ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

হনুমান যখন চশমাপরা

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৫৪, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৪
হনুমান যখন চশমাপরা

লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: লাউয়াছড়া ভ্রমণের প্রথমদিন সকালটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। তাপমাত্রা সাড়ে ৮ ডিগ্রি।

সকালে হালকা রোদে উল্লুক দেখা যাবে এই আশায় তবু লেপের ওম ছেড়ে রওয়ানা দিলাম। রোদের দেখা মিললো না ১২টা পর্যন্ত।

অনেকটা হতাশা নিয়ে স্থানীয় গাইডের সঙ্গে ঢুকলাম বনের তিনঘণ্টার ট্রেইল দিয়ে। পানের বাগান ছেড়ে বনে ঢুকতেই সামনে দিয়ে উড়ে গেলো একটি বনমোরগ। বালু বিছানো আঁকাবাঁকা চিকন সংকীর্ণ পথে মিললো হরিণের টাটকা বিষ্ঠা। বুঝলাম এখানে হরিণ ছিল একটু আগেও। বন্যশূকর বিচরণের চিহ্নও কম নয়। এসব দেখে আশায় বুক বেঁধে অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যদিয়ে এগুতে থাকলাম আমরা।

প্রায় একঘণ্টা হাঁটার পর গাইড হঠাৎ বলল, চুপ। থমকে দাঁড়ালাম আমরা। বলল, আস্তে ওই ওপরের ডালে দেখেন উল্লুক। উত্তেজনায় পড়ি মরি করে ক্যামেরা বের করলো নূর। দেখলাম একটি না, কয়েকটি। আনন্দে আত্মহারা হলাম আমরা। অনেক দূর থেকে বোঝার উপায় নেই এটা উল্লুক না অন্য কোনো প্রাণী। শুধু আমরা বুঝতে পারলাম ধূসর ও কালো রঙের বানরের মতো দেখতে কয়েকটি প্রাণী বসে ফল পাতা খাচ্ছে।

নূরের তোলা ছবি জুম করে দেখা গেলো এটা আসলে উল্লুক না, লেজ আছে। উল্লুকের লেজ নেই। চোখের চারপাশে গোল সাদা। ভ্রু, মুখের অনেকটা অংশও সাদা। জানলাম এটা চশমাপরা হনুমান। এটিও বিরল প্রজাতির প্রাণী। দেখতে ভারি সুন্দর। লোমশ শরীর। একে একে বের হলো পাঁচটি। দল বেঁধে থাকে এরা। পরে আমরা আরও দুদিন ঘুরে টিকি দেখতে পাইনি এদের।

দেশের বরেণ্য বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুল খান বাংলানিউজকে বলেন, চশমা পরা হনুমানের ইংরেজি নাম Phayer’s Leaf Monkey. বৈজ্ঞানিক নাম Trachypthecus phayrei। বাংলায় এদের কালো হনুমানও বলে। দুই চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রং থাকে বলে এদের চশমা পরা হনুমান বলে। এদের শরীরের বেশিরভাগ অংশই কালো রঙের। এরা বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী।

তিনি আরও বলেন, চশমাপরা হনুমান পাতা, ফুল ও ফল খায়। মাঝে মধ্যে পোকামাকড়, পাখির ডিম এগুলোও খায়। মূলত এরা নিরামিষভোজী। এরা মোটামুটি বড়-সড় দলে বাস করে। ওই দলের নেতৃত্ব দেয় একটা পুরুষ চশমাপরা হনুমানই। একটা দলে অনেকগুলো মেয়ে চশমাপরা হনুমান থাকে। ওই পুরুষটিই প্রজনন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। এই পুরুষটিকে‌‌‌ ‌‘আলফামেল’ বলে। অর্থাৎ মোগলদের হেরেমের মতো। একে প্রজনন পুরুষও বলা যায়।

ড. মনিরুল খান বলেন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটি যখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষে রূপান্তরিত হয় তখন দলের ওই একমাত্র নেতৃত্বদানকারী ‌‘আলফামেল’টি সদ্যপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটিকে দল থেকে বের করে দেয়। দল থেকে বহিষ্কৃত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষটি আবার কোনো দলের দুর্বল আলফামেলকে যুদ্ধে পরাজিত করে ওই দলের দখল নেয় এবং আলফামেলের নেতৃত্বের চলে আসে। এরপর সদ্য নেতৃত্বে আসা আলফামেলটি পূর্বের আলফামেলের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলে। যাতে করে মেয়ে চশমারা হনুমানগুলো ওই আলফামেলের প্রজননের আওতায় দ্রুত চলে আসে।

ড. মনিরুল খান আরও বলেন, চশমাপরা হনুমানের মাথা ও শরীরের দৈর্ঘ্য ৫৩ সেমি. এবং লেজের দৈর্ঘ্য ৭৬ সেমি.। এরা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বেশি সংখ্যায় আছে। তবে বাংলাদেশে এর সংখ্যা খুব বেশি সংখ্যায় নেই। এরা বৃহত্তর সিলেটের সংরক্ষিত বনগুলোতে রয়েছে। সবুজ চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা এরা। চশমা পড়া হনুমান উচ্চস্বরে ডাক দেয় ও ভয়ংকর শব্দ করে থাকে। অন্য প্রাণীরা তাদের এই শব্দকে ভয় পায়। আবাসস্থল ধ্বংস ও বনের বড় বড় বৃক্ষগুলো নিধনের ফলে এদের অস্তিত্ব অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০৯  ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।