ঢাকা, শুক্রবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২২ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে শীতের ছোঁয়া

আবু আজাদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬:২৩, জানুয়ারি ২, ২০১৪
জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে শীতের ছোঁয়া

বৃক্ষের পদতলে জীর্ণ পত্রের অশেষ উৎসব/বাতাসে কিসের গন্ধ/কাদের সংগীত/একদিন ঘুম ভেঙে দেখি/এসে গেছে শীত।

হ্যাঁ, প্রকৃতিতে সত্যিই শীত এসে গেছে।

তবে কবির কল্পনার মতো এতো সহজেই শীত আসেনি। সময়ের পরিক্রমায় শীত এসেছে  চার ঋতু অর্থাৎ আট মাসের বিরতির পর।

প্রবাদ রয়েছে ‘ঊন বর্ষায় দুনো শীত’ অর্থাৎ যে বছর বর্ষা কম হয়, সে বছর শীতের প্রকোপ বেশি হয়। একথা বলার কারণ, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসেব মতে অন্যবারের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশে বৃষ্টির পরিমাণ ২৬ শতাংশ কম হয়েছে। সে হিসেবে এবার শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ার কথা।

এবার শীতও এসেছে অন্যবারের চেয়ে খানিকটা আগেই। ছোট বেলায় ‘শীতের সকাল’ রচনার মতো দিগন্ত জোড়া মাঠের প্রান্তে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে নয়, ইট-কাঠ ঘেরা শহরে অলিগলিতে শীত নামে কর্মব্যস্ত মানুষের পদচারণায়। শহরে এখনো শীতের তীব্রতা ততটা নয়, তবে জাহাঙ্গীরনগরের বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন। শীত এখানে বেশ ভালোই পড়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি এখানকার অধিবাসীদের অকৃত্রিম ভালোবাসা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক গ্রামে পরিণত করেছে। তাই জাহাঙ্গীরনগরে শীতের আগমন কোনোভাবেই গ্রাম থেকে আলাদা নয়। যারা শহরের মধ্যেও গ্রামের শীতের আমেজ পেতে চান তারা ঘুরে যেতে পারেন জাহাঙ্গীরনগর থেকে।

সবুজের নৈস্যর্গিক সমারোহ ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত আসে চিরচেনা রূপের বাইরে আরও কিছু মুগ্ধতা নিয়ে। আসে অনবদ্য কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এবারো সারাদেশের মতোই জাবিতেও শীত এসেছে আগেভাগেই। তবে তাতে ক্যাম্পাসে শীতের যে বর্ণিল রূপ তাতে একটুও ছেদ পড়েনি।

জাবিতে শীত মানেই জাঁকালো। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি পায়ে শীত আসার শুরুতেই আসতে শুরু করেছে শীতের পাখিরা। সাইবেরিয়ার তীব্র শীত থেকে বাঁচতে প্রতিবছর অতিথি পাখির আসর বসে এখানে। আর লেকগুলোও যেন পাখিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিলো আগে থেকেই। লাল শাপলা হাসিমুখে স্বাগত জানিয়েছে এই অতিথি পাখিদের। সকালে ফুটন্ত শাপলাগুলোতে পাখিদের ল‍ুকোচুরি সে এক অভিভূত করার মতো দৃশ্য। শুধু তাই নয় শীতে এখানকার ছাত্র-শিক্ষকের সকালের ঘুম ভাঙে অতিথি পাখির কলোবরে। ভাবা যায়! 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’র পেছনের লেক, জাহানারা ইমাম এবং রেজিস্ট্রার ভবন সংলগ্ন লেকে এসেছে অন্তত কয়েক হাজার অতিথি পাখি। উপযুক্ত পরিবেশ আর নিরাপদ আশ্রয়ে এসব অতিথি পাখি এখানে নির্ভাবনায় মেতে থাকতে পারছে কলকাকলি ও জলকেলিতে। কেউ আবার ডুব সাঁতারে ব্যস্ত। কখনও কখনও চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসের মুক্ত আকাশে। কখনওবা এসব পাখি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে খাবার জোগাড় করতে। তাদের এ কার্যকলাপ দেখতে এবং ক্যামেরাবন্দি করতে ক্যাম্পাসের অধিবাসীরা ছাড়াও প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য পাখিপ্রেমী পর্যটকের সমাগম ঘটছে। আসছেন বিদেশি দর্শনার্থীরাও।

শীতের অতিথি পাখির কথা বলতে  গিয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭ তম ব্যাচের (মাস্টার্সের) শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজোহরা খালেক মিলা বলেন, পাখির প্রতি ভালবাসা ও ক্যাম্পাসবাসীর সচেতনতায় জাবি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে বলেই প্রতিবছর জাবিতে অতিথি পাখি আগমনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ চেতনা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

আর এই পাখিদের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানাতেই প্রতিবছর আয়োজন করা হয় পাখিমেলার। পাখি মেলা শুধু অতিথি পাখিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়েই নয় সে সঙ্গে অতিথি পাখি সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়াও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

শুধু পাখি মেলা নয় প্রতিবছর এ সময়ে আয়োজন করা হয় প্রজাপতি মেলারও। এইতো সেদিন জাবিতে হয়ে গেলো প্রাজাপতি মেলা।

শুধ‍ু পাখি আর প্রজাপতি নয় জাবির লেকগুলোতে যেনো ফুলের মেল‍া বসেছে। জেনারেটরের লেকে কচুরীপানার সাথে ফুটেছে সাদা ও লাল শাপলা যা দেখলে যে কারও মনে পড়বে শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোর কথা, যখন মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বকুনির ভয়কে উপেক্ষা করে খালে-বিলে কলার ভেলা, তালের ডোঙা অথবা ছোট্ট নৌকায় চেপে শাপলা বা কচুরিপানা ফুল তোলার স্মৃতি!

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সংলগ্ন ছোট্ট গর্তটিতে ফুটেছে সাত প্রকারের শাপলার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মোহনীয় ও সুগন্ধযুক্ত বেগুনি শাপলা!

বেগুনি শাপলার সুগন্ধে যে আবেগ আর সম্মোহনী শক্তি রয়েছে তা কেবল বেগুনি শাপলার সংস্পর্শে আসা মানুষই জানেন, আর তাকে বুকের ভেতর পুষে রাখেন জনম জনম- বেগুনি শাপলা সম্পর্কে কথাগুলো বলছিলেন নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আফরিন সুলতানা আশা।

শুধু শাপলাই নয় জাবির লেকগুলোতে ফুটে রয়েছে অসংখ্য কচুরিপানা ফুল। বিশ্ববিদ্যারয়ের ছোট বড় প্রায় ১০টারও বেশি লেক রয়েছে। প্রতিটি লেকে লেকে শাপলা আর কচুরিপানা ফুলে একাকার আর এর মাঝে মাঝে পাখিদের লুকোচুরি।   

সকালের শিশির ভেজা সাদা-হলুদ আর বেগুনি রঙে একাকার হয়ে যাওয়া কচুরীপানা ফুল সম্পর্কে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী আরিফ বলেন, এটা আমার মতো সাধারণ ছেলের মাথায় আসবে না। নজরুল ব্যাতীত সে চেষ্টা কেবলই অমূলক !

শীত যে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে গোধূলীর সোনালী সূর্য অস্ত না যেতেই মাঝারি কুয়াশার চাদরে আকড়ে ধরা প্রকৃতির দিতে তাকিয়ে। হিমেল বাতাসে হাড়ে কাঁপন ধরানো অনুভূতি ক্যাম্পাসবাসীর গায়ে এখনই জড়িয়ে দিয়েছে শীতের গরম কাপড়। তবে মজার ব্যাপর হলো এক্ষেত্রে বয়ষ্কদের চেয়ে ফ্যাশন সচেতন তরুণেরাই বেশি এগিয়ে। কেননা শীতকে শুধু প্রতিরক্ষাই নয় বরং শীতের কাপড়কে কি করে আরো ফ্যাশনেবল করে তোলা যায় সে চেষ্টার অন্ত নেই।

জাবিতে শীতের আরেক বড় আকর্ষণ ক্যাম্পাসের পিঠার দোকানগুলো। শীতের পিঠা-পুলির আয়োজনেও পিছিয়ে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিঠার দোকানীরা। দুপুরের পর থেকেই রাত পর্যন্ত এসব দোকানে চলে শীতের নানা রকম পিঠা তৈরি। সারাক্ষণ এসব দোকানে ভিড় লেগেই থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, পরিবহন চত্বর, বঙ্গবন্ধু হল চত্বর, মীর মশাররফ হোসেন হল, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হলের মাঝখানের স্বপ্ন চত্বরসহ পিঠার জন্য বিশেষ ভাবে গড়ে ওঠা মেডিকেল সংগলগ্ন পিঠা চত্বরে শীতের পিঠা তৈরি ও খাওয়ার ভিড় এতটাই যে, পিঠা পেতে গেলে অর্ডার দিয়ে রীতিমতো আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। শুধু ক্যাম্পাসের অধিবাসীরাই নয়, এই পিঠার টানে ছুটে আসেন সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকার আশপাশের অঞ্চলের মানুষজন।

জাবিতে শীতের পিঠা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হানিফ ইলা বলেন, আমরা যারা পরিবারকে রেখে জাবিতে পড়ে আছি তাদের শীতের পিঠা বলতে তো পিঠা চত্বরের খালাদের দোকানের পিঠা।     

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বটতলার খাবার মুখে না দিয়ে চলে যান এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বটতলার বাহারী খাবারে প্রতাপের সাথে স্থান করে নিয়েছে ঢেড়স, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, বরবটি, টমেটো ,লাউ, শিম পালং ইত্যাদি শীতের শাক-সবজি। এছাড়া শীতের বিভিন্ন ফল যেমন জলপাই, চালতা , সফেদা , তেঁতুলও পাওয়া যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়েল সবজির বাজারে।  

খেজুরের রস ছাড়া শীতকে যেন কল্পনাই করা যায় না। ক্যাম্পাসে খেঁজুর গাছ থাকলেও তা থেকে রস বের করার ও মতো কেউ নেই। তাই বলে খেঁজুরের রস থেকে বঞ্চিত নয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গ্রামগুলো থেকে সংগৃহীত টাটকা খেঁজুরের রস পাওয়া যায় পরিবহন চত্বরে খুব সকালে, যা শীতের আমেজকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে!

জাবিতে শীত মানেই সাংস্কৃতিক উৎসবের ধুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, আনন্দন, ধ্বনি, গীতনাট, জুডো, জাডস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর টানা দুই মাস সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ ক্যাম্পাসবাসীকে শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। যে জন্য ক্যাম্পাসসহ আশেপাশের মানুষ একটি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছে।

আবু আজাদ
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, জানুয়রি ০২, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।