শ্রীমঙ্গল থেকে: গাড়ি তখন সবে শ্রীমঙ্গল ঢুকেছে। দু’চোখের আড়ষ্টতা ভাঙলো মুহূর্তে।
শ্রী অর্থাৎ সুন্দর ও মঙ্গল অর্থাৎ ভালো কিছু দেখবো এই আশায় গাড়ি থেকে নেমে একটু ফ্রেস হয়েই বেরিয়ে পড়লাম চায়ের দেশে। বাইক্কা বিল উপভোগ করতে চাই দিনজুড়ে। তাই আগামীকাল রেখে দিলাম তারজন্যে। পড়ন্ত বিকেলের প্রথম গন্তব্য চা বাগান। রোদটা তখন নরম। মোটরবাইকে আমরা তিনজন। যাচ্ছি ভাড়াউড়া চা বাগানে। মন ভরে গেলো বাগান দেখে। তবে যতটা বাগান ভালো লেগেছে ততটাই কষ্ট পেয়েছি বাগানের কারিগরদের নির্মম মানবেতর জীবনযাত্রা দেখে। সে গল্প আরেকদিন।

চোখজুড়ানো চা বাগান দেখে যখন ফিরছি তখন বিকট গন্ধ যেন থামিয়ে দিল আমাদের। সূর্য তখন প্রায় চলে গেছে আঁধারের দেশে।
দেখলাম একটি ময়লার ট্রাক ঢুকছে রাস্তার উত্তর পাশে। দক্ষিণ পাশে একটি সরকারি কলেজ, একটি রেসিডেনসিয়াল স্কুল। পশ্চিম পাশে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা। মাঝের জায়গাটিতে ময়লার ভাগাড়। একটু অবাক লাগলো। বাইক থামালাম।
শ্রীমঙ্গলের একি শ্রী! শ্রীমঙ্গল নামের অন্য ইতিহাস থাকলেও শহরে আসা নতুন মানুষরা শ্রীমঙ্গল নামের ব্যাখ্যা এভাবে দিতেই পছন্দ করেন।

কৌতূহল থেকে কথা বললাম স্কুলের দারোয়ান আব্দুল লতিফ ও স্কুলছাত্রী উজ্জ্বয়িনী উৎসার সঙ্গে। তারা দুজনই জানালেন,সুন্দর মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান স্কুল কলেজের সামনে থাকা নোংরা বর্জ্য নামক অসুন্দরের ফিরিস্তি।
এ সমস্যা তাদের দীর্ঘদিনের। নাকে রোমাল দিয়ে স্কুলে আসতে হয় তাদের প্রতিদিন। বর্ষাকালে এটা হয়ে ওঠে অসনীয়। কিন্তু বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অবস্থার পরিবর্তনে নেই কোনো উদ্যোগ।
আমরা এগিয়ে গেলাম ময়লার স্তূপের দিকে। সেখানে গিয়ে বিস্ময় যেন আরও বেড়ে গেলো। ময়লার স্তূপের ঠিক মাঝে জীবনদায়ী পানির গভীর নলকূপ। তাও আবার নতুন বসানো! বরষার দিনে পাইপ ছিদ্র হয়ে এই আবর্জনা মেশে পানির সঙ্গে।
শ্রীমঙ্গলের ‘শ্রী’ আমাদের আরেকবার অবাক করলো। একটু দূরের ময়লা ঘেঁটে ‘রত্ন’ খোঁজায় ব্যস্ত দুই শিশু। লোহা, প্লাস্টিক তাদের কাছে রত্নই!তাদের সঙ্গী কুকুর, কাক,চিলও।

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ, দ্য বাড্স রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, একটি মসজিদ ও গাউসিয়া শফিকিয়া দাখিল মাদ্রাসার পাশে ময়লার ভাগাড় থাকায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীও।
ব্যবসায়ী স্বপন বাড়ৈ বাংলানিউজকে বলেন,দিন দিন এ আবর্জনা বাড়ছে। একটা জায়গায় আগে সীমিত ছিল। এখন ছড়িয়ে গেছে। আর বর্ষার সময়ে এই এলাকা দিয়ে চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়ে। ময়লা এখন রাস্তার ওপর এসে পড়েছে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে জানান,এলাকাবাসী এবং শিক্ষার্থীরা এটি স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সময় স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবার ময়লা আবর্জনা আরও বেশি করে ফেলা শুরু হয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ বলেও জানান তিনি।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মো.মহসীন মিয়া মধু বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে এই ময়লা আবর্জনার স্তূপ অপসারণের উদ্যোগ আমাদের রয়েছে। আমরা ময়লা ফেলার জন্য যে জায়গাটি নির্বাচন করেছিলাম তা নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। এটি নিরসন হলেই সমস্যা সমাধান হবে।
তবে এলাকাবাসীর কাছে এমন আশ্বাস নতুন নয়। শ্রীমঙ্গলের মতো সুন্দর শহরের বুকে চাঁদের কলঙ্কের মতো এই সামান্য দাগ কি মুছবে?
তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে। ফেরার পালা। চা বাগানের সৌন্দর্য তখন অনেকটা যেন ম্লান। নাকে দুর্গন্ধ। চোখও অনেকটা ধূসর।

কিন্তু হঠাৎ আবর্জনার স্তূপের উপর হাজির হলো একঝাঁক বলাকা। মুহূর্তে পরিবর্তন হয়ে গেলো পরিবেশ। চোখ হয়ে উঠল সুন্দর। যেন তারা বলে গেলো শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্য হানি হতে পারে, তবে তা ফুরোবার নয়। আমরা আছি। এসো বাইক্কা বিলে। দেখা পাবে এক সুন্দরের মধ্যে আরেক সুন্দর রাজ্যের।
আমরা এখন সকাল হওয়ার অপেক্ষায়।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪