ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

যাতায়াতে ভরসা ছোট লঞ্চ কিংবা ট্রলার

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:০৩, মার্চ ৯, ২০১৪
যাতায়াতে ভরসা ছোট লঞ্চ কিংবা ট্রলার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরমোন্তাজ, পটুয়াখালী থেকে: চারদিকে বয়ে চলেছে নদী। মাঝখানে এক দ্বীপ।

নাম তার চরমোন্তাজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে যেখানে ঝুঁকিতে-সংকটে বেঁচে আছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। নদীর ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় এসব মানুষের জীবন ওলট-পালট হয়ে যায়। প্রকৃতির বৈচিত্র্য বদলে গিয়ে নি:স্ব হন বহু মানুষ। এতো ঝুঁকির পরেও এখানকার যাতায়াতে ভরসা ছোট লঞ্চ আর ট্রলার।  

সূর্যটা কেবল ডুবেছে। পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভা তখনও মিলিয়ে যায়নি। গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আসা ছোট্ট লঞ্চখানা বোঝাই যাত্রী নিয়ে চরমোন্তাজের পল্টুনবিহীন ঘাটে ভিড়েছে। নারী-পুরুষ ও শিশুরা সিঁড়ি পেরিয়ে ছুটছেন কিনারের দিকে। কেউ মোটরবাইকে, কেউবা ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে ফিরছেন গন্তব্যে।

চরমোন্তাজে এ চিত্র নিত্যদিনের। নদীপথে যাতায়াতের বাহন এসব ছোট লঞ্চ আর ট্রলার। এর ওপর অধিকাংশ ঘাটে নেই পল্টুন। ঝড় আর বর্ষা মৌসুমে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। মানচিত্রে পটুয়াখালীর শেষ সীমায় সমুদ্রের কাছে জায়গা করে নেওয়া এ দ্বীপের মানুষ প্রায় সারা মৌসুমই অবরুদ্ধ থাকেন। নদীপথ তার সীমানা বেঁধে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া, সবই যেন সময়ের গণ্ডিতে বাঁধা।

চরমোন্তাজের মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের দৃশ্যপট চোখে ভাসে এখানে আসার আগেই। রাঙ্গাবালী উপজেলার গহীনখালী লঞ্চঘাটে বেশকিছু যাত্রীর ভিড়। শেষ বিকালে মানুষগুলো অপেক্ষা করছেন কখন আসবে লঞ্চ। এ সময়টাতে গলাচিপা থেকে দু’টো ছোট লঞ্চ ছেড়ে আসে। তারই অপেক্ষা সবার।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর লঞ্চ যখন এলো, তখন নদীতে ভাটার টান। হাঁটুপানি পেরিয়ে লঞ্চে উঠতে হলো যাত্রীদের। বুড়াগৌরাঙ্গ নদী পেরিয়ে চরমোন্তাজের মণ্ডল লঞ্চঘাটে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হলো পানির ভেতরে।

যাত্রীরা জানান, সব লঞ্চঘাট প্রতি বছর ইজারা দেওয়া হয়। লঞ্চে ওঠার সময় ইজারাদারের লোকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে ঘাটের টিকেটের দামও রাখেন। কিন্তু লঞ্চে ওঠার জন্য ঘাটে একটা সিঁড়ি পর্যন্ত দিতে পারেন না। চরমোন্তাজের প্রধান লঞ্চঘাট স্লুইজবাজারে একটি পল্টুন দেওয়া হলেও ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে সেটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো, ঢাকা-চরমোন্তাজ রুটে লঞ্চ চলাচলের জন্য রুট পারমিট থাকলেও এখানে কোনো লঞ্চ আসে না। ঢাকার সদরঘাটে ঢাকা-চরমোন্তাজ লেখা লঞ্চ ভোলার বকসী নামক স্থান পর্যন্ত আসে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলেছেন, বিভিন্ন স্থানে ডুবোচর থাকার কারণে চরমোন্তাজ পর্যন্ত দোতলা লঞ্চ আসতে পারছে না।

চরমোন্তাজের স্লুইজ বাজার, বাইলাবুনিয়া, বউবাজার, চরবেস্টিনসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বলেছেন, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় এখানকার পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। খাদ্যপণ্যসহ সব জিনিসপত্র এখানকার মানুষকে কিনতে হচ্ছে অধিক মূল্যে। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি লঞ্চ চলাচলের দাবি তাদের।

ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস এখানকার মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে দাবি করেছেন চরের বাসিন্দারা। চর বেস্টিনের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘুর্ণিঝড়ে এলাকার মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। সিডরে এই দ্বীপের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সত্তরের ঘুর্ণিঝড়ে এখানকার ৭৫ শতাংশ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ছোট ঘুর্ণিঝড়ে প্রাণহানি না ঘটলেও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। চরে মাত্র দু’টি সাইক্লোন শেলটার থাকলেও লোকসংখ্যা অনুযায়ী প্রয়োজন কমপক্ষে ১০টি।

নদীভাঙ্গন এখানকার মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে। বার বার ভাঙনের শিকার মানুষেরা এলাকায় থাকতে না পেরে অন্যত্র ছোটেন। চরের বউবাজার ও নয়ারচর এলাকায় গিয়ে এরই প্রমাণ মেলে। বাঁধের ওপর বহু মানুষের বসতি চোখে পড়ে। অনেকে এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে গেছে কাজের সন্ধানে। অনেকে এলাকায় নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। চর আন্ডার পশ্চিম পাশ ও চর বেস্টিনের পূর্ব পাশ নদীভাঙ্গনের কবলে।

সমুদ্র ও নদী থেকে মাছ ধরা, মাছ চাষ ও জমিতে কৃষি আবাদ চরমোন্তাজের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। কিন্তু এসব পেশায় রয়েছে নানা ধরনের সংকট। সমুদ্রগামী জেলেরা প্রতিনিয়ত জলদস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারান। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে জেলেরা পান না আহরিত মাছের ন্যায্যমূল্য। অন্যদিকে লবণ পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করায় বেশিরভাগ জমি এক ফসলি হয়ে পড়েছে। মাটিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ফসলের আবাদও কমে গেছে।

চরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব দিক থেকেই রয়েছে সমস্যা। একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে এখানে। এসব কেন্দ্র থেকে মানুষজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হয়তো কিছুটা পান, তবে কিছুটা জটিল সমস্যায় তাদেরকে ছুটতে হয় বাইরে। আর তাতেই বিপত্তি যোগাযোগ সমস্যা। বাল্যবিয়ের কারণে জন্ম নিচ্ছে অপুষ্ট শিশু। এর ফলে বাড়ছে রোগ-বালাই। ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি হাইস্কুল, একটি প্রস্তাবিত হাইস্কুল আর একটি মাদ্রাসা রয়েছে এখানে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান চলছে জোড়াতালি দিয়ে।

চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দ্বীপ ইউনিয়ন হিসাবে এখানে রয়েছে অনেক সমস্যা। যোগাযোগ সমস্যা এ দ্বীপকে সব দিক থেকেই পিছিয়ে রেখেছে। এর উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বাজেট বাড়াতে হবে।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ এ কে শামসুদ্দিন আবু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েক বছরে এখানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তারপরও চরমোন্তাজকে এগিয়ে নিতে এখানে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করতে হবে। মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে এখানে তথ্য বিভাগের প্রচার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়:০৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।