মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। গহীন জঙ্গলে যেন এক ভৌতিক অবস্থা, গাছগুলোর মধ্যকার ফাঁক দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার।
আমরা তখন মাটি থেকে হাজার মিটার ওপরে ক্যাবল কারে। এখন দেশে বসেও চোখ বন্ধ করলে যেন মনে করতে পারি, এটা যেন ঠিক স্বর্গ ছিল। টিপটিপ বৃষ্টি আমাদের কারটিকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।

একটি কারে আমরা তিনজন। বাংলানিউজের চিফ অব করেসপন্ডেন্ট ইশতিয়াক ভাই, একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালক মনি আপা আর আমি। ছোট কারের ভেতর খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজেদের ছবি তুলতে। তারপরও ম্যানেজ করা। আবার ক্যাবল কারে ছবি তোলার সময় যেন পেছনের আরেকটা কার দেখা যায়, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়। অন্যদিক থেকে একটা কার আসছে, এ সময় হয়তো ইশতিয়াক ভাই বলছে, ‘এবার ক্লিক করো নয়ন’। যেন পেছনের পার হয়ে যাওয়া কারটার ছবিও আসে।
পথ অনেক দীর্ঘ। এটা এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যাবল কারের সংযোগ। তাই হাতে সময়ও অনেক। এরপর চারপাশে চোখ বড় বড় করে তাকানো শুধু। যতটুকু পারা যায়, চোখ আর হৃদয় দিয়ে গিলে নেওয়া।
মেঘের ওপরে মেঘ। তুলার মতো বলা যাবে না, সেদিন মেঘমালা একটু দুঃখ ভারাক্রান্তই ছিল বরং। যতই উপরে উঠছি কানের ভেতরটা যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, বুঝলাম অভিকর্ষজ ত্বরনকে ঠেলে ওঠায় এ অবস্থা। মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ক্যাব, আবার হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের ভেতরে। আমরাও এ সারিতে।

প্রায় আধঘণ্টার পথ পারি দিয়ে পৌঁছালাম গেন্টিংয়ে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এটা আঠারশ’ মিটার ওপরে। ক্যাবল কার থেকে নেমে মনে হলো, যেন এক উজ্জ্বল ঝলমলে জগৎ। যেন হিমালয়ের কোনো দেশে এসে পৌঁছেছি। গেন্টিংকে মালয়েশিয়ার মন্টিকার্লো বলা হয়। সমুদ্র সমতল থেকে আঠারশ’ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এ মেঘের রাজ্য।
আমরা বাতু কেভস থেকে যখন গেন্টিং রওনা দিয়েছিলাম তখন কটকটা রোদ। কিন্তু যখন থেকেই শুরু হলো পিচঢালা পাহাড়ি পথ, তখন থেকেই মেঘলা ছিল আকাশ। পাহাড়ি পথ বেয়ে বাস আস্তে আস্তে এঁকে বেঁকে উপরে উঠছিল। উপরে মেঘের কাছাকাছি বৃষ্টিও হচ্ছিল, অল্প অল্প ঠাণ্ডা লাগছিল, নির্মল প্রকৃতি আমার মনকে টানছিল।
এখানে রয়েছে চকলেটের ফ্যাক্টরি। বিখ্যাতসব চকলেট তৈরি হয় এখানে। তামিল চালক জিজ্ঞাসা করলো, চকলেট ফ্যাক্টরি ঘুরবো কিনা? আমাদের সময় নিয়ে চিন্তা মাথায়। মনি আপা তখন তাড়া দিচ্ছিলেন, তাড়াতাড়ি ঘোরা শেষ করে বিজনেস সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

গেন্টিং ট্যাক্সি স্টপেজে আসার পর ক্যাবল কারে করে শৈলশিখরে যাওয়ার জন্য টিকেট কিনে দিতে সাহায্য করলো চালক। আসা যাওয়া মিলিয়ে তিনজনের ৩৬ রিঙ্গিতের খরচ। এখানকার চারপাশে চোখ ঘুরলে মনে হবে চকলেটের এক রাজ্য। ক্যাবল কারে ওঠার লেন পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আমাদেরকে দোতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো চালক। মাত্র আড়াইশো রিংগিতে, যেচে পড়ে চালকের এ সাহায্যকে কিন্তু আমরা বেশ তদন্ত সাপেক্ষে নিলাম। যাক পথ বাড়ালাম।
ক্যাবল কারে ওঠার সময়ই এখানকার ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলে দেয়। আবার ফেরার সময় চাইলে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সেটি প্রিন্ট করে দেবে। ছয় জনের জায়গা থাকলেও, আমরা তিনজন মিলেই দখল করলাম একটা ক্যাবল কার।
আধঘণ্টা পর যখন ক্যাবল কার থেকে নেমে শৈল শিখরে, যেন এক স্বপ্নের দেশ। চারিদিকে আলো ঝলমলে। হাঁটতে শুরু করলাম। বুঝলাম কেন এখানে পৃথিবীর বিখ্যাত সব জুয়াড়িরা এসে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। এটাকে ক্যাসিনোর জগৎ বলতেই হবে। ক্যাসিনোতে ঢুকতে হলে টাই কিংবা বাটিকের শার্ট পরতে হয়। পাশেই বাটিকের শার্ট ভাড়া পাওয়া যায়। নির্ধারিত ফি দিয়ে শার্ট ভাড়া করে ভেতরে যাওয়া যায়। এ এক বিশাল ব্যাপার। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন রকমের আয়োজন। অনেকে ক্যাসিনোর বাহিরে বসে ঝিমুচ্ছে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হয়তো আবার ক্যাসিনোতে ঢুকবে। কেন যেন মনে হচ্ছিল এটা একটা বেশ ভালো ব্যবস্থা। ভাগ্য আমার কখনোই সহায়ক নয়, আর ইশতিয়াক ভাইয়ের নেপালে ক্যাসিনোতে প্রবেশ করে জামানত হারানোর অভিজ্ঞতা আমাদের সায় দিলো না ক্যাসিনোতে প্রবেশের।

গেন্টিংয়ের জগৎ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে। সব বয়সের মানুষের জন্য সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এখানকার কাপড়ের দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে শীতবস্ত্র। আমরা তখনো টার্মিনালে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকায় ঠাণ্ডার ভাব নেই। এখানে অনেক মানুষের মেলা। এ কারণে পাহাং আর সেলানগর প্রদেশের সীমানায় অবস্থিত এ স্থানটিকে বলে ‘মেঘের ভেতর মজার শহর। ’
এখানে আছে হোটেল, ক্যাসিনো, দোকানপাট, ভিডিও গেম ও অন্যান্য নানা রকম খেলাধুলা ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। শহরে যাওয়ার পথে আসলাম। মেঘের উপরে এতো সুন্দর শহর যেনো অন্য একটা জগৎ। এতোক্ষণে বুঝলাম শীতবস্ত্রের কারণ, ঠাণ্ডায় হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা আমাদের। ঘণ্টাখানেক আগে বাতু কেভসের কটকটা রোদ তখন স্মৃতি।

এলাকাটা একটু ঘুরে দেখলাম। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েই কিছু ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ পর পর মেঘ এসে ঘিরে ফেলছিল আমাদের। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল। মেঘে ঢাকা পড়েছে বড় বড় বিল্ডিংগুলো। চারিদিকের সবুজ পাহাড়গুলো আমাদের থেকে নীচে। পাহাড়ের এক পাশে ঘন কালো মেঘের অন্ধকার। দূরে দেখা যায় রোদের রেখা। রোদের মাঝেই হঠাৎ বৃষ্টি। এ যেন এক মেঘের রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন আকাশের উপর বসে থেকে আমরা দেশটাকে দেখছি।
শহরের লেকে রয়েছে বোটে ভ্রমণের ব্যাবস্থা। ট্রেন ভ্রমণ, কর্ক স্ক্র, গ্রান্ড প্রিক্স গোকার্ট ও বাচ্চাদের নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা। গেন্টিং থিমপার্কে রোলার কোস্টার সহ নানা ধরনের রাইড রয়েছে। থিম পার্কে ঢোকার জন্য জনপ্রতি ৫০ রিঙ্গিত মূল্যের টিকিট লাগে।
শহরে মেঘগুলো হাতের উপর দিয়ে উড়ছিল। চারিদিকের পাহাড় ও বন, নিস্তব্ধ প্রকৃতি, অনেক মানুষের কোলাহলও নিস্তব্ধতা ম্লান করতে পারছিল না। সবার জন্যই যেন ব্যক্তিগত সময় সুযোগ এখানে রয়েছে। এটা এক বিশাল স্থাপনা।

একজন মানুষকে অনায়াসে ব্যস্ত সময় থেকে গেন্টিং দূরে ছুড়ে দিতে পারে। ভুলিয়ে দিতে পারে ব্যস্ততা।
এবার ফেরার পালা। যথানিয়মে ক্যাবল কারে চড়লাম নীচের স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এবার আমাদের ক্যাবে চড়লো চায়নিজ এক ভদ্রলোক। এখানকার বাসিন্দা তিনি। দৈনন্দিন কাজেই নীচের স্টেশনে যাচ্ছেন তিনি। ফেরার সময় বৃষ্টি কেটে যাচ্ছে, এখন একটু একটু রোদ। এ যেন এক নতুন পৃথিবী। এখানে যেমন রয়েছে কৃত্রিম আনন্দ তেমনি রয়েছে অনাবিল প্রকৃতি, সব যেন মিলে মিশে এক হয়ে জীবনকে জাগিয়ে তোলে ।
নিচে এখন বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটাও দেখা যাচ্চে। নির্জন, নিরিবিলি, কেন যেন ভূতুরে!

ট্যাক্সি চালক আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এখানেও সুন্দর করে সব সাজানো গোছানো। পেটের ক্ষিধে তখন মাথায় উঠে গেছে। এতোক্ষণ মনে হয়নি। ক্যাব রওনা করে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে। পেছন থেকে গেন্টিং আমাদের হাতছানি দেয়। আকাঁবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছিল। পাহাড় থেকে নিচে নামছিলাম আমরা...
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর