ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

প্রতিকূল রাজনীতির কারণে পিছিয়ে হাতিয়া

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:২৬, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
প্রতিকূল রাজনীতির কারণে পিছিয়ে হাতিয়া

ওছখালী, হাতিয়া, নোয়াখালী থেকে: প্রতিকূলতার রাজনীতি পিছিয়ে রাখছে দ্বীপ হাতিয়াকে। বরাবরই সরকার গঠনকারী দলের বিপরীতে সাংসদ নির্বাচিত হন এখানে।

এর ফলে এলাকাবাসীর যত দাবিই থাকুক না কেন, সরকারের নিয়মিত উন্নয়ন কর্মক‍াণ্ডের বাইরে কোনো কাজ হয় না এখানে। নির্বাচন এলে ঘুরেফিরে আসে একই দাবি।

এলাকাবাসী বলছেন, নির্বাচন এলেই দাবি পূরণের আশ্বাস আসে প্রার্থীদের কাছ থেকে। নির্বাচনের পর কেউই সেকথা আর মনে রাখে না। নদী ভাঙন রোধ, ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, অভ্যন্তরীণ ও নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, হাতিয়া-সুবর্ণচর সীমানা বিরোধ নিস্পত্তি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ চরাঞ্চলের জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের দাবি বহু পুরনো। এইসব সমস্যার সামাধান না হওয়ায় এখানখার মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে।    
Upokul-bgUpokul-bg
সূত্র বলছে, হাতিয়ার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে নদীতে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। আর নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা বিপদের মুখে পড়ছে। জেলেরা এখনো জলদস্যুদের ভয়ে দিন কাটায়। বারবার অভিযানে এদের তৎপরতা কিছুটা কমলেও কিছুদিন পর তা আবার বেড়ে যায়। অথচ জলদস্যু দমন এলাকাবাসীর প্রধান দাবিগুলোর অন্যতম।

হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নলচিরা পর্যন্ত মেঘনা নদী পারাপারের সমস্যা যুগ-যুগের। এ পথে সী-ট্রাক থাকলেও তা নিয়মিত চলে না। সী-ট্রাকের ইজারাদারদের কাছে জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। সী-ট্রাক চলে ইজারাদারদের ইচ্ছায়। এছাড়া প্রাকৃতিক সমস্যা তো আছেই। জোয়ার-ভাটা ও নদী উত্তাল থাকা না থাকার ওপর নির্ভর করে চলে এ যানবাহন।

হাতিয়ায় যাতায়াতে ভরসা ট্রলার। এই ট্রলারগুলোতে যাত্রী পরিবহনের কোনো ফিটনেস কিংবা অনুমতি নেই। যাত্রী বহনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। সমুদ্রে মাছধরার বড় ট্রলারগুলো যাত্রী আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন এসব ট্রলারে যাতায়াত করতে গিয়ে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত অন্তত দুই হাজারের বেশি যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটেছে। প্রভাবশালীরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই এই তৎপরতা চলে আসছে।
Upokul-22
এলাকাবাসীর অভিযোগ, নির্বাচনের আগে সব প্রার্থীই এলাকার মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন শত শত যাত্রী এই বিপদ সঙ্কুল পথে যাতায়াত করে। বর্ষাকালে এই ঝুঁকি অতিমাত্রায় বেড়ে যায়।

রাজধানী ঢাকা থেকে হাতিয়ার তমরুদ্দির সঙ্গে সরাসরি লঞ্চ যোগাযোগ রয়েছে। লঞ্চ ঘাটে কোনো পল্টুন নেই। ঘাট এলাকায় যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না।

অন্যদিকে, হাতিয়ার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই খারাপ। নলচিরা ঘাট থেকে হাতিয়া উপজেলা সদর ওছখালী বাজার পর্যন্ত মাত্র দশ কিলোমিটার পথ যাতায়াতেই সেটা অনুমান করা যায়। পাকা রাস্তার পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি, উন্নয়ন হয়নি কাঁচা রাস্তার। নিঝুম দ্বীপ পায়নি পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদাও।

অথচ নির্বাচনের আগে এলাকাবাসী এই দাবিগুলোই উত্থাপন করেন বারবার, আর প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আয়শা আলী জাহাজমারা এলাকায় পথসভায় বলেন, হাতিয়া হবে স্বপ্নের দ্বীপ। এলাকাবাসীর কোনো সমস্যা থাকবে না। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটবে। এলাকার মানুষ নির্বিঘ্নে নৌপথে যাতায়াত করতে পারবে।

তাই নির্বাচিত করার জন্য এলাকাবাসীর কাছে ভোট চান তিনি।

নলচিরার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফজলুল হক বলেন, নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা ভোটের জন্য নানা কথা বলেন। ভোটের পরে তাদের সেকথা আর মনে থাকে না। একই সমস্যায় যুগ যুগ ধরে ভুগছি। অথচ সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছে না।

তমরুদ্দি বাজারের আলী হোসেন বলেন, সরকারের সঙ্গে আমরা যেন তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। সরকার গঠনকারী দলের বিপরীত দল এখানে নির্বাচিত হন। ফলে এলাকার অনেক সমস্যার সমাধান হয় না। আবারও ভোট এসেছে। আমরা শুনবো নানা কথা। নির্বাচনের পর হয়তো আর কারও দেখা মিলবে না।    

২০০৮ সালের নির্বাচনে নোয়াখালীর (৬) এই আসন থেকে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম। বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরে এলাকায় অনেক বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু মাঠে কাজ তেমন হয়নি। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি হাতিয়ার নেতা মোহাম্মদ আলী ও জেলা সাধারণ সম্পাদক আকরামুল কবির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে এলাকায় কাজ করেছেন নিজের মত করে।
Upokul-12
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ আসনের সাংসদ ছিলেন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ আলী। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক ওয়ালিউল্লাহ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিমকে পরাজিত করেন। এ সময় এলাকায় বিশেষ কোনো কাজ হয়নি। তবে রাজনৈতিক সংঘাত ছিল।       

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও এ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম। আওয়ামী লীগের অধ্যাপক ওয়ালিউল্লাহ ও জাপার মোহাম্মদ আলীকে পেছনে ফেলে নির্বাচিত হলেও নির্বাচিত সাংসদ কোনো কাজই করতে পারেননি।

১৯৯১ সালে সরকারে ছিল বিএনপি, আর হাতিয়া থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অধ্যাপক ওয়ালিউল্লাহ। এ সময়েও নিয়মিত কাজ ছাড়া হাতিয়ায় কোনো উন্নয়ন হয়নি।

স্থানীয় ভোটাররা বলেন, হাতিয়ার কিছু উন্নয়ন হয়েছে এরশাদ সরকারের আমলে। মূলত এ সময়কালেই পুনর্গঠিত হয় হাতিয়া। সরকারি কলেজ হয়, হাসপাতাল হয়, পাকা রাস্তা হয়। ওই সময় সরকারের অনুকূলে ছিলেন স্থানীয় সাংসদ মোহাম্মদ আলী। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে এ আসনে নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আয়েশা আলী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আমীরুল ইসলাম আমীর। বিগত নির্বাচনে মাত্র ২৭ শ’ ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন এবারের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী এবারই প্রথমবারের মতো নির্বাচন করছেন।

হাতিয়ার উন্নয়ন হচ্ছে না, ভোটারদের এমন অভিযোগ স্বীকার করেননি সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দ্বীপ হাতিয়ায় কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময়েও এখানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।  
 
উল্লেখ্য, এগারোটি ইউনিয়ন আর একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। আর লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। হরনী, চানন্দী, সুখচর, নলচিরা, চর ঈশ্বর, চর কিং, তমরুদ্দি, সোনাদিয়া, বুড়িরচর, জাহাজমারা ও নিঝুম দ্বীপ এবং হাতিয়া পৌরসভা এই আসনের আওতায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
সম্পদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।