামণ্ডল, তারাই-বা আমায় নিষ্কলঙ্ক ছেড়ে দেবে কেন? আমি ক্রমে অশ্লীল, র, দ্বিতীয়, আরও কোনো দ্বিতীয় খুঁজে ফিরেছি। ঘুমন্ত মুখ, ঘুমন্তের চুল-ঢাকা কোনো মুখ খুঁজে খুঁজে বাতিল শকটের মতো পড়ে থেকেছি জলপাইবাগানের পেছনে। সেখানে কেউ একজন এসে সারা দিনরাত আমার শরীরে পেঁচার চোখ আঁকতে থাকে।
‘কেন হররোজ দ্বিতীয়?’
বোঝো না? থাক ওসব। দেখো এই গয়নার বাক্স। আর ঐ কুমারী মাছ, ব্যথার ভিতরে যে অচেতন। অনেক উঁচুতে খুলে যাবে সেই অমোঘ জানালা, তোমায় দেখতে পাবো পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত, কিন্তু আমরা এই তীর্থের পথে কিভাবে জড়ো হলাম, আর এই পুড়ে যাওয়া গাছে যে বসে আছে লেজ-ঝোলা পাখি হয়ে, সে কি গোলাপসমাধি থেকে তাড়িয়ে দেয়া আত্মার শিক্ষক?
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩