লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: লম্বা মোটা ঠোঁটের কাও ধনেশ ভারি দুষ্টু মিষ্টি পাখি। এদের দেখা মেলা বেশ কঠিন।
ডাক শোনা মাত্রই ছুট ক্যামেরা নিয়ে। বালু বিছানো পথে সন্তর্পণে। কাছাকাছি গিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এসময় ডেকে উঠলো হঠাৎ। দিনে দিনে একেবারে হারিয়ে যেতে থাকা পাখিটি দেখে উচ্ছ্বসিত হলাম। এর আগে দেখেছি চিড়িয়াখানায়। প্রকৃতিতে প্রথম। ভাগ্যকে আরও একবার ধন্যবাদ জানালাম।

তবে একটি দুটি নয়, পরপর দেখা পেলাম পাঁচটির। উঁচু গাছের ডালে ফল খাওয়ায় ব্যস্ত। লম্বা ঠোঁট দিয়ে মট মট করে ছোট ছোট ডালও ভাঙছে। ডেকে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর।
দলবদ্ধভাবেই ঘুরতে পছন্দ করে ধনেশ পাখি। সে প্রমাণও মিললো যখন একে একে পাঁচটি পাখি হাজির হলো। অবশ্যগুলোকে একসঙ্গে ক্যামেরাবন্দি করা গেলো না। এক ফ্রেমে পাওয়া গেলো তিনটিকে। যখনই টের পেলো কেউ তাদের দেখছে অমনি দলধরে ডেকে গেলো উড়ে। আমরাও ছুটলাম পিছে পিছে। কিন্তু এত উঁচু ডালে গিয়ে বসলো যে ক্যামেরার লেন্সে আর কুলালো না। অগত্যা ফিরে এলাম আমরা।

দেশের বরেণ্য পাখি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৃতি বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রোনাল্ড হালদার বাংলানিউজকে বলেন, এই পাখিটির নাম মূলত কাও ধনেশ হলেও পাকরাধনেশ বা উদয়ী পাকরাধনেশ নামেও পরিচিত। উপমহাদেশের প্রখ্যাত পাখি পর্যবেক্ষক ও গবেষক সেলিম আলীর বইতেও এ পাখিটিকে কাও ধনেশ বলা হয়েছে। এর ইংরেজি নাম Oriental Pied Hornbill এবং বৈজ্ঞানিক নাম Anthracoceros albirostris। এরা বাংলাদেশের স্থানীয় পাখি হলেও এখন এদের দেখা পাওয়া বিরল। এরা মূলত পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা।

তিনি বলেন, এ পাখিটির দৈর্ঘ্য ৯০ সেমি। প্রকাণ্ড ঠোঁটেই রয়েছে তার দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য। শরীরজুড়ে আবার সাদা-কালো ও হলুদ রঙের অপূর্ব সংমিশ্রণ। মানুষের মতোই এদের চোখের পাতার নিচে রয়েছে চুল। এমন নয়নাভিরাম পাখিকে দেখে সহজেই আলাদা করে চেনা নেয়া যায়। এদের বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামের ঘন বনাঞ্চলগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং চীনের দক্ষিণাঞ্চল এদের প্রধান আবাসস্থল। আইইউসিএন এ প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত ঘোষণা করেছে। এরা বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি।

রোনাল্ড হালদার বলেন, প্রজনন মৌসুমে পুরো পরিবারকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ছেলে কাও ধনেশটির উপর বর্তায়। বড় বড় পুরনো গাছের কোটরে বাসা করে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সাপসহ নানা সরীসৃপ তাদের ডিম,ছানাগুলোকে খেয়ে ফেলার জন্য ঘোরাফেরা করে। সেইসব শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মেয়ে ধনেশটা ডিম পাড়তে শুরু করলে ছেলে ধনেশটা ডোবা-নালা থেকে কাঁদা মুখে করে এনে দেয়াল তুলে সেই গর্তটা অনেকটাই বন্ধ করে দেয়। মধ্যে শুধু ছোট্ট একটা ছিদ্র রাখে। সেই ছিদ্র দিয়ে শত্রুরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।

তিনি বলেন, ওই ছিদ্র দিয়েই সে খাবার সংগ্রহ করে এনে ভেতরে ডিমে তা দেয়া মেয়ে পাখিটাকে খাওয়ায়। ডিম ফুটে ছানা হলে মা এবং ছানাগুলোকেও খাওয়ায়। পুরো দেড় মাস - দু’ মাস ধরে সে একাই এসব কাজ করে চলে। খাবার সংগ্রহ করে সে নিজে খায় এবং পাশাপাশি তার প্রিয়জনদের ঠোঁটে খাবার তুলে দেয়। এ যেন এক আশ্চর্য ভালবাসা! এ সময় প্রচণ্ড গরমের কারণে গর্তের ভেতরে থাকা মেয়ে পাখিটার সব পালক ঝরে যায়। গর্তের ভেতরে পালক খসে পড়ার ফলে সে আর উড়তে পারে না। সে তখন অসহায়বোধ করে এবং ছেলে পাখিটির উপর নির্ভরশীল হয়। তারপর একসময় ছানাগুলো বড় হয়ে ওঠার পর গাছের কোটরের ওই মাটির দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়। ধীরে ধীরে মা এবং ছানাদের পালক গজায়।

এ পাখির অস্তিত্ব ঝুঁকি সম্পর্কে এই পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, এই পাখির প্রজননজনিত সমস্যা কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সালে আমি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এই পাখি সম্পর্কে একটি বেদনাদায়ক তথ্য সংগ্রহ করি। শেষ মুহূর্তে এই পাখির ছানাগুলো যখন উড়বে তখনই স্থানীয় জনগণ বাসা ভেঙে ছানাসমেত পাখিগুলোকে ধরে নিয়ে যায়। এরা বড় বড় গাছের গর্তে বাসা তৈরি করে। বড় বড় গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে এদের অস্তিত্ব অনেকটাই হুমকির মুখে। এছাড়াও আমাদের দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা এই পাখিটিকে শিকার করে থাকে। এদের বিশাল ঠোঁট এবং পালকগুলোকে তারা সংরক্ষণ করে। হাতুড়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ধনেশ পাখির তেল বিক্রির নামে কাও ধনেশ ব্যাপক হারে মারা হচ্ছে। যদিও দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতারা ধনেশ পাখির তেল মনে করে পোড়া মবিল কিনে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ধনেশ পাখি মারা হয় কেবলমাত্র তেলের বিজ্ঞাপনের জন্য।
আমাদের সবারই বিপন্ন এই পাখিটিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৪