ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ব্যাডমিন্টনের মতো অতি পরিচিত একটি খেলা ককফাইট বা মোরগ লড়াই। মোরগ লড়াই নামে সবাই চিনলেও এর আসল নাম ‘আসিল মোরগ লড়াই’।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় ভারত থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইলের দেওয়ান বংশ এই আসিল মোরগ নিয়ে আসেন। আগেরকার দিনের রাজা-বাদশার এটিকে পুষতেন বলে একে রাজকীয় মোরগও বলা হয়।

শোনা যায়, টিপু সুলতান, সম্রাট আকবরসহ অনেক রাজা এই মোরগগুলো শখ করে পুষতেন। এদের লড়াই দেখাটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে নিতেন।
তবে, এখন এই খেলাটি বাংলাদেশে তেমন দেখা না গেলেও তুরস্কের জাতীয় খেলা কিন্তু এই মোরগ লড়াই। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, জাপানেও এই খেলার প্রচলন রয়েছে।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এখন থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে পুরান ঢাকার ইউসুফ পালোয়ান, তাহের মিস্ত্রি ও নায়ক জাবেদ ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি ক্লাব করে এই খেলার অস্তিত্ব ধরে রাখেন।
তবে, ধীরে ধীরে এখন অনেক ক্লাব গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ শৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, আরসিডি মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ রয়েল আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মোরগ উন্নয়ন সংস্থাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ক্লাব রয়েছে।

বর্তমানে ঢাকার সব ক্লাবগুলোকে এক করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ঢাকা ইউনাইটেড আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা’। ক্লাবটির বর্তমান সভাপতি নাসির বিন জামাল।
কথা হচ্ছিল ক্লাবটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণ মোরগ থেকে আসিল মোরগের পা, গলা, মাথা, বুক ও উচ্চতাসহ শারীরিক গঠন অনেক শক্তিশালী, যা লড়াই করার জন্য উপযুক্ত।
এই মোরগগুলোর খাবাবের প্রসঙ্গ আনতেই তিনি বলেন, একজন কুস্তিগীর তার শরীরকে ঠিক রাখার জন্য যেমন পুষ্টিকর খাবার খান, তেমনি এই প্রজাতির মোরগের খাবারেরও তালিকা আছে। সাধারণ মোরগগুলো ধান, গম খেলেও লড়াই মোরগের খাদ্য হলো বাদাম, ঘি, মাখন, গরুর মাংস, ডিম, দুধ, ভিটামিন সিরাপ, ট্যাবলেট প্রভৃতি। সেই সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ব্যায়াম, প্রাকটিস ও খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড়ের মতো মোরগগুলোর ফিটনেস ধরে রাখতে কাজ করতে হয় মালিককে।

কত দাম এসব মোরগের? জবাবে ঢাকা ইউনাইটেড ক্লাবের আরেক সিনিয়র সদস্য মনজুর হোসেন শিপু বলেন, দুইমাস বয়সী একটি বাচ্চার দাম এক হাজার টাকা, মাঝারি বয়সের একটি মোরগের দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা, আর লড়াইয়ে দক্ষ একটি মোরগের দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার কম নয়। এদের উচ্চতাও সাধারণ মোরগের চেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত একটা মোরগ ২৪-২৮ ইঞ্চি হয়ে থাকে। কোনো কোনো মোরগ ৩০-৩২ ইঞ্চিও হয়ে থাকে। তবে সেগুলো বেশির ভাগই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ এদের মাসলসে প্রবলেম থাকে। পায়ের জোরটা পুরোপুরি পায় না। তাই ২৪-২৮ ইঞ্চি উচ্চতার মোরগগুলো লড়াইয়ের জন্য বেশি ভালো।

শিপু বলেন, সবচেয়ে মজার বিষয় হলো গরুর যেমন সিং হয়, তেমনি এই মোরগগুলোর দু’পায়ে কাটা থাকে। তবে, খেলার নিয়ম অনুযায়ী এই কাটা আধা ইঞ্চির উপরে থাকতে পারবে না। আমরা সাধারণত হেসকো বেল্ড দিয়ে অতিরিক্ত অংশটুকু কেটে ফেলি। বক্সাররা যেমন হাতে গ্লাভস পরে তেমনি এসব মোরগের লড়াইয়ের সময় আগে তুলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলেও এখন গ্লাভস পরানো হয়। এসব গ্লাভস ভারত থেকে আনা হয়।
তিনি বলেন, আসিল মোরগ দেখতে হিংস্র হলেও এরা মারাত্মক প্রভুভক্ত। মালিকের আদর বোঝে, দেখলে ডাকতে থাকে, সামনে দিয়ে ঘুরাঘুরি করে। আদর করে আমরা এদের নামও রাখি। যেমন সুরমাইয়া, দাড়িওয়ালা লাখা, ঝাওয়া ইত্যাদি। মালিকের সম্মান রাখার জন্য খেলার মাঠে নিজের জীবন দিয়ে দেবে, কিন্তু হার মানতে নারাজ এই মোরগগুলো।

খেলার নিয়মাবলী ও জয়-পরাজয়ের বিশদ বর্ণনা তুলে ধরে শিপু বলেন, আসিল মোরগ লড়াইয়ের জন্য রয়েছে প্রায় ৩০-৩৫টি নিয়ম। লড়াইয়ের জন্য ১২ ফুট বাই ১২ ফুট স্কয়ার জায়গা নির্ধারণ করা হয়। মাঝখানে থাকে গোল একটা বৃত্ত যেটাকে আমরা গোল পয়েন্ট বা মিডল পয়েন্ট বলে থাকি। মাঠের মাঝখানে দু’জন মানুষ দু’টি মোরগ হাতে নিয়ে বসেন। খেলার আগে আমরা সাধারণত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটা কমিটি করে দেই। কারণ, খেলায় কোনো রেফারি নেই। তাই কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর মাঠে মালিকের পক্ষ থেকে যে মোরগগুলোকে খেলায় তাদের আমরা ‘খলিফা’ বলি। কমিটির নির্দেশ পাওয়া মাত্র শুরু হয় খেলা। প্রাকটিস ম্যাচ সাধারণত ৪০ মিনিট খেলা হয়। এর মধ্যে বিশ্রাম আছে প্রায় ১০ মিনিট। লড়াই করতে করতে অনেক সময় হাফিয়ে গেলে বা আহত হয়ে পড়লে তখন গরম পানি দিয়ে মোরগের শরীরটা মুছে দেওয়া হয়। আহত হয়ে শরীরে ক্ষত হলে ক্ষতস্থানটা ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে সেখানে ব্যান্ডেজ দিয়ে বেধে দেওয়া হয়। লড়াই শুরু হলে দু’টি মোরগ একজন আরেকজনকে কুপোকাত করার জন্য ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে পা দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

ঢাকা ইউনাইটেড ক্লাবের এ সিনিয়র সদস্য আরও বলেন, প্রতিযোগিতামূলক এই খেলা প্রায় ২ ঘণ্টা হয়, তখন দেখা যায় অনেক মোরগের ঘাড় ভেঙে গেছে। আবার অনেক সময় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কারণ মোরগটি যখন পা দিয়ে লাথি মারে তখন তার পায়ের নখ শত্রু পক্ষের চোখে লাগলে চোখটা পড়ে যায়। সাধারণত যেসব মোরগ লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না, তখন সে দৌঁড়ে পালায়। এভাবে তিনবার দৌঁড়ে সীমানা বাইরে চলে গেলে সে মোরগ পরাজিত হয়। অনেক সময় মোরগটা খুব জেজি থাকে, সে লড়াইও করে না, আবার পালিয়েও যায় না। মাঠেই মোরগটি বসে থাকে।
নিয়মানুযায়ী কোনো মোরগ হাঁটু গেড়ে বসলে এবং সেই বসার সময় ১ মিনিট অতিক্রম করলে সেই মোরগটি পরাজিত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। আবার কখনো দেখা যায়, মোরগটি দৌঁড় দিচ্ছে না, বসেও পড়ছে না, এবং লড়াইও করছে না। সেক্ষেত্রে লড়াই না করা মোরগটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী মোরগটি একের পর এক আক্রমণ করে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে। এতে এক সময় তার মাথার নলটি নুয়ে পড়ে মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। নিয়মানুযায়ী কোনো মোরগের মাথার নল যদি ১০ সেকেন্ডের বেশি নুয়ে থাকে, তাহলে সে পরাজিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে তিনবার হলে অন্য মোরগটিকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়।
তিনি জানান, বিজয়ী মোরগের মালিকের জন্য রয়েছে নানা ধরনের পুরস্কার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলায় চ্যাম্পিয়ন মোরগের মালিককে ৬০-৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। রানার্সআপ পায় ৩০-৪০ হাজার টাকা। খেলার ফলাফল বের করতে ৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা এবং সর্বনিম্ন ৫ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট খেলার রেকর্ড রয়েছে।

ঢাকা ইউনাইটেড আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থার সদস্য নাজমুল আহসান কাজল, সরদার মেরাজ আহমেদ, কে.এম. আশিকুর রহমান, হাসিনা উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ রিজু বাংলানিউজকে বলেন, খেলার মাঠে সম্মানের ব্যাপারটাই হলো এখানে বড়। সম্মান ধরে রাখার জন্যই একেকজন অনেক পরিশ্রম করে একটি মোরগকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই খেলাটা এক ধরনের শখ। শুধুমাত্র শখ না বলে নেশাও বলা যায়। এই মোরগগুলোর পিছনে অনেক খরচ করতে হয়, যা বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তারপরও নেশা তাই ছাড়তে পারি না। এ এক অন্য জগত। আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে শুধু একটাই কীভাবে খেলাতে পারলে, কোন প্র্যাকটিসটা করাতে পারলে আমার মোরগটা জিততে পারবে।
তারা বলেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এই মোরগ লড়াই খেলাটি হয়। তবে মোহাম্মদপুর বসিলা মাঠে প্রতি শুক্রবার নিয়মিতভাবে নতুন মোরগগুলোকে প্র্যাকটিস করানো হয়। এছাড়া, দক্ষ মোরগগুলোর ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত এখানে অনুশীলনের ব্যবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৪