ঢাকা: রাতের আকাশ থেকে অন্ধকার দূর হতে থাকে। ভোরের সূর্যের আলোর রেখা দেখা দেয় পূবের আকাশে।
সেদ্ধ চাল পাটিতে ছড়িয়ে দিতে দিতে সূর্যের আলোর তাপ বাড়তে থাকে। সেই তাপে আরো ঝলসে যায় মায়ের তামাটে শরীর। পা দিয়ে ধান নেড়ে দিতে থাকেন। মায়ের পা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। সেখানে পড়েনা কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া।
আমার মায়ের খসখসে হাত আমার কাছে সবসময়ই কোমল মনে হয়। জুই নারিকেল তেল বা পন্ডস কোল্ডক্রিম নারী দিবসে কর্পোরেট আমেজ দিলেও, মায়ের হাত এবং পায়ের খানিক যত্ন নেয় বাজার থেকে কিনে আনা ছোটো সরিষার তেলের শিশি।
দুপুর নাগাদ আরো ধানের আঁটি আসতে থাকে উঠোনে। মা সেগুলো নামিয়ে রাখেন, ভাঙানোর মেশিনের পাশে। এর মাঝেই দুপুরের খাবার রান্না আর বৃদ্ধ দাদী আর ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনাও করতে হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে বসে এভাবেই নিজের মায়ের কথা শোনান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র তরিকুল।
চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে ধানের ক্ষেত থেকে দুপুরে বাবা যখন ঘর্মাক্ত শরীরে ফেরেন, তার রাগ তখন কড়মড় করে। মায়ের চেহারায় চলে আসে ভয়ের ছাপ। দুপুরের খাবারে ভাত শক্ত থাকলে বাবা রেগে যান ভয়াবহ। তরকারির লবণ বা ঝাল এদিক সেদিক হলে সহ্য করতে পারেন না তিনি। দুপুরে বাবার খাওয়ার সময় এলেই বিগত দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় মায়ের চোখে ভাসে ভয়, ‘যদি স্বামীর ভালো না লাগে!’
দু’রাত ধরে মায়ের নির্ঘুম থাকার কথা মনে রাখার দায়িত্ব বাবার আচরণে কখনোই বোঝা যায় না।
এসময় মুরুব্বি বৃদ্ধারাও বাবার রাগের কারণ হিসেবে মাকেই অভিযুক্ত করেন। মায়ের ৩০ বছরের সংসারজীবন ব্যর্থ হয়ে যায় পান থেকে চুন খসলে।
দাম্ভিক স্বামী পুরুষতান্ত্রিকতার গাম্ভীর্য নিয়ে এড়িয়ে যান স্ত্রীর প্রতি তার দায়িত্ব। সংকোচ করেন সমাজের রীতি ভেঙে মায়ের পাশে এসে বসতে। ক্ষেতে ফসল ফলানো আর বাজার করে আনাতেই পুরুষের দায়িত্ব পালন হয় সংসারে।
তরিকুল বলেন, বাবাকে কখনো মায়ের ওপর শারীরিক নির্যাতন করতে দেখি নি। বাজার থেকে বা ক্ষেত থেকে বাবা ফেরার পর তার রাগী বা অসন্তুষ্ট চেহারা মায়ের মনে ভয়ের যে কাঁপন তুলতো, সেই নির্যাতনও কোনো অংশে কম ছিল না।
সংসারে তিন বেলা খাবারের উপাদান কি হবে, সেই সিদ্ধান্তই শুধু নিতে পারতেন মা। তবে সেখানে স্বাদের এদিক সেদিক হলে বাবা এবং আমাদের সন্তানদের মুখ থেকেও ধিক্কার শুনতে হতো তাকে।
তরিকুল বলেন, আমার ছোট তিন ভাই-বোনকে মাদ্রাসায় পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেখানেও ছিল না আমার মায়ের কোনো মতামত। ১৫ বছর বয়সে সংসার শুরু করা মা এখন ৪৫ পেরিয়েছেন। কিন্তু স্বামী, সন্তান আর সমাজ তার ওপর ঢেলে যাচ্ছে মানসিক নির্যাতনের স্রোত। শিক্ষিত সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে হলে ভাবতে হয় মাকে। মন খুলে জানাতে পারেন না অভিব্যক্তি।
তরিকুলের মাকে ছোঁয় না ২০১৪ সালের আর্ন্তজাতিক নারী দিবসের রাতের আঁধার ভাঙার শপথ।
এভাবেই আমাদের সমাজে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে মায়েদের, নারীদের।
গত দুই যুগ ধরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করলেও ঘরের মধ্যে বদলায় নি নারীর অবস্থা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে’ অনুযায়ী দেশের বিবাহিত নারীদের ৮২ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
জরিপ অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮২ শতাংশ নারীই শিকার হচ্ছেন মানসিক নির্যাতনের। ৬৫ শতাংশ নারী তার স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন আর ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা একটু বেশি ঘটে। স্বামীর বাড়িতে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বেশি হন।
জরিপে ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
জরিপ অনুযায়ী ঘরের ভেতরে স্বামী ও অন্যান্য আপনজনের কাছেই নারী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হন।
উইমেন ফর উইমেন এর সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন বৃহস্পতিবার বাংলানিউজকে বলেন, সংসার থেকে শুরু করে কর্মস্থলেও নারীরা মানসিক নির্যাতেনর শিকার হচ্ছেন। এটা সমাজের অগোচরে, কারণ এটা দেখা যায় না।
তিনি বলেন, নারীরা শুধু স্বামী দ্বারাই নির্যাতিত হন না, পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমেও নির্যাতনের শিকার হন নারী। এ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষার অভাব এবং বাল্য বিবাহ অনেকাংশে দায়ী।
এখনো আমাদের গ্রামাঞ্চলে কন্যাশিশু হওয়ার জন্য বা সন্তান না হওয়ার জন্যে নারীকেই দোষারোপ করা হয়। অনেক সময় এ মিথ্যা অপবাদের বলি হতে হয় নারীকে। এর ফলে মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ ভয়ংকর রূপ নেয় বলে জানান শওকত আরা হোসেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, নারী ঘরেই নির্যাতিত হচ্ছে। এটা যে শুধু শারীরিক নির্যাতন তা নয়, মানসিক নির্যাতনও বটে। নারী ভাবে তার ওপর নির্যাতন হবে, এটিও এক ধরনের মানসিক নির্যাতন।
তিনি বলেন, শহুরে নারীর তুলনায় গ্রাম্য নারীরা নির্যাতনের শিকার বেশি হন। বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হতে হতে তারা নিজেদের সত্ত্বাকে ভুলে যান।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বৃহস্পতিবার বাংলানিউজকে বলেন, নারী নির্যাতন কমছে। তবে আগে নির্যাতনগুলো অপ্রকাশিত থাকতো। এখন আমাদের মা-বোনেরা তাদের বঞ্চিত হওয়ার কথা জানাচ্ছেন। নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ করছেন।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে তার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৪