ঢাকা: সুফিয়া খাতুন। বয়স প্রায় ৭০।
ছোটবেলায় গরিব বাবার সংসার ছেড়ে স্বামীর সংসারে আসেন সুখের আশায়। সুখও ছিলো। জীবনের নায়ে কোল জুড়ে এসেছিলো একমাত্র মেয়ে রোজিনা খাতুন।
জীবন নৌকায় শুরু হয় যুদ্ধ। ভালো ঘরে বিয়ে রোজিনার। এবার হয়তো জীবন দুঃখ ঘুঁচবে তার। না এবারো হলো না। রোজিনার স্বামী সংসারে নিয়ে এলো সতীন। এরই মধ্যে চার সন্তানের জননী হন রোজিনা। শেষ পর্যন্ত স্বামীর যন্ত্রণা সইতে না পেরে মায়ের ঘরেই ফিরে আসেন। ভাঙলো মেয়ের সংসার। সুখ সহ্য হলো না সুফিয়ার।
আবারো উত্তাল সাগরের চুতুর্ঘূর্ণিতে পড়ল সুফিখাতুনের নাও। তামাক তুলে সুফিয়া খাতুনের মজুরি দিনে ১২০ টাকা। কিন্তু এ টাকায় ছয়টি মুখে খাবার যোগানো সম্ভব নয়।

সুফিয়া খাতুন বলেন, মাগো দিনে আমার কামাই ১২০ টাকা। হেও পাতা কম তুলতে পারলে টাকা কাটে। এই ট্যাকায় কী আর চলে। তাই মাইয়া আমার ডাহা আইছিলো কাম করতে।
ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজ নেন রোজিনা। দিন যেন ফিরতে শুরু করে সুফিয়ার সংসারের। মাস শেষেই টাকা পাঠায় মেয়ে। সংসার চলছিলো ভালোই। এরই মধ্যে বিয়ে হয় বড় নাতনি কেয়ার।
মেঝো নাততি রিয়া ও নাতি রবিনকে ভর্তি করেন ভেড়ামারা স্কুলে। ছোট নাতি রুমুও বড় হচ্ছে। তাদের চোখে অনেক স্বপ্ন। নানী সুফিয়ারও স্বপ্ন কম নয়।
কিন্তু রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে সঙ্গে ধসে গেলো সুফিয়া খাতুনের স্বপ্নও। সংসার নায়ের মাস্তুল ভেঙে আবারো দিশেহারা মাঝির মতো আকূল পাথারে পড়লেন সুফিয়া।
মেয়ে রোজিনা যে নেই। কী হবে এখন! কী করে দু’বেলা খাবার জুটবে পাঁচটি মুখের। না আর কিছুতেই দিশা খুঁজে পান না সুফিয়া।
স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে গার্মেন্টেসের কাজে পাঠানো হলো মেঝো নাতনি রিয়াকে। কিন্তু ওইটুকুন মেয়ে কী করে গার্মেন্টসের কাজ করবে তাই যেন ভেবে পান না সুফিয়া।
‘মাইয়োরে ওইটুকুন মাইয়ে আমারে ছাড়া ঘুমাইতে পারে না। আর আইজ এই দিন খোদা ক্যান দেহাইলো..’ কান্নায় ভেঙে পড়েন সুফিয়া।
রানা প্লাজা ধসে রোজিনার মৃত্যুর পর এক টাকাও সাহায্য পাননি সুফিয়া বেগম ও তার নাতি-নাতনিরা।
নাতি রবিন পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। লেখাপড়া প্রায় বন্ধের পথেই ছিলো। কিন্তু ‘দি অপটিমিটস’ নামে একটি এনজিওর সহায়তায় তা চালু রয়েছে কোনো মতে।
দৈনিক ১২০ টাকা আয় দিয়ে কীভাবে ছোট দুই নাতিকে মানুষ করবেন সুফিয়া! তাই ভেবে দিন যায়। ভাবনার আর শেষ হয় না।
বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন সুফিয়া খাতুন ও তার মৃত মেয়ে রোজিনার ছেলেমেয়েরা।
এই মাঝি কি শেষ পর্যন্ত পারবেন ধরে রাখতে ভাঙা নায়ের হাল! পারবেন কী জীবন নদী পার করাতে এই অবুঝ শিশুদের! নানা ভাবনায় জীবন ওষ্ঠাগত সুফিয়া খাতুনের।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
সম্পাদনা: জাকারিয়া খান, নিউজরুম এডিটর/এএ